পর্ব -২: বিশ্ব রাজনীতির ‘মুসলমানি-ঢং’ বনাম ‘ইসলামি-ঢং ‘

 আমার দেশ
১২ জুলাই ২০২৩

মিনার রশিদ

মিনার রশিদ

মিনার রশিদ

হিন্দু ধর্মের অনুসারী হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এত লম্বা দাঁড়ি রাখলেন অথচ মুসলিম জাগরণের কবি হয়েও কাজী নজরুল ইসলাম কেন দাঁড়ি রাখলেন না? অনেকের মনে জাগা এই প্রশ্নের জবাবটিও তিনি দিয়ে গেছেন। ‘ বড়র পীরিতি বালির বাঁধ’ গ্রন্থের এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, আমি ত টুপি- পায়জামা -শেরওয়ানি -দাড়িকে বর্জন করে চলেছি শুধু এই ‘মিয়া সাহেব’ বিদ্রূপের ভয়ে।

সেই ‘ মিয়া সাহেব ‘ বিদ্রূপেরই নতুন রূপ হলো কাউকে ‘খোমেনি’ বা ‘জামাত-শিবির ‘ হিসাবে আখ্যায়িত করা। এটি অত্যন্ত পুরনো ফ্যানোমেনা কিংবা অতি পুরনো একটি খেলা। অর্থাৎ কুকুরটাকে একটা খারাপ নাম দাও এবং তাকে ধ্বংস কর ( Give the dog a bad name and kill him)।

কাউকে এসব টাইটেল একবার পরিয়ে দিলে আর চিন্তা নাই। এই মেকানিজমেই এদেশের অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদকে কোণঠাসা করে ফেলা হয়েছিল।

কবি আল মাহমুদের ৮৮ তম জন্মদিনটি নিভৃতেই চলে গেল। দেশের অন্যতম এই কবিকে নিয়ে কোথায়ও তেমন আলোচনা চোখে পড়লো না। এমনকি যে জাসাসের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তিনি ছিলেন, সেই সভাপতির নামটি উচ্চারণ করতে জাসাসের বর্তমান কর্মকর্তা বা জাতীয়তাবাদের কাণ্ডারিরা এখন ভয় পান। অথচ শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এসকল হীনমন্যতা ঝেড়ে নিজস্ব সংস্কৃতিকে তুলে ধরার জন্যেই জাসাসের জন্ম দিয়েছিলেন। এত অল্প বয়সে এই ভিসনারি মানুষটি এত সব পরিকল্পনা কীভাবে গ্রহণ করেছিলেন, তা ভেবে সত্যি অবাক লাগে।

কবি আল মাহমুদ থেকে শুরু করে স্কাইপ কেলেঙ্কারির হুইসেল ব্লোয়ার অলি উল্লাহ নোমান, মাহমুদুর রহমান এমনকি শফিক রেহমানকেও জামাত শিবির টাইটেল দেওয়া সম্ভব হলেও পিনাকী ভট্টাচার্যের বেলায় তা জটিল সমস্যার সৃষ্টি করে বসেছে। ফলে যে মেকানিজমে অন্যদের কিছুটা থামানো গেছে, পিনাকীর বেলায় তা আর কাজ করছে না।

একজন জন্মগত ব্রাহ্মণ এবং আদর্শগত কম্যুনিস্টের পুত্রকে ( পিনাকী নিজেও তাই ) সেভাবে ক্যাটাগরাইজ করা বা ‘জামাত- শিবির’ বানানো সম্ভব হচ্ছে না। অনেক মুসলমান তনয় যখন রাজনীতির এই মুসলমানি ঢংটির ফেভারে দুয়েকটি কথা বলতে ভয় কিংবা লজ্জা পান তখন এই ব্রাহ্মণ পুত্র এমন কিছু কথা উচ্চারণ করেন যা শুনলে পিলে চমকে যায়। পাকিস্তান সৃষ্টির অপরিহার্যতা অত্যন্ত নির্মমভাবে তিনি তুলে ধরেন। তিনি অবলীলায় এদেশ থেকে জমিদার প্রথা উচ্ছেদের কথা লিখেন। আর সেই জমিদারি হারিয়ে সেই জমিদার তনয়রা কীভাবে সব একে একে কমিউনিস্ট সেজে এদেশে হিন্দুত্ববাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন সেই কথাটিও তিনি তার ক্ষুদ্র ভ্রাতা এবং ভগিনীদের জানিয়ে দিচ্ছেন।

পিনাকী ভট্টাচার্যকে নিয়ে ট্রাবলটি হলো, তিনি ইসলামের গুণে মুগ্ধ হয়ে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন, এমন কোথায়ও দেখা যায় না। বিজ্ঞানের ছাত্র পিনাকী ‘ বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ইসলাম’ এই ধরনের কথা কখনো বলেন না। বরং তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম – এই কিসিমের কথা! এদেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের বোধ বিশ্বাস নিয়ে যে ঠাট্টা – বিদ্রুপ, অবজ্ঞা, অবহেলা চলে এসেছে তিনি সেগুলোর ব্যাপারে সোচ্চার হয়েছেন। অনেকটা একই ধরণের কাজ অরুন্ধতী রায় করছেন ইন্ডিয়ায়।

তবে একথা সত্য যে তাঁর এসব নির্মোহ সত্য উচ্চারণে রাজনীতির “মুসলমানি-ঢং’ টি বিশেষভাবে উপকৃত হচ্ছে। হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী তসলিমা নাসরিন এবং সম ঘরানার কয়েকজন নট-নটীদের নিয়ে এদেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের বোধ বিশ্বাসকে কোপানোর যে পরিকল্পনা নিয়েছিলেন – পিনাকী ভট্টাচার্য, অরুন্ধতী রায় প্রমুখ যেন তারই একটা প্রাকৃতিক প্রতিশোধ।

চেতনার প্লাটফর্ম থেকে এই ব্রাহ্মণপুত্রকে মোকাবেলা একটু কঠিন ঠেকায় এবার চেতনা বিরোধী বলয় থেকেই এই কাজটি শুরু করা হয়েছে। একাজে সম্ভবতঃ কারও কারও ব্যক্তিগত ঈর্ষাকে কাজে লাগানো হচ্ছে। বিএনপির প্রগতিশীল অংশ এতে কিছুটা হাওয়া দিতে শুরু করে।

পিনাকী ভট্টাচার্যকে কনুই দিয়ে গুতিয়ে ‘মুসলমানি -ঢং’ থেকে ‘ইসলামি -ঢং’ এর দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। একজন তাঁকে খোমেনি হিসাবে অভিহিত করেন এবং বাকি কয়েকজন তাতে বাতাস দেওয়া শুরু করেন। এতে আমরা একটু সরব হলে এই ‘খোমেনি’ প্রকল্পের উদ্যোক্তারা আপাততঃ থেমে গেছেন বলেই মনে হচ্ছে। প্রকাশ্যে কিছু না লিখলেও একজন আমাকে আমাকে ইনবক্সে ম্যাসেজ পাঠিয়েছেন। সেখান থেকে পাবলিকলি জানানোর মত কিছু নেই বা সেটা আমার পক্ষে শোভনও হবে না। এটাকে আমি সুমতির উদয় বলেই ধরে নিচ্ছি।

মানুষ হিসাবে আমাদের মাঝে পারস্পরিক ঈর্ষা থাকবেই। পিনাকীর তুমুল জনপ্রিয়তা অনেককেই ঈর্ষান্বিত করে তুলতে পারে। কিন্তু যে কাজ করে এই ব্রাহ্মণপুত্র তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন সেই কাজটি এই অ-ব্রাহ্মণ পুত্ররা করতে চান না। অনেকেই আবার বলতে চান যে পিনাকীর এই জনপ্রিয়তা শুধু গরীব ঘরানার ধর্মীয় বলয়েই সীমাবদ্ধ। কিন্তু বাস্তব পরিসংখ্যান সম্পূর্ণ উল্টো কথা বলে। কয়েক দিন আগে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী এক ডাক্তার ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে। কথা প্রসঙ্গে জানালেন, উনার বাবা একজন প্রাক্তন সচিব, বয়স আশির কোঠায়। এই সচিব মহাশয় পিনাকীর দারুণ ভক্ত, নিজের বন্ধু – বান্ধবদের যে গ্রুপটি মেইনটেইন করেন ইনারা সবাই মিলে একসাথে বসে পিনাকীর ভিডিও দেখেন। আরও কয়েকজন উচ্চ শিক্ষিত ও সচেতন বন্ধু বান্ধবদের কাছ থেকে একই ফিডব্যাক পেয়েছি। আর আমার নিজের বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে পিনাকী বিদ্বেষী পেয়েছি তারা হয় আদর্শগত বা জন্মগত আওয়ামীলীগার অথবা হাসিনার বিকল্প দেখাও এই ঘরানার।

পিনাকীর এই জনপ্রিয়তার পেছনের কারণটি বুঝতে হলে আমাদেরকে এদেশের মানুষের পলিটিক্যাল নার্ভ কিংবা রাজনৈতিক মানসটি বুঝতে হবে, বুঝতে হবে এদেশের রাজনীতির ‘মুসলমানি- ঢং’ এবং ‘ইসলামি-ঢং’ এর মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক এবং তাদের মধ্যকার পার্থক্যটিও। এই ধারাবাহিক কিস্তির আগামী সংখ্যায় জামাতের কথিত ‘মহিলা আমির‘ বেগম খালেদা জিয়া সম্পর্কে আলোচনা থাকবে। তাঁকে কেন এই টাইটেলটি দেওয়া হয়েছিল, কারা দিয়েছিল আর তার এই টাইটেলের প্রভাব বিএনপি এবং সামগ্রিক রাজনীতির উপর কেমনভাবে পড়েছিল সেটা নিয়ে আলোচনা থাকবে। এর আগে একটি গল্প বলে আজকের পর্বের ইতি টানব।

জনৈক ডাক্তারের কাছে এক রোগী এসেছেন। সেই রোগী আবার ডাক্তারের বাল্যবন্ধু। তারপরেও নিজের সমস্যার কথা খুলে বলতে কেমন যেন আমতা আমতা করছে। ডাক্তার তার বন্ধুকে বললেন, বলো দোস্ত! আবার কী সমস্যা বাঁধিয়েছো?

– আরে দোস্ত বইলো না,একটা ফোঁড়ার মত হয়েছে।

– কোন জায়গায়, দোস্ত?

-খুব বেকায়দা জায়গায়, উচ্চারণ করতেও লজ্জা লাগছে।

ডাক্তার বললেন, ঠিক আছে, আর বলতে হবে না, বুঝেছি এটা তোমার হাসিনায়?

একটা পরম পরিতৃপ্তির হাসি দিয়ে বন্ধুটি যোগ করলেন,

থ্যাংক ইউ দোস্ত। পিনাকীরেও স্যালুট। ভদ্রলোক শুধু এদেশের রাজনীতিরই উপকার করছে না, মাশাল্লাহ আমাদের ভাব ও ভাষাকেও দিন দিন সমৃদ্ধ করছে।

লেখক: মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, লেখক ও গবেষক