কোভিড মহামারিতে পর্যটননির্ভর দেশগুলো সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সংক্রমণ এড়াতে সব দেশেই নানা বিধিনিষেধ দেওয়া হয়, যে কারণে আন্তর্জাতিক পর্যটন বাণিজ্যে রীতিমতো ধস নামে। তার প্রভাব এখন হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে। এখন শ্রীলঙ্কা যে সংকটে পড়েছে, তার অন্যতম কারণ কোভিডের সময় পর্যটক কমে যাওয়া। এবার আলোচনা শুরু হয়েছে নেপালের সংকট নিয়ে।
শ্রীলঙ্কার মতো পর্যটন নেপালের বৈদেশিক মুদ্রার সবচেয়ে বড় উৎস। স্বাভাবিকভাবেই গত দুই বছরে নেপালে পর্যটকদের আগমন অনেকটাই কমে গেছে। একই সঙ্গে নেপাল আমদানিনির্ভর দেশ। ওষুধ, জ্বালানিসহ বিভিন্ন ধরনের জরুরি পণ্য আমদানি করতে হয় নেপালকে। এমনকি খাদ্যপণ্যও আমদানি করতে হয় তাকে। এ পরিস্থিতিতে নেপালের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে শুরু করেছে। তবে আশার কথা হলো, শ্রীলঙ্কার মতো বৈদেশিক ঋণের বোঝা নেপালের কাঁধে নেই।
নেপালের পর্যটন বোর্ডের তথ্যানুসারে, করোনার আগে প্রতিবছর নেপালে গড়ে ১২ লাখ পর্যটক ঘুরতে আসতেন। কিন্তু ২০২১ সালে সে দেশে পর্যটক এসেছেন মাত্র ১ দশমিক ৫ লাখ। অর্থাৎ করোনার মধ্যে পর্যটক কমেছে প্রায় ৮৭ শতাংশ। এ ছাড়া গত সাত মাসে প্রবাসী নেপালি নাগরিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় কমেছে ৫ শতাংশ। এর সম্মিলিত ফল হলো রিজার্ভ হ্রাস পাওয়া। গত আট মাসে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে প্রায় ২০০ কোটি ডলার। এখন তাদের হাতে আছে ৯৭৫ কোটি ডলার। এ ডলার দিয়ে আগামী ছয়-সাত মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে।
তার সঙ্গে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো যুক্ত হয়েছে তেলের মূল্যবৃদ্ধি। এতে আমদানি ব্যয় মেটাতে শ্রীলঙ্কার মতোই হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। এ পরিস্থিতিতে গত সপ্তাহে তারা শ্রীলঙ্কার মতোই নিত্যপ্রয়োজনীয় নয়, এমন পণ্যের আমদানি সীমিত করেছে, যেমন গাড়ি, প্রসাধনী, স্বর্ণ ইত্যাদি। তবে আমদানির আগে পূর্ণাঙ্গ বিল পরিশোধ করা সাপেক্ষে আমদানিকারকদের ৫০টি বিলাস দ্রব্য আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
নেপালের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নারায়ণ প্রসাদ পোখারেল বিবিসিকে বলেছেন, ‘পরিস্থিতি ভালো নয়, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপের মুখে আছে। সে জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় নয়, এমন পণ্যের আমদানি সীমিত করা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আমদানি নিষিদ্ধ করিনি, বরং বলা ভালো, আমরা আমদানি নিরুৎসাহিত করছি।’
ব্যাংক খাতের কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণেও নেপালের দুর্গতি বেড়েছে। মহামারির মধ্যে ব্যাংকের আমানত ও ঋণের অনুপাত ৮৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯০ শতাংশ করা হয়।
অর্থাৎ প্রতি ১০০ নেপালি রুপি আমানতের বিপরীতে আগে যেখানে ৮৫ রুপি ঋণ দেওয়া হতো, তা বাড়িয়ে ৯০ রুপি করা হয়। এতে আমানত ও ঋণের ভারসাম্য ব্যাহত হয়। একদিকে ঋণ বাড়তে থাকে, কিন্তু সে তুলনায় বাড়েনি আমানত। এ অবস্থায় আমানত আকর্ষণে ব্যাংকগুলো সুদহার বাড়ায়, কিন্তু আমানতের উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি হয়নি।
সম্ভবত এ কারণে নেপাল সরকার সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মহাপ্রসাদ অধিকারীকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছে। তবে কারণ দর্শানোর প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি সরকার।
কোভিড মোকাবিলায় অন্যান্য দেশের মতো নেপাল সরকারও প্রণোদনা দিয়েছে। ফলে ব্যাংক থেকে ঋণ করতে হয়েছে তাদের। বিবিসির তথ্যানুসারে, নেপাল সরকারের ঋণ এখন মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ৪৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
তবে এত কিছু সত্ত্বেও নেপালের অর্থ মন্ত্রণালয় মনে করছে, নেপালের অর্থনৈতিক অবস্থা ‘স্বাভাবিক’। এক বিবৃতিতে সম্প্রতি তারা বলেছে, ‘আমাদের অর্থনীতিক বাহ্যিক খাতে কিছু চাপ আছে, তাই আমদানি কমাতে ও বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।’
এ বাস্তবতায় শ্রীলঙ্কার সঙ্গে নেপালের তুলনা শুরু হয়েছে। দেশটির অর্থমন্ত্রী জনার্দন শর্মা প্রভাকর বিবিসিকে বলেছেন, ‘এ তুলনায় আমি রীতিমতো ধাক্কা খেয়েছি।’
তবে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, নেপালের অবস্থা শ্রীলঙ্কার চেয়ে অনেকটাই ভালো। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে, তবে এখনো তা সন্তোষজনক ন্যূনতম রিজার্ভের চেয়ে দ্বিগুণ—শ্রীলঙ্কার প্রায় চার গুণ। শ্রীলঙ্কার মতো অত বিদেশি ঋণও তার নেই।
আর শ্রীলঙ্কায় যেখানে মূল্যস্ফীতি ২৫ শতাংশ, নেপালে তা ৭ শতাংশের ঘরে।
তবে চলতি হিসাবের ঘাটতি নিয়ে বিশ্লেষকদের আশঙ্কা আছে। তাঁরা বলছেন, এ ঘাটতি ধীরে ধীরে না কমানো হলে পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। তবে তাঁরা এখনই বড় বিপদ দেখছেন না।
অর্থনীতি নির্দিষ্ট একটি-দুটি খাতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লে যেকোনো সময় বিপদ হতে পারে, কোভিডের অভিঘাতে পর্যটননির্ভর দেশগুলোর যে অবস্থা হলো। তবে কোভিডের অবসান হচ্ছে। পর্যটন খাত আবারও চাঙা হবে। কিন্তু অর্থনীতির বহুমুখীকরণ না হলে হিমালয়কন্যা নেপালের কপালেও দুর্গতি আছে।