অনেকটাই নির্জীব হয়ে আছে ১৪ দল। সংসদের ভোটের পর কোনো কর্মসূচিতে নেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটটি। ভোটের চার মাস পার হলেও ডাকা হয়নি কোনো বৈঠক, নেওয়া হয়নি শরিক দলের নেতাদের মনের দুঃখ নিবারণের প্রয়াস। এমনকি নির্বাচনে শরিক দলগুলোর ভরাডুবি ও উদ্ভূত পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে শরিকদের দাবিও আমলে নেওয়া হয়নি।
এ পটভূমিতে ১৪ দলকে চাঙ্গা করতে জোটের শীর্ষ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকে তাকিয়ে আছেন হতাশ ও ক্ষুব্ধ শরিক দলের নেতারা। দ্রুত সময়ের মধ্যে জোটের শীর্ষ নেতার সঙ্গে বৈঠক চাচ্ছেন তারা। নেতারা বলছেন, জোট নেতার সঙ্গে বসার সুযোগ পেলে তারা নিজেদের কথা তুলে ধরতে পারতেন। নিশ্চয়ই মান-অভিমান ভুলে সেখান থেকে ১৪ দলকে আবার গতিশীল করার পদক্ষেপ আসত।
যদিও সর্বশেষ ২ মে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে কিছুটা আশার আলো দেখছেন শরিক নেতারা। যেখানে ১৪ দলীয় জোটের নিষ্ক্রিয়তা-সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগ সভাপতি শিগগিরই ১৪ দলের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন বলে জানিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন, ‘১৪ দল তো অবশ্যই আছে। তাদের সঙ্গে আমাদের সব সময় যোগাযোগও আছে। জোটের সমন্বয়কারী আমির হোসেন আমুর ওপরই দায়িত্ব দেওয়া আছে। তিনিই দলের পক্ষ থেকে যোগাযোগ রাখেন।’
তবে প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পর এখন পর্যন্ত বৈঠক বিষয়ে তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন শরিক দলের নেতারা। কয়েকজন নেতা অবশ্য বলেছেন, ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু সম্প্রতি চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে গেল শনিবার দেশে ফিরেছেন তিনি। পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার পর ১৪ দলের সমন্বয়ক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের দিনক্ষণ ঠিক করার উদ্যোগ নেবেন বলে আশা তাদের।
শরিক দলের কয়েকজন নেতা বলেছেন, ২০০৫ সালে ১৪ দল প্রতিষ্ঠার পর থেকে বারবারই জোটের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতি হোঁচট খেয়েছে। তবে এবারের সংসদ নির্বাচনের পর জোটে যে পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে, সেটি রীতিমতো হতাশাজনক। একরকম উদ্দেশ্যহীন গন্তব্যে চলা জোটটি বর্তমানে রীতিমতো বিপর্যয়ের মুখে, অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে।
জানা গেছে, সংসদ নির্বাচন ও সরকার গঠনের চার মাসের বেশি সময় পার হলেও শরিকদের নিয়ে আলোচনার উদ্যোগ নেয়নি আওয়ামী লীগ। ফলে সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে শরিক দলগুলো তাদের বক্তব্য ও ক্ষোভের কথা তুলে ধরার সুযোগও পায়নি। উল্টো নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে শরিকদের প্রতি আওয়ামী লীগের ‘অবমূল্যায়ন’ আরও বেড়ে যাওয়ায় পারস্পরিক অবিশ্বাস ও আস্থার সংকট বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতে ১৪ দলের অস্তিত্ব থাকবে কিনা, তা নিয়েই শঙ্কায় পড়েছেন শরিক দলগুলোর নেতারা।
এদিকে, নির্বাচন শেষে আওয়ামী লীগ আবারও শান্তি ও উন্নয়ন কর্মসূচি নিয়ে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় থাকলেও সেখানে ১৪ দল শরিকদের অংশগ্রহণ নেই। নির্বাচনের আগে থেকে আন্দোলনের নামে সম্ভাব্য সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য ঠেকাতে বিএনপির কর্মসূচির দিনটিতেই এই শান্তি সমাবেশের কর্মসূচি পালন করে আসছে। তবে নির্বাচনের আগে ১৪ দলের ব্যানারে ও শরিকদের নিয়ে এ কর্মসূচি পালিত হলেও ভোটের পর জোটকে একসঙ্গে মাঠে নামানোর উদ্যোগই নেয়নি আওয়ামী লীগ। এটিকেও এক ধরনের ‘অবমূল্যায়ন’ ও ‘অবহেলা’ বলে মনে করছেন শরিক নেতারা।
অবশ্য ১৪ দলীয় জোটের এমন বিপর্যয়কর পরিস্থিতির শুরু গত ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের আগে থেকেই। ওই নির্বাচনে আসন সমঝোতা নিয়ে শরিকদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ দানা বাঁধে। সে সময় জোটের তিন শরিক দলকে মাত্র ছয়টি আসনে নৌকা প্রতীকে ছাড় দেওয়া হয়। এর মধ্যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) তিনটি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি দুটি ও জাতীয় পার্টি (জেপি) একটি আসনে ছাড় পায়। এর মধ্যে তিনটিতেই আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে ধরাশায়ী হন শরিক দলের প্রার্থীরা। হেরে বসেন শরিক দলের চার শীর্ষ নেতা জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সহসভাপতি মোশাররফ হোসেন এবং ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা। অবশ্য ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য এ কে এম রেজাউল করিম অল্প ভোটের ব্যবধানে জিতে ‘মুখ রক্ষা’ করেন।
২০০৮ সালের পর কোনো সংসদ নির্বাচনে এবারের মতো এত কম আসন পায়নি শরিকরা। আগের তিনটি নির্বাচনে জোট শরিকরা আওয়ামী লীগের কাছে ১২ থেকে ১৬টি আসনে ছাড় পেয়ে গড়পড়তায় ছয়-সাতটি আসনে জিতেছিল। এবার অর্ধেকের কম আসনে ছাড় ও জয় পেলেও বাধ্য হয়ে পরিস্থিতি মেনে নেওয়া ছাড়া কিছু করার ছিল না। যদিও নির্বাচনের আগে বারবার আবেদন-নিবেদনের পরও সমঝোতার আসনসংখ্যা বাড়ানো হয়নি। ছাড় পাওয়া আসন থেকে দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সরিয়ে নিতে সম্মতও হননি আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ হাসিনা। ফলে ভোটের রাজনীতিতে ‘দুর্বল’ অবস্থানে থাকা শরিক প্রার্থীরা হেরেছেন। এর পরও শরিক দলগুলোর প্রত্যাশা ছিল, সরকার গঠনের সময় শরিক দলের দু-এক নেতাকে এবার অন্তত মন্ত্রিপরিষদে ঠাঁই দেওয়া হবে। সেই প্রত্যাশার ফানুসও ফুটো হয়ে যায়।
তবে নির্বাচন শেষে শরিক দলগুলোর একমাত্র প্রাপ্তি সংরক্ষিত মহিলা আসনের একটি এমপি পদ। আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ১৪ দল শরিক গণতন্ত্রী পার্টির একাংশের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কানন আরা এরই মধ্যে সংরক্ষিত মহিলা এমপি হয়েছেন। যদিও আরও কয়েকটি সংরক্ষিত মহিলা আসনের প্রত্যাশাও ছিল শরিক দলের। এ জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে চেষ্টাও চালান নেতারা। এ ছাড়া সংরক্ষিত মহিলা আসনের নির্বাচন শেষ হওয়ার পর মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণের সময় দু-একটি মন্ত্রিত্ব পাওয়ার আশাও পূরণ হয়নি শরিকদের।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২০০৫ সালের ১৫ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে ১৪ দল গঠন হয়। দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আন্দোলনসহ ২৩ দফা কর্মসূচিকে প্রাধান্য দিয়ে এই জোটের যাত্রা শুরু। একসঙ্গে আন্দোলন, নির্বাচন ও সরকার গঠনের অঙ্গীকারও ছিল এই জোটের। তবে ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত আওয়ামী লীগসহ মহাজোট সরকারে জোট শরিকদের কয়েকটি মন্ত্রিত্ব দেওয়া হলেও ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে আওয়ামী লীগ অনেকটাই ‘একলা চলো’ নীতিতে চলছে। ফলে ২০১৯ সালে তৃতীয় দফায় গঠিত সরকারের পর এবার চতুর্থ মেয়াদের সরকারের মন্ত্রিপরিষদেও শরিক দলের কোনো নেতার ঠাঁই হয়নি।
জানতে চাইলে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন সমকালকে বলেন, আসলে আওয়ামী লীগই ১৪ দলকে অকার্যকর করে রেখেছে। কাজেই ১৪ দলের ভবিষ্যৎ কী, সেটি নির্ভর করছে এই জোটকে নিয়ে আওয়ামী লীগ কী সিদ্ধান্ত নেবে– তার ওপর। তিনি বলেন, জোটের বর্তমান সংকটের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ১৪ দল নেতাদের বৈঠক হওয়া বা না হওয়ার বিষয় নয়। এটি জোটের সামগ্রিক সংকটের বিষয়। জোটকে কার্যকর করার মাধ্যমেই এ সংকটের নিরসন হতে পারে।
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, সার্বিক বিষয় নিয়ে ১৪ দলের বৈঠক ছাড়াও জোটের প্রধান শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের প্রত্যাশা করছি আমরা। এগুলো যত দ্রুত হয়, ততই মঙ্গল। তিনি বলেন, ১৪ দলীয় জোটের প্রাসঙ্গিকতা ও গুরুত্ব এখনও আছে। কেননা, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার যে উদ্দেশ্যে ১৪ দল গঠন করা হয়েছিল, এর কিছু কাজ হলেও এখনও অনেকটা বাকি আছে। তবে এই জোট সক্রিয় থাকবে কি থাকবে না, এর পুরোটাই নির্ভর করছে আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রমের ওপর।
সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেন, ১৪ দলের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগ যদি এই জোটের গুরুত্ব বুঝতে পারে, তাহলে এটি সক্রিয় হবে। বুঝতে না পারলে ১৪ দল এখন যেভাবে আছে, সেভাবেই থাকবে।
সার্বিক বিষয়ে কথা বলতে ১৪ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র এবং আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমুকে কয়েকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি ধরেননি। তবে অতিসম্প্রতি সমকালকে আমু বলেছিলেন, ১৪ দলীয় জোটের নেতারা আগে নেত্রীর (শেখ হাসিনা) সঙ্গে বসবেন। এর পর আমরা নিজেরা বসে পরবর্তী কার্যক্রম ঠিক করব। সে জন্যই আমরা অপেক্ষায় রয়েছি, কবে নেত্রী আমাদের বৈঠকের জন্য ডাকেন। তিনি বলেন, ১৪ দল কার্যকরই আছে। জোটের প্রতিটি শরিক দলের নেতাদের সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে, কথাবার্তাও হয়।
samakal