পদ্মা রেল লিংক প্রকল্প কিলোমিটারপ্রতি ব্যয়ে সর্বোচ্চ

এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পরিবহন অবকাঠামো নিয়ে যৌথভাবে একটি তথ্যভাণ্ডার তৈরি করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি)। প্লাটফর্মটির নাম এশিয়ান ট্রান্সপোর্ট আউটলুক (এটিও)। এতে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নির্মিত ও নির্মাণাধীন বিভিন্ন রেলপথ (নন-আরবান হেভি রেল প্রজেক্ট) প্রকল্প বিশ্লেষণ করে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় বের করা হয়েছে। এটিওর বিশ্লেষণ করা তথ্য অনুযায়ী, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পগুলোর মধ্যে কিলোমিটারপ্রতি নির্মাণ ব্যয়ের দিক থেকে শীর্ষস্থানীয় পর্যায়ে রয়েছে বাংলাদেশের একাধিক প্রকল্প। এর মধ্যে কিলোমিটারপ্রতি সবচেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে। এ প্রকল্পের কিলোমিটারপ্রতি নির্মাণ ব্যয় ৭৬ দশমিক ৩৭ মিলিয়ন বা ৭ কোটি ৬৩ লাখ ৭০ হাজার ডলার।

২০১৮ সালে জিয়ানইয়াং থেকে লিনচেঙ পর্যন্ত ১৯৯ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথের নির্মাণকাজ শুরু করে চীন। প্রকল্পটির প্রাক্কলিত নির্মাণ ব্যয় ২ হাজার ১৯৪ মিলিয়ন ডলার। পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি বা পিপিপির ভিত্তিতে আন্তঃদেশীয় মুদ্রার প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনায় এ ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৭৫১ মিলিয়ন ডলারে। এ হিসাবে জিয়ানইয়াং থেকে লিনচেঙ পর্যন্ত রেলপথটি নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি খরচ হচ্ছে ১৮ দশমিক ৮৫ মিলিয়ন বা ১ কোটি ৮৮ লাখ ৫০ হাজার ডলার।

কিলোমিটারপ্রতি ২০ দশমিক ৩৬ মিলিয়ন (২ কোটি ৩ লাখ ৬০ হাজার) ডলার খরচ হচ্ছে চীনের লুঝৌ-হুঝো রেলপথ নির্মাণে। রেলপথটির প্রাক্কলিত নির্মাণ ব্যয় ২ হাজার ৭৭৫ মিলিয়ন ডলার। পিপিপির হিসাবে এ ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৭৪৩ মিলিয়ন ডলারে। লুঝৌ-হুঝো রেলপথটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৮ সালে।

নম পেন থেকে লক ইন (ভিয়েতনাম সীমান্ত) পর্যন্ত ২৫৭ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি রেলপথের কাজ ২০১৮ সালে শুরু করেছে কম্বোডিয়া। রেলপথটি নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি খরচ হচ্ছে ৭ দশমিক ২৬ মিলিয়ন বা ৭২ লাখ ৬০ হাজার ডলার।

২০১৬ সালে পণ্য পরিবহনের জন্য বিশেষায়িত একটি রেলপথের নির্মাণকাজ শুরু করে ভারত। ওয়েস্টার্ন ডেডিকেটেড ফ্রেইট করিডোর নামের এ রেলপথের দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৫৩৪ কিলোমিটার। এশিয়ান ট্রান্সপোর্ট আউটলুকের হিসাব অনুযায়ী রেলপথটির কিলোমিটারপ্রতি নির্মাণ ব্যয় ৯ দশমিক ২৮ মিলিয়ন (৯২ লাখ ৮০ হাজার) ডলার।

সমসাময়িক সময়ে বাংলাদেশও একাধিক রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু করে। এর একটি হলো পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প। ২০১৮ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশী মুদ্রায় এখন পর্যন্ত রেলপথটির নির্মাণ ব্যয় ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা, যা ৪ হাজার ৫৭৪ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ। পিপিপি হিসাবে এ ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১২ হাজার ৯০৭ মিলিয়ন ডলারে। এ হিসাবে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে এক কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করতে খরচ হচ্ছে ৭৬ দশমিক ৩৭ মিলিয়ন ডলার। গত বছরের অক্টোবরে প্রকল্পটির ঢাকা-ভাঙ্গা অংশ উদ্বোধন করা হয়।

এরই মধ্যে প্রকল্পটির ব্যয় আরো প্রায় ২৮৬ কোটি টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ভ্যাট ও ট্যাক্সের পরিমাণ বৃদ্ধি, ভাঙ্গা জংশন ওভারহেড স্টেশন ভবন, টিটিপাড়া আন্ডারপাস, তুলারামপুরে নতুন রেলওভার, ঢাকা-গেন্ডারিয়া তৃতীয় লাইন, ১১ তলা এমপ্লয়ার ভবন, সিঙ্গিয়া স্টেশন ভবন, লিফট ও এস্কেলেটর সংযোজনের মতো পূর্তকাজের পরিধি বৃদ্ধির কারণে এ ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। প্রস্তাব অনুমোদিত হলে প্রকল্পটির ব্যয় বেড়ে দাঁড়াবে ৩৯ হাজার ৫৩২ কোটি টাকায়।

কিলোমিটারপ্রতি ১৪ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন (১ কোটি ৪৪ লাখ ৩০ হাজার) ডলার খরচ হয়েছে খুলনা বন্দর সংযোগ রেলপথ (খুলনা-মোংলা) নির্মাণে। ২০১০ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের মাধ্যমে ৭৫ কিলোমিটার নতুন রেলপথ তৈরি করা হয়েছে। একইভাবে কিলোমিটারপ্রতি ২৪ দশমিক ২৮ মিলিয়ন বা ২ কোটি ৪২ লাখ ৮০ হাজার ডলার খরচ হয়েছে আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ নির্মাণে।

অন্যদিকে ২০১০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে শুরু হওয়া প্রকল্পগুলোর মধ্যে তুলনামূলকভাবে কিলোমিটারপ্রতি নির্মাণ ব্যয় কম হয়েছে দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে। এশিয়ান ট্রান্সপোর্ট আউটলুকের হিসাব অনুযায়ী এ প্রকল্পের প্রতি কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে খরচ হয়েছে ৬ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন বা ৬৪ লাখ ৩০ হাজার ডলার।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীন, ভারত, কম্বোডিয়ার মতো দেশগুলোয় পার্বত্য অঞ্চলের পরিমাণ বেশি। আবার এসব দেশ সাম্প্রতিক সময়ে যেসব রেলপথ গড়ে তুলেছে, সেগুলোয় ট্রেন চলাচলের গতিসীমাও বেশি। বিপরীতে বাংলাদেশের রেলপথ প্রকল্পগুলো তুলনামূলক সমতল অঞ্চলে। আবার সর্বোচ্চ গতিসীমাও কম। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পগুলোর ব্যয় তুলনামূলক কম হলেই তা যুক্তিযুক্ত হতো বলে মনে করছেন তারা।

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌চীনের সবগুলো রেলপথ মোটামুটি ১৫০ থেকে গতি আরম্ভ হয়। তাদের পাহাড়ি এলাকাও বেশি থাকে। সে হিসেবে আমাদের ব্যয় অনেক বেশি। তাছাড়া আমাদের নির্মাণের পদ্ধতিগত ত্রুটিও আছে। আমরা ফিজিবিলিটি স্টাডিকে যেনতেনভাবে করে, সাপোর্ট প্রজেক্ট না করে কাজে নেমে গিয়ে খরচ দ্বিগুণ করে ফেলি।’

বাংলাদেশে নির্মাণ ব্যয় বেশি হওয়ার পেছনে ভূমি অধিগ্রহণ, ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির বিষয়গুলোকে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘‌আমাদের এখানে ভূমি অধিগ্রহণের খরচ বেশি। তার ওপর স্থানীয় উপাদান অনেক কম। সেটা উপকরণ এবং মানবসম্পদ দুই দিক থেকেই। সম্পূর্ণভাবে পরনির্ভরশীল। কখনো নির্ভরতা কমার লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। ভবিষ্যতে হয়তো আমরা আমাদের মানবসম্পদ ব্যবহার করে করব। আমাদের হয়তো নির্মাণসামগ্রীর দুষ্প্রাপ্যতা থাকতে পারে। প্রতিযোগিতামূলকভাবে বাইরে থেকে এনে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে করতে পারলে ফারাকটা এত বেশি হওয়ার কথা হয়। সব মিলিয়ে এ বিষয়ে দর্শনটাকে পরিবর্তন ও পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। মেধা একটি ক্যাপিটাল। এ ক্যাপিটাল আমাদের তৈরি করতে হবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘‌আমি সবচেয়ে বেশি জোর দেব ফিজিবিলিটি স্টাডিতে। এটি যাতে কোনো ফরমালিটিজ না হয়, বরং যাতে একটি দলিল হয়। এ দলিলে যা লেখা থাকবে, তার সামান্য এদিক-সেদিক হতে পারে। কিন্তু দ্বিগুণ খরচ যাতে না হয়।’

যদিও রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন মনে করছেন বাংলাদেশের রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পগুলোর ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়েই রয়েছে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে রেলপথের নির্মাণ ব্যয় বেশি এ কথাটি ভুল। যারা বলছেন, তারা হয়তো এখানে জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের মতো বিষয়গুলো চিন্তা করেন না।’