জাতীয় নির্বাচনের পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটাই স্থিতিশীল। আইএমএফের কাছ থেকে অর্থ না পাওয়ার অনিশ্চয়তাও কেটে গেছে। দেশে ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থাও আগের চেয়ে ভালো। এ অবস্থায়ও দেশের ব্যাংকগুলো থেকে নগদ টাকা তোলার চাপ আরো বেড়েছে। চাপ সামলাতে প্রতিনিয়ত ইস্যুকৃত নোটের পরিমাণ বাড়িয়ে চলছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে অর্থবছরের শুরুতে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছিল। ঘোষিত মুদ্রানীতির প্রধান লক্ষ্যই ছিল বাজারে অর্থের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের শুরু থেকে ক্রমাগতভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইস্যুকৃত নোটের স্থিতি বাড়ছে। জানুয়ারিতে ইস্যুকৃত নোটের স্থিতি ছিল ২ লাখ ৮০ হাজার ৬৩৬ কোটি টাকা। ১৭ এপ্রিল এসে ইস্যুকৃত এ নোটের স্থিতি বেড়ে ৩ লাখ ৫ হাজার ১৯৮ কোটি টাকায় ঠেকেছে। সে হিসাবে শুধু চলতি বছরের সাড়ে তিন মাসেই ছাপানো অর্থের স্থিতি ২৪ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা বেড়েছে। ইস্যুকৃত নোটের মধ্যে ২ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকারও বেশি আছে ব্যাংকের বাইরে।
বাজারে অর্থের প্রবাহ কমাতে চলতি অর্থবছরে নীতি সুদহার (রেপো রেট) কয়েক দফা বাড়িয়ে সাড়ে ৮ শতাংশে উন্নীত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সময়ে ব্যাংক ঋণের সুদহার ৯ থেকে বেড়ে প্রায় ১৫ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহও এখন বেশ স্থবির। আমদানি কমিয়ে আনা হয়েছে সাড়ে ১৫ শতাংশ। শিল্পের উৎপাদন কমে যাওয়ার পাশাপাশি এ সময়ে বাজারে পণ্যের চাহিদারও পতন হয়েছে। এ পরিস্থিতিতেও ইস্যুকৃত নোট বেড়ে যাওয়াকে উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। বিষয়টিকে ব্যাংক খাতের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা বেড়ে যাওয়ার ইঙ্গিতবাহী বলে মনে করছেন তারা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, আস্থাহীনতার কারণে কিছু গ্রাহক আমানত তুলে নিচ্ছেন, এটি সত্য। তবে ইস্যুকৃত নোটের স্থিতি বাড়ার অন্য অনেক কারণও রয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর একাধিক কর্মকর্তা জানান, এপ্রিলের ১১ তারিখ ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়। ঈদ ও রমজানকে কেন্দ্র করে বাজারে নগদ অর্থের প্রয়োজন বেশি থাকে। আবার ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপের কারণেও নগদ টাকার চাহিদা বাড়ছে।
অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘কোনো দেশে দুর্নীতি বাড়লে সেখানে নগদ অর্থের প্রয়োজনীয়তাও বাড়ে। বাংলাদেশের সব ক্ষেত্রেই ঘুস, দুর্নীতিসহ কালো টাকার দৌরাত্ম্য বাড়ছে। এ কারণে এখানে নগদ অর্থের চাহিদা কমছে না। সরকারি কর্মচারী, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীসহ প্রভাবশালীরা নগদ অর্থই ঘরে স্তূপ করে রাখছেন। তারা নগদ টাকা দিয়েই কোটি কোটি টাকার লেনদেন করছেন।’
এ অর্থনীতিবিদ জানান, ‘সারা বিশ্বেই আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ায় নগদ অর্থের চাহিদা কমে আসছে। কিন্তু আমাদের দেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও ব্যাংক খাতের ব্যাপ্তি অনেক বড় হলেও নগদ টাকার চাহিদা কমছে না। এটি অর্থনীতির আনুষ্ঠানিক খাতের ব্যর্থতা। বিশ্বব্যাপী মানুষ এখন কার্ড কিংবা প্লাস্টিক মানিতে লেনদেন করছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও মানুষ বাজার-সদাই করার ক্ষেত্রে “পেটিএম” ব্যবহার করছে। কিন্তু আমাদের দেশে এখনো সেটি হয়নি। দেশের বড় পাইকারি বাজারগুলোয় এখনো নগদ লেনদেন হয়।’
চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি দেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গত বছরের অক্টোবর থেকেই বাজারে নগদ অর্থের চাহিদা বাড়তে থাকে। এক্ষেত্রে কিছু ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকদের আস্থার ঘাটতি সৃষ্টির প্রভাবও ছিল। তবে সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা ছিল, জাতীয় নির্বাচনের পর নগদ টাকার প্রবাহ কমে আসবে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছর ব্যাংক থেকে নগদ টাকা উত্তোলন না কমে উল্টো আরো বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইস্যুকৃত নোটের স্থিতি ছিল ২ লাখ ৭৭ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারিতে এসে নগদ নোটের স্থিতি বেড়ে ২ লাখ ৮০ হাজার ৬৩৬ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। এরপর ফেব্রুয়ারিতে তা আরো বেড়ে ২ লাখ ৮২ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। মার্চে ইস্যুকৃত নোটের স্থিতি দাঁড়ায় ২ লাখ ৯১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, গত ১৭ এপ্রিল ইস্যুকৃত নোটের স্থিতি বেড়ে ৩ লাখ ৫ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা ছাড়ায়। সে হিসাবে শুধু চলতি বছরেই ছাপানো নোটের স্থিতি বেড়েছে ২৪ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা।
যদিও চলতি অর্থবছরের শুরুতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রধান লক্ষ্য নির্ধারণ করে মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বাজারে অর্থের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য নীতি সুদহার (রেপো রেট) বাড়ানো হয়। তুলে নেয়া হয় ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশের সীমাও। এরপর দেশে ব্যাংক ঋণের সুদহার ক্রমাগত বাড়ছে। গত এপ্রিলে এসে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশে। এরপর চলতি মাসে এসে ঋণের সুদহার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। এতে দেশের অনেক ব্যাংকই ঋণের সুদহার ১৫ শতাংশ পর্যন্ত উন্নীত করেছে। সরকারি ট্রেজারি বিলের সুদহারও এখন ১২ শতাংশের বেশি। আর কয়েক দফায় নীতি সুদহার বাড়িয়ে সাড়ে ৮ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এতসব উদ্যোগের প্রভাব নগদ অর্থপ্রবাহের লাগাম টেনে ধরতে পারেনি। আর মূল্যস্ফীতির হারও নিয়ন্ত্রণে আসেনি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ এপ্রিলেও দেশে মূল্যস্ফীতির গড় হার ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এ নিয়ে টানা ২৩ মাস ধরে দেশের মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। যদিও অর্থনীতিবিদদের দাবি, দেশের প্রকৃত মূল্যস্ফীতির হার বিবিএসের তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি।
এত পরিমাণ নগদ টাকা ব্যাংকের বাইরে রেখে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকোচনমূলক যে মুদ্রানীতির কথা বলছে, সেটি ব্যর্থ হয়েছে। কারণ একশ্রেণীর মানুষ নগদ টাকার বস্তা নিয়ে বসে আছে। দেশের অর্থনীতির অর্ধেকের বেশি এখনো ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এ অবস্থায় সুদহার বাড়িয়ে কিংবা সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে এখানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।’
সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কালো টাকার দৌরাত্ম্য প্রতিনিয়ত বাড়ছে। জাতীয় নির্বাচনের পর ঘুস, দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি আরো বিস্তৃত হয়েছে। এ কারণে নগদ অর্থের প্রয়োজনীয়তা বাড়বে, এটিই স্বাভাবিক।’
একটি দেশের অর্থনীতিতে কী পরিমাণ ইস্যুকৃত নোট থাকবে সেটির একটি আদর্শ অনুপাত রয়েছে। ২০২০ সালের আগেও বাংলাদেশ ব্যাংকের ইস্যুকৃত নগদ অর্থের পরিমাণ ছিল ব্যাপক মুদ্রার (ব্রড মানি) সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ। পরবর্তী সময়ে কভিডসৃষ্ট দুর্যোগের মধ্যে এ অনুপাত কিছুটা বেড়ে যায়। তার পরও ২০২১ সালের জুনে ব্যাংকের বাইরে ছিল ব্যাপক মুদ্রার সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ৪২ শতাংশ। ২০২২ সালেও এটি ১৩ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু গত বছরের জুনে এ অনুপাত ১৬ দশমিক ৫২ শতাংশ পর্যন্ত উঠে যায়। ডিসেম্বরে এসে এটি কিছুটা কমলেও তা প্রায় ১৫ শতাংশ রয়েছে। অর্থনীতিবিদদের ভাষ্য হলো প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটায় বর্তমানে এ অনুপাত সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক যদিও বলছেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে সমর্থন করতেই ইস্যুকৃত নোট বাড়ানো হচ্ছে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হলেও অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে হবে। এজন্য প্রয়োজন অনুযায়ী নোট ইস্যু করা হচ্ছে। ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি এখন বেশ ভালো। নীতি সুদহার বাড়ানোর পরিপ্রেক্ষিতে আমানতের সুদহারও বাড়ছে। এ কারণে মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখতে উৎসাহিত হচ্ছে। ইস্যুকৃত নোট বাড়লেও সেটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের মোট ইস্যুকৃত ছাপানো টাকার ৯২ শতাংশই উচ্চ মূল্যের তথা ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট। গত জুনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইস্যুকৃত ৫০০ টাকার নোট ছিল ২৩৫ কোটি ৯২ লাখ ৬৯ হাজার ৯১৬টি। এসব নোটের মূল্যমান ছিল ১ লাখ ১৭ হাজার ৯৬৩ কোটি ৪৯ লাখ ৫৮ হাজার টাকা, যা মোট ইস্যুকৃত অর্থের ৩৮ শতাংশ। আর বাজারে ১০০০ টাকার নোট ছিল ১৬৮ কোটি ৬ লাখ ৭৯ হাজার ৬২৬টি, যার মূল্যমান ১ লাখ ৬৮ হাজার ৬৭ কোটি ৯৬ লাখ ২৬ হাজার টাকা। অর্থাৎ বাজারে ইস্যুকৃত অর্থের ৫৪ শতাংশেরও বেশি ছিল ১০০০ টাকার নোট। সব মিলিয়ে গত জুনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইস্যুকৃত ছাপানো টাকার পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ১০ হাজার ১৫৬ কোটি।
ব্যাংক নির্বাহীরা বলছেন, বাজারে উচ্চ মূল্যের নোট সহজলভ্য হয়ে যাওয়ায় মানুষের মধ্যে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ঘরে রাখার প্রবণতা বাড়ছে। আবার ঘুস-দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থও কালো টাকা হিসেবে সিন্দুকে চলে যাচ্ছে। হুন্ডিসহ অবৈধ অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রেও ১০০০ টাকার নোটই বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। চাহিদা বাড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকও উচ্চ মূল্যের নোট বেশি ইস্যু করছে। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে ছায়া অর্থনীতি (শ্যাডো ইকোনমি) মূল অর্থনীতির চেয়েও হয়ে উঠছে শক্তিশালী।
ব্যাংকে এখন উচ্চ মূল্যের নোটের চাহিদা অনেক বেশি বলে জানান অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এ শীর্ষ নির্বাহী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘উচ্চ মূল্যের নোট সংরক্ষণ ও পরিবহন সহজ। এ কারণে বেশি অর্থ তুলতে এসে গ্রাহকরা ১০০০ টাকার নোট চাইছে। হাজার টাকার নোট সংরক্ষণ করতে জায়গা কম লাগে। মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ঘরে রাখার জন্য উচ্চ মূল্যের নোটই বেশি ব্যবহার করছে। দেশে ব্যাংক খাতের মোট তারল্যের তুলনায় নগদ অর্থ বেশি। উচ্চ মূল্যের নোট এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখা যেতে পারে।’
Bonik Barta