নির্বাচনে আনতে চাপে রাখার জন্যই পাইকারি হারে সাজা দেওয়া হচ্ছে বিএনপি নেতাদের

27 November 2023
নিজস্ব প্রতিনিধি
নির্বাচন সামনে রেখে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে চাপে রাখতে ফরমায়েশি রায়ের মাধ্যমে পাইকারি হারে কারাদণ্ড দিচ্ছে দলটির সক্রিয় নেতাকর্মীদের। পুরাতন বানোয়াট মামলায় তড়িঘড়ি করে রায় দেওয়া হচ্ছে বিএনপির প্রথম সারি থেকে শুরু করে মাঝারি ও নিম্ন সারির সক্রিয় নেতাদের বিরুদ্ধে।
আদালত সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর-নভেম্বরেই আলাদা ২৭ মামলায় সাজা হয়েছে ৪৪৯ নেতাকর্মীর। ২৩ নভেম্বর বৃহস্পতিবারও পাঁচ মামলার রায় শুনেছেন ১৭৯ জন। সব মিলিয়ে গত ছয় মাসে ৩৩ মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে ৫৮২ জনকে।
যেসব মামলায় সাজা হচ্ছে, সে গুলোর মধ্যে প্রায় সবই হচ্ছে পুলিশের ওপর হামলা, কর্তব্য কাজে বাধা, ককটেল বিস্ফোরণ, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, অগ্নিসংযোগসহ নাশকতার অভিযোগে ২০১৩ থেকে ২০১৮ সালে দায়ের করা। এরকম আরও শতাধিক মামলার রায় যে কোনো সময়ে ঘোষণা হতে পারে। এতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে যুগ্ম মহাসচিব, সম্পাদক, অঙ্গসংগঠনের শীর্ষ নেতা ছাড়াও তৃণমূলের নেতাকর্মী রয়েছেন।
শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে সর্বশেষ সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী, কেউ কোনো মামলায় কমপক্ষে দুই বছরের ‘দণ্ডপ্রাপ্ত’ হলে এবং মুক্তির পাঁচ বছর পার না হলে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ‘অযোগ্য’ হন। দলের আইনজীবীরা বলছেন, নির্বাচনের আগে দলটির ‘যোগ্য’ প্রার্থীদের ‘অযোগ্য’ ঘোষণা করতে এবং চলমান আন্দোলন ব্যাহত করতে টার্গেট করে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে চাচ্ছে সরকার। তবে যেভাবে এবং যে প্রক্রিয়ায় মামলাগুলো চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক, অন্যায় এবং বিচারপ্রার্থীদের ওপর জুলুম। মামলায় আসামিপক্ষের আইনজীবীদের প্রয়োজনীয় সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না।
বিএনপি নেতারা জানান, তৃণমূলের অনেক মামলার রায় ঘোষণার তথ্য তাদের কাছে আসে না। যেসব মামলায় জ্যেষ্ঠ নেতাদের সাজা দেওয়া হচ্ছে, সেসব মামলার তথ্যই বেশি আসে। সে কারণে অনেক মামলার রায়ের তথ্য দলের কাছে নেই।
দলটির নেতাদের অভিযোগ, সরকারবিরোধী আন্দোলন আর নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে থাকা মামলার গতিও বেড়ে গেছে। অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চলমান এসব মামলায় তারা ন্যায্য বিচার পাবেন না। ঘন ঘন তারিখ দিয়ে ওইসব মামলাকে নির্দিষ্ট এজেন্ডা বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
দলীয় সূত্র জানায়, আগে এসব রাজনৈতিক মামলা আইনিভাবে মোকাবিলার চেষ্টা করেছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। প্রতিদিনই এসব মামলায় আদালতে হাজিরা দিয়েছেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছিলেন আদালত চত্বরে। তবে ২৮শে অক্টোবরের পর সেই ছবি বদলে গেছে। ওইদিন ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশে পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের নাশকতার পর ভিন্ন পরিস্থিতি তাদের সামনে আসে। সারাদেশে নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে দিন দিন বাড়ছে নতুন মামলা। গ্রেপ্তারে চলছে সাঁড়াশি অভিযান। দলের দপ্তর শাখা জানিয়েছে, ২৮শে অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে সারাদেশে ৩৮৪ মামলায় ১৫ হাজার ৬০০ নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন।
সারাদেশে বিরোধী নেতাকর্মীর ওপর সরকারের এমন কঠোর মনোভাবের কারণে আদালতে হাজির হওয়ার সাহস পাচ্ছেন না অনেকে। যারা গেছেন, তাদেরই গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে ১৫ই নভেম্বর ব্রেইন টিউমারের অস্ত্রোপচার করা বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য সাইফুল ইসলাম পটু অসুস্থ অবস্থায় ঢাকার নিম্ন আদালতে হাজিরা দিতে গেলে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকেও আদালত চত্বর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বিএনপির সহ-স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক আব্দুল কাদির ভূইয়া জুয়েলের বিরুদ্ধে দেড় শতাধিক মামলা রয়েছে। এর মধ্যে আরও ২৩টি মামলা সাক্ষ্য শেষ পর্যায়ে রয়েছে। তিনি বলেন, কবে কোন মামলায় রায় দেওয়া হচ্ছে, সেটাও জানি না।
বুধবার একটি মামলায় সাজার রায় হয়েছে আবার গতকাল আরেকটি মামলায় সাড়ে তিন বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে। ওই মামলায় তিনি এজাহারভুক্ত ছিলেন না। পুরোনো মামলায় তাঁকে সাজা দেওয়া হলো। মামলাটিতে ২৮শে অক্টোবরের পর একবার হাজিরা না দেওয়ায় পরোয়ানা জারি করেন আদালত।
বিএনপি নেতাদের আইনজীবী সৈয়দ মেজবাহ মো. জয়নুল আবেদীন বলেন, আইনে রয়েছে ফেয়ার ট্রায়াল। সেই সুযোগতো সবাইকে দিতে হবে। দ্রুতগতিতে মামলা চলায় সাক্ষী, জেরার সেই সুযোগ পাচ্ছেন না। নির্দেশনা যখন সাজার দিকে থাকে, তখন ওইসব জেরার গুরুত্বও থাকে না। এতে আইনজীবীরা হতাশ হচ্ছেন, আর বিচার প্রার্থীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ ধারা অব্যাহত থাকলে দেশের জনগণের মধ্যে বিচার বিভাগ নিয়ে বিশ্বাস ও আস্থার সংকট তৈরি হবে। মানুষের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত ও ন্যায় বিচারের স্বার্থে দ্রুত এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার।
সাজা পেয়েছন যেসব কেন্দ্রীয় নেতা:
ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাজাহান (৪ বছর), চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান (১৩ বছর), চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব (৪ বছর), যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল (২ মামলায় সাড়ে ৩ বছর), তথ্যবিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল (২ মামলায় সাড়ে ৩ বছর), স্বেচ্ছাসেবকবিষয়ক সম্পাদক মীর সরাফত আলী সপু (দেড় বছর), সহস্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক আব্দুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল (তিন মামলায় ৬ বছর ৯ মাস), গ্রাম সরকারবিষয়ক সহসম্পাদক বেলাল আহমেদ (৪ বছর), সহপ্রচার সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীম (৪ বছর), নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ রবিউল আলম (আড়াই বছর), হাবিবুর রশিদ (২ বছর), আকরামুল হাসান (২ বছর), যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নিরব (৩ বছর সাত মাস), যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু (সাড়ে ৪ বছর), সাবেক সহসভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর (দুই মামলায় সাড়ে ৯ বছর), স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহসান (২ বছর), যুবদলের সিনিয়র সহসভাপতি মামুন হাসান (সাড়ে তিন বছর), ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকার (৪ মামলায় সাড়ে ১৪ বছর), রংপুর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আনিসুর রহমান লাকু (১০ বছর) ও মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব মাহফুজ উন নবী ডন (১০ বছর), রাজশাহী জেলা বিএনপির সভাপতি আবু সাঈদ চাঁদসহ যুবদল, ছাত্রদল এবং অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনের অনেক নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে।
যাদের বিচার প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে:
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী, বিএনপির বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক সালাহউদ্দিন আহমেদ, সহপ্রচার সম্পাদক আমিরুল ইসলাম আলিম, সহপল্লি উন্নয়নবিষয়ক সম্পাদক বজলুল করিম চৌধুরী আবেদ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনু, যুগ্ম আহ্বায়ক তানভীর আহমেদ রবিন, যুবদলের গোলাম মাওলা শাহীন, কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম বাবুলসহ কয়েক শতাধিক নেতার মামলা প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। যে কোনো সময় তাদের মামলায় রায় ঘোষণা করা হতে পারে।
বৃহস্পতিবার ৫ মামলায় ১৭৯ জনের সাজা:
গত এক সপ্তাহে অন্তত ১২টি মামলার রায় দিয়েছেন নিম্ন আদালত। গতকাল পাঁচটি মামলার রায় দেওয়া হয়। এর মধ্যে ২০১৩ সালের নভেম্বরে উত্তরা পূর্ব থানায় যুবদলের সাবেক সহসভাপতি এস এম জাহাঙ্গীরসহ ৭৫ জনকে আড়াই বছরের সাজা দিয়েছেন ঢাকার অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. হাসিবুল হকের আদালত। গত বুধবার ২০১৩ সালে উত্তরা থানার আরেক মামলায় গত বুধবার এস এম জাহাঙ্গীরসহ ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এম কফিল উদ্দিন আহমেদসহ ১১ জনকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
একই সঙ্গে গতকাল রাজধানীর লালবাগ থানার আলাদা মামলায় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্য মো. নাজিমসহ বিএনপির ৫০ নেতাকর্মীর তিন বছর তিন মাস করে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। পাশাপাশি ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। একই দিন ২০১৫ সালে পল্টন থানার আরেক মামলায় তিতুমীর কলেজ ছাত্রদলের এজিএস আতিকুর রহমান উজ্জ্বলসহ সাতজনকে দুই বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে। একই দিন ২০১৭ সালে পল্টন থানার আরেকটি মামলায় বিএনপির সহস্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক আব্দুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েলসহ ৩৫ নেতাকর্মীকে সাড়ে তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকার কোতোয়ালি থানার একটি মামলায় যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকারসহ ১২ জনকে সাত বছর করে কারাদণ্ড দেন আদালত।
এর আগে গত সোমবার তিন মামলায় সাজার রায় ঘোষণা করা হয়। ২০১৮ সালের অক্টোবরে পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার ঘটনায় রাজধানীর পল্টন থানার মামলায় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল ও যুবদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুসহ ২৫ জনের দুই বছরের সাজার আদেশ দেন আদালত। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে বিএনপির হরতাল-অবরোধ চলাকালে নিউমার্কেট ও নীলক্ষেত এলাকায় পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করার মামলায় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলসহ ১৪ জনকে দেড় বছর করে সাজা দেন আদালত। এর আগে ২০১৮ সালে কামরাঙ্গীচর থানার একটি মামলায় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক এম এ গাফফারসহ ২৪ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে দুই বছরের সাজা দেওয়া হয়।