নির্বাচন-পরবর্তী বিরোধ মেটাতে সিরিজ বৈঠকে আওয়ামী লীগ

নির্বাচন-পরবর্তী বিরোধ মেটাতে সিরিজ বৈঠকে আওয়ামী লীগ

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের দলীয় ও স্বতন্ত্র এমপিদের এলাকায় অভ্যন্তরীণ বিরোধ তীব্র হয়ে ওঠে। উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তাতে নতুন মাত্রা পায়। দলের এই বিরোধ মেটাতে এখন সিরিজ বৈঠকে বসছে আওয়ামী লীগ। আজ শনিবার থেকে এ বৈঠক শুরু হবে। প্রথম দিনের বৈঠকে অংশ নিতে রংপুর বিভাগের ৯ সাংগঠনিক জেলার নেতারা আজ ঢাকায় আসছেন।

প্রতিটি বৈঠকে সাংগঠনিক নির্দেশনা দেবেন দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি নির্বাচন-পরবর্তী সব সাংগঠনিক বিরোধের নিষ্পত্তির পাশাপাশি মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলোর সম্মেলন আয়োজনের তাগিদ দেবেন বলে জানা গেছে। বর্তমানে ৩৩টি সাংগঠনিক জেলার আওতাধীন ৮৫টি উপজেলায় প্রকট গৃহদাহ সৃষ্টি হয়েছে।

আওয়ামী লীগের কয়েকজন নীতিনির্ধারক নেতা সমকালকে জানিয়েছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি না আসায় ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে সংশয় দেখা দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের উৎসাহ দেওয়া হয়েছিল। তাদের ৫৯ জন নির্বাচনে জয়ও পেয়েছেন। কিন্তু নির্বাচনের পরই বেশির ভাগ স্বতন্ত্র এমপি যে কোনো প্রক্রিয়ায় দলে চালকের অবস্থান নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এ ক্ষেত্রে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ হচ্ছেন গত সংসদের সাবেক এমপি কিংবা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের দলীয় প্রার্থী। ফলে প্রায় প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় স্পষ্ট দুই বলয়ে বিভক্ত হয়েছেন নেতাকর্মী। এ নিয়ে বিভিন্ন স্থানে খুনাখুনির মতো নির্মম ঘটনার পাশাপাশি পরস্পর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, হামলা-মামলা, পাল্টা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে দলীয় এবং স্বতন্ত্র এমপিদের নিয়ে বৈঠক করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি গৃহদাহ ভুলে একসঙ্গে মিলেমিশে সাংগঠনিক কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে তৃণমূল নেতাকর্মীর সঙ্গে বৈঠকের তাগিদ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের।

এর পরই বিভাগ পর্যায়ে সাংগঠনিক বৈঠক আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক। তিনি বলেন, বিভাগীয় সাংগঠনিক বৈঠকের পর দলীয় ও স্বতন্ত্র এমপিদের এলাকায় নেতাকর্মীর মধ্যে কোনো দূরত্ব থাকবে না। দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-বিবাদের রাজনীতিও দূর হবে। তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীর মধ্যে আসবে স্বস্তি।

রংপুর দিয়েই শুরু হবে সিরিজ সাংগঠনিক বৈঠক। এ বিভাগের সাংগঠনিক কার্যক্রম দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী বলেন, শনিবার বেলা ১১টায় দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠেয় বৈঠকে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও রংপুর মহানগরের নেতারা অংশ নেবেন। এ বৈঠকের মাধ্যমে রংপুর বিভাগের সাংগঠনিক বিরোধ মিটিয়ে ফেলা হবে।

রংপুর বিভাগের ৩৩টি সংসদীয় আসনের মধ্যে সাতটিতে জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। তাদের অনেকেই নির্বাচনী এলাকায় দলের ভেতরে আলাদা বলয় তৈরির চেষ্টা করছেন বলে দলীয়ভাবে প্রমাণ পাওয়া গেছে। ফলে দিনাজপুরের বীরগঞ্জ ও কাহারোল; নীলফামারীর জলঢাকা, সৈয়দপুর ও কিশোরগঞ্জ; রংপুরের গঙ্গাচড়া ও মিঠাপুকুর; কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী, রাজারহাট ও সদর; গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ ও সদর উপজেলার নেতাকর্মী বিভক্ত হয়ে আছেন।

চট্টগ্রাম বিভাগের সাংগঠনিক বৈঠক আগামীকাল রোববার বেলা ১১টায় তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ অফিসে অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন এ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, চাঁদপুর, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, বান্দরবান ও চট্টগ্রাম মহানগরের নেতারা এ বৈঠকে অংশ নেবেন।

এ বিভাগের ৫৮টি সংসদীয় আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৯টিতে নির্বাচিত হয়েছেন। এর মধ্যে কুমিল্লায় চারটি ও চট্টগ্রামে তিনটি আসন রয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যেসব আসনে জয় পেয়েছেন, তার প্রায় প্রতিটিতেই দ্বন্দ্ব-বিবাদে জড়িয়ে আছেন দলের নেতাকর্মী। এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল ও আশুগঞ্জ; কুমিল্লার হোমনা, মেঘনা, মুরাদনগর, দেবিদ্বার, বুড়িচং ও ব্রাহ্মণপাড়া; লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও কমলনগর; চট্টগ্রামের বোয়ালখালী, লোহাগাড়া, সাতকানিয়া ও বাঁশখালীর গৃহদাহ প্রকট হয়ে উঠেছে।

আওয়ামী লীগের খুলনা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক বলেছেন, আগামী ৪ এপ্রিল বেলা ১১টায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর, মাগুরা, নড়াইল, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা ও খুলনা মহানগরের নেতাদের বিভাগীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এ বৈঠকের মাধ্যমে বিরাজমান সংকট চিহ্নিত করার পাশাপাশি সংকটের সমাধান করা হবে।

এ বিভাগের ৩৬টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ছয়টিতে জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এর মধ্যে কুষ্টিয়ার চারটি আসনের মধ্যে তিনটিতেই স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছেন। তবে নির্বাচনের পর থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের আসনে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। কুষ্টিয়ার দৌলতপুর, ভেড়ামারা, মিরপুর, কুমারখালী ও খোকসা; ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু, যশোরের মনিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলার নেতাকর্মীর মধ্যে দূরত্ব দেখা দিয়েছে।

এদিকে, দলীয় ও স্বতন্ত্র এমপিদের এলাকায় নেতাকর্মীর মধ্যে সৃষ্ট বিরোধ নিষ্পত্তি করতে রংপুর, চট্টগ্রাম এবং খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক বৈঠকের তারিখ নির্ধারণ করা হলেও সিলেট, ঢাকা, রাজশাহী, বরিশাল ও ময়মনসিংহ বিভাগের বৈঠকের দিনক্ষণ নির্ধারণ করা হয়নি। তবে ঈদুল ফিতরের পর এসব বিভাগের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত দুই কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল-আলম হানিফ ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি।

বর্তমানে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের মধ্যে মির্জা আজম ঢাকা, এস এম কামাল হোসেন রাজশাহী, আহমদ হোসেন সিলেট, অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন বরিশাল ও শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল ময়মনসিংহ বিভাগে বিরাজমান দলের সংকট চিহ্নিতকরণের কার্যক্রম গুছিয়ে আনছেন। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মির্জা আজম বলেন, বিভাগীয় বৈঠকের মাধ্যমে নির্বাচন-পরবর্তী সব সাংগঠনিক বিরোধের নিষ্পত্তি করা হবে। সেই সঙ্গে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলোর সম্মেলন আয়োজনের তাগিদ দেওয়া হবে।

জানা গেছে, ঢাকা, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল ও ময়মনসিংহের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উপজেলায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক বিরোধ তীব্র আকার ধারণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকা বিভাগের কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী ও পাকুন্দিয়া; মানিকগঞ্জের দৌলতপুর, ঘিওর, শিবালয়, সিংগাইর ও হরিরামপুর; মুন্সীগঞ্জের সদর ও গজারিয়া; ঢাকার সাভার; গাজীপুরের কালীগঞ্জ; নরসিংদীর শিবপুর; ফরিদপুরের ভাঙ্গা; চরভদ্রাসন ও সদর; মাদারীপুরের কালকিনি ও সদর; টাঙ্গাইলের ঘাটাইল, কালিহাতী ও সদর; রাজশাহী বিভাগের বগুড়ার আদমদীঘি ও দুপচাঁচিয়া; নওগাঁর মান্দা ও রানীনগর; নাটোরের লালপুর ও বাগাতিপাড়া; সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জের শাল্লা ও দিরাই; সিলেটের কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ; হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ, বাহুবল, মাধবপুর ও চুনারুঘাট; বরিশাল বিভাগের বরগুনা সদর, আমতলী ও তালতলী; বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ ও হিজলা; পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া, ময়মনসিংহ বিভাগের জামালপুরের সরিষাবাড়ী, শেরপুর সদর, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া, মুক্তাগাছা, ফুলবাড়িয়া, ত্রিশাল, ঈশ্বরগঞ্জ ও ভালুকা এবং নেত্রকোনার আটপাড়া ও কেন্দুয়া।

samakal