পরিশোধের চাপে কমল বিদেশি ঋণ

রোহান রাজিববাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) কমেছে। এই তিন মাসে দেড় বিলিয়ন ডলারের বেশি বিদেশি ঋণ কমেছে। অথচ আগের প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) বেড়েছিল প্রায় সোয়া তিন বিলিয়ন ডলার। সব মিলিয়ে গত সেপ্টেম্বর শেষে বৈদেশিক ঋণের স্থিতি কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯৬ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।

খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, গত বছর থেকে ডলার বাজারে অস্থিরতা শুরু হয়েছে, যা এখনও কাটেনি। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক বিদেশি ঋণ বাড়াতে বেশকিছু পরিকল্পনা করেছে। তার মধ্যে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও এডিপি থেকে ঋণ নেয়ার জন্য চুক্তি করেছে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ বাড়াতে চেষ্টা করছে। তবে ডলারের বাজারে এখনও অস্থিরতা থাকার কারণে ব্যাংকগুলো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ব্যাংকগুলো আগের ঋণ পরিশোধে বেশি মনোযোগী। তাই বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি ঋণ দ্রুত কমছে। আর বিদেশি ঋণের সুদহার বেশি হওয়ার কারণে উদ্যোক্তরা ঋণ নিচ্ছেন না। তাই বিদেশি নতুন ঋণ বাড়ছে না। এতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ পরিশোধ দ্রুত হওয়া ও নতুন ঋণ না পাওয়ায় সার্বিকভাবে বিদেশি ঋণ কমে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, গত সেপ্টেম্বর শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৬৫৪ কোটি ৯৪ লাখ ডলারে (প্রায় ৯৬ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন)। তিন মাস আগেও যা ছিল ৯ হাজার ৮১০ কোটি ৭৭ লাখ ডলার (৯৮ দশমিক ১০ বিলিয়ন)। ফলে গত তিন মাসের ব্যবধানে বিদেশি ঋণ কমেছে ১৫৬ কোটি ডলার। অথচ আগের তিন মাসে বিদেশি ঋণ প্রায় ৩২২ কোটি ৩০ লাখ ডলার বেড়েছিল। এদিকে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৯ হাজার ২৯১ কোটি ২৪ লাখ ডলার। অর্থাৎ গত এক বছরে বিদেশি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৩৬৩ কোটি ডলার।

গত তিন মাসে সরকারি ও বেসরকারি সব খাতে বিদেশি ঋণের পরিমাণ কমেছে। সেই সঙ্গে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ নেয়ার পরিমাণ কমে এসেছে। তবে আগে নেয়া স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়েছে। আবার কিছু ঋণের মেয়াদ বাড়িয়ে নেয়ার ঘটনাও ঘটছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিপুল অঙ্কের এই বিদেশি ঋণের মধ্যে প্রায় ৭৮ শতাংশ সরকারি খাতের। বাকি ২২ শতাংশ ঋণ নিয়েছে দেশের বেসরকারি খাত। অর্থাৎ মোট বিদেশি ঋণের মধ্যে সরকারের নেয়া ঋণের পরিমাণ ৭ হাজার ৫২৬ কোটি ৮৭ লাখ ডলার। বাকি ২ হাজার ১২৮ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে বেসরকারি খাত। গত জুন পর্যন্ত সরকারি খাতে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার। এই হিসাবে গত তিন মাসে সরকারি খাতে বিদেশি ঋণ কমেছে ৫৯ কোটি ডলার। অন্যদিকে গত জুনে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ২২৫ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ফলে গত তিন মাসে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ কমেছে ৯৭ কোটি ডলার।

প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, গত তিন মাসে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ প্রায় ১২৩ কোটি ডলার কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার ২৪২ কোটি ৯৬ লাখ ডলারে। এসব ঋণের মধ্যে বাণিজ্যিক ঋণের পরিমাণ ৮৫৫ কোটি ২৩ লাখ ডলার। বাণিজ্যিক ঋণের বেশিরভাগ বায়ার্স ক্রেডিট, যার পরিমাণ প্রায় ৬৯২ কোটি ২৯ লাখ ডলার। বায়ার্স ক্রেডিটের এ ঋণ সাধারণত এক বছরের মধ্যে শোধ করতে হয়। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা এসব ঋণ নিয়ে থাকেন। এছাড়া বিদেশি ব্যাক টু ব্যাক এলসির ঋণ রয়েছে প্রায় ৭৬ কোটি ৪২ লাখ ডলার। আর ডেফার্ড পেমেন্টের ঋণ রয়েছে ৮৬ কোটি ৫২ লাখ ডলার।

এদিকে গত তিন মাসে বেসরকারি খাতে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বেড়েছে প্রায় ২৫১ কোটি ডলার। সব মিলিয়ে গত সেপ্টেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৮৮৫ কোটি ১২ লাখ ডলারে।

সম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ গ্রহণ ব্যাপকহারে বেড়েছে। সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতে বেড়েছে ঋণ। যদিও দেশের জিডিপির অনুপাতে বিদেশি ঋণ গ্রহণে বাংলাদেশ এখনও নিরাপদ অবস্থানে রয়েছে। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মানদণ্ডে জিডিপির ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণের স্থিতি যেকোনো দেশের জন্য নিরাপদ। বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ এখন জিডিপির প্রায় ২১ শতাংশের কম।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, গত কয়েক বছরে বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ তুলনামূলক বেশি বেড়েছে। তাছাড়া কভিড-১৯ মহামারির কারণে এসব ঋণ পরিশোধ না করে সময় বাড়িয়ে নেয়া হয়। সে কারণে এখন চাপ বেড়েছে ঋণ পরিশোধের। তবে নতুন করে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ বৃদ্ধি না পাওয়ার বিষয়টি ইতিবাচক।

শেয়ারবিজ