নিরাপদ গন্তব্যের খোঁজে বাংলাদেশের অর্থ পাচারকারীরা

bonikbarta.net

নতুন গন্তব্য হিসেবে সামনে আসছে মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব ইউরোপ

সাইফুল ইসলাম বাপ্পী

এ বিষয়ে আর্থিক খাতে পর্যবেক্ষণকারীদের বক্তব্য হলো এসব দেশে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব তুলনামূলক কম। আবার পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর আর্থিক খাতের অপরাধ শনাক্ত বা নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতাও বিভিন্ন সময়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ডাবলিনভিত্তিক আর্থিক অপরাধ পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা এএমএল ইন্টেলিজেন্সের ভাষ্যমতে, ইউরোপ মহাদেশের অবৈধ অর্থ স্থানান্তরের অন্যতম প্রধান করিডোর হিসেবে পূর্ব ইউরোপীয় অঞ্চলের নাম বারবার সামনে এসেছে। বিভিন্ন সময় নানামাত্রার আর্থিক অপরাধের তথ্য উদ্ঘাটন এ অঞ্চলে অর্থ পাচারের সমস্যার মাত্রাকে সামনে নিয়ে এসেছে।

পানামা ও প্যান্ডোরা পেপার্সের মতো ফাঁস হওয়া নানা নথিপত্রে জটিল করপোরেট কাঠামোকে কাজে লাগিয়ে অফশোর বিনিয়োগের নামে অবৈধ অর্থ পাচারের তথ্য এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলেছে। এছাড়া ট্রেড ইনভয়েসিং জালিয়াতি, ফ্রি ট্রেড জোন ও বৈদেশিক বাণিজ্য, ভুয়া ফাউন্ডেশন, প্রপার্টি খাতে বিনিয়োগ, বেসরকারি বিনিয়োগ তহবিলসহ নানা পন্থায় অর্থ পাচার ঘটে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও দুর্নীতি দমন সংস্থাগুলো হুন্ডিকে চিহ্নিত করেছে অর্থ পাচারের বড় উপায় হিসেবে। জাতিসংঘের কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আঙ্কটাড) ভাষ্যমতে, মোটাদাগে অর্থ পাচারের উৎস মূলত তিনটি। দুর্নীতি, অপরাধমূলক কার্যক্রম ও করপোরেট কর ফাঁকি। এর মধ্যে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির আওতাধীন মোট অর্থের পরিমাণ থাকে সার্বিক বৈশ্বিক জিডিপির ৫ শতাংশ। ২০২০ সালের বৈশ্বিক জিডিপির হিসাব (১০৩ ট্রিলিয়ন) আমলে নিলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় অন্তত ৫ ট্রিলিয়ন (৫ লাখ কোটি) ডলারেরও বেশি। এছাড়া সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক অপরাধের মাধ্যমে প্রতি বছর জড়োকৃত অর্থের পরিমাণ ২ ট্রিলিয়ন (২ লাখ কোটি ডলার)। এছাড়া প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী করফাঁকির সঙ্গে জড়িত অর্থের পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি ডলার। এ অর্থের বড় একটি অংশ লেনদেন হচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা পাচারকারীদের হাত ধরে।

ইউরোপে এ অর্থ পাচারের বড় করিডোর হিসেবে দেখা হয় মহাদেশটির পূর্বাঞ্চলকে। এএমএল ইন্টেলিজেন্সের পর্যবেক্ষণ হলো ইইউ এবং ইইউবহির্ভূত অঞ্চল থেকে আসা অবৈধ অর্থ স্থানান্তরের জন্য মুদ্রা পাচারকারী নেটওয়ার্ক ও সংগঠিত অপরাধী চক্র পূর্ব ইউরোপজুড়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এক জটিল জাল বিছিয়ে রেখেছে। অপরাধমূলক কার্যক্রম শনাক্ত বা উদ্ঘাটনে নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বলতার সুযোগে তাদের এসব উদ্যোগ প্রায়ই বৈধতা পেয়ে থাকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত মুদ্রার নিরাপদ গন্তব্য হিসেবে জড়িতরা এখন আর্থিক খাতের সুশাসন ব্যবস্থা অপেক্ষাকৃত দুর্বল, এমন স্থানকে বেছে নিচ্ছে। সে হিসেবে এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও সুইজারল্যান্ডসহ পশ্চিমা দেশগুলো থেকে সরিয়ে নেয়া অর্থের গন্তব্য হিসেবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থানগুলোর একটি হয়ে উঠেছে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো। আবার সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) দুবাইয়ে বিপুল পরিমাণ বাংলাদেশী বিনিয়োগ স্থানান্তরের তথ্য সামনে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সুইস ব্যাংকগুলোয় এখন আর আগের মতো ঢালাওভাবে অর্থ রাখা যাচ্ছে না। এখন তারা কোন দেশ থেকে কী পরিমাণ অর্থ আসছে তা প্রকাশ করা শুরু করেছে। পাচারকারীরা আশঙ্কা করছেন, ভবিষ্যতে সুইস ব্যাংক হয়তো গ্রাহকের নামও প্রকাশ শুরু করবে। অন্যদিকে ইউরোপ-আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কও এখন ভালো যাচ্ছে না। এ কারণে পাচারকারীরা সুইস ও পশ্চিমা দেশগুলো থেকে যেসব দেশে ব্যাংক খাত বা সুশাসন ব্যবস্থা অপেক্ষাকৃত দুর্বল, সেসব দেশে অর্থ স্থানান্তর করছে। বর্তমান প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব হবে যেকোনো উপায়ে হুন্ডির লাগাম টেনে ধরা ও দেশে অর্থ পাচার ঠেকানো। একই সঙ্গে বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটকেও (বিএফআইইউ) শক্তিশালী করার পাশাপাশি স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে।’

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ৯ হাজার কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে। ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে পাচার হয়েছে ৬৪০ কোটি ডলার। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে এ গড় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮২৭ কোটি ডলার। ২০১৯ থেকে এ পর্যন্ত এ গড়ের পরিমাণ আরো বাড়তে পারে।

বারবুডা, কেম্যান আইল্যান্ডের মতো অফশোর বিনিয়োগের স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত দ্বীপদেশগুলোয়ও বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশীদের বিনিয়োগের তথ্য শুনতে পাওয়া যায়। অতীতেও পানামা পেপার্স ও প্যান্ডোরা পেপার্স নথিতে অফশোর বিনিয়োগে সহায়তা কোম্পানির সহযোগিতায় এমন কিছু দেশে বিনিয়োগ করা বাংলাদেশীর তথ্য উঠে এসেছিল। আবার সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, হংকংয়ের মতো মধ্যপ্রাচ্য ও দূরপ্রাচ্যের (এশিয়ার সবচেয়ে পূর্বের দেশগুলো) দেশগুলোয়ও নতুন করে পুঁজি পাচার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। এসব দেশে বাংলাদেশীদের বিনিয়োগের বিষয়টিকে আরো সতর্কভাবে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা। দেশগুলোয় এরই মধ্যে দ্বিতীয় নিবাস গড়ছেন বহু বাংলাদেশী। এ তালিকায় রাজনীতিবিদ, ব্যাংক-ইন্স্যুরেন্সের মালিক, মাঝারি ব্যবসায়ী ও ঠিকাদার যেমন আছেন, তেমনি রয়েছেন দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তারাও।

বাংলাদেশ সরকারের ক্রমবর্ধমান প্রয়াসের কারণেই জড়িতরা পাচারকৃত অর্থ নিরাপদ গন্তব্যে সরিয়ে নেয়ার পথ খুঁজছে বলে মনে করছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্যানেলভুক্ত আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘মাত্র দুই-তিনদিন হলো আমরা সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো থেকে অর্থ সরানোর খবরটি পেয়েছি, যা পাচারকারীদের পলায়নপর মনোবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ। অর্থ সরিয়ে তারা যেখানেই যাক, আমাদের নেটওয়ার্কের বাইরে যেতে পারবে না। আমাদের পদ্ধতি হলো ‘ফলো দ্য মানি, ফলো দ্য ক্রাইম।’ পাচারকৃত টাকা সরিয়ে কোন দেশে নেয়া হচ্ছে সে বিষয়ে আশা করি সুইজারল্যান্ডের কাছ থেকেও তথ্য জানতে পারব।যেখানে টাকা পাচার হওয়ার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে সেসব দেশের সঙ্গেই এ নিয়ে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করতে যাচ্ছে সরকার। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, কানাডা, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশের কথা। অনেকেই বলছেন, সুইস ব্যাংক থেকে বাংলাদেশীরা ডলারসহ বিভিন্ন সংকটের জন্য টাকা উঠিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু টাকা উত্তোলনের পেছনের কারণ হিসেবে এটিকে মনে হচ্ছে না। বরং পাচারকৃত টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশ উঠেপড়ে লেগেছে। দুদক ও সিআইডিও খুব ত্বরিত পদক্ষেপ নিচ্ছে।’

দীর্ঘদিন ধরে দেশে রেমিট্যান্সের বৃহত্তম উৎস ছিল সৌদি আরব। কিন্তু চলতি অর্থবছরে আকস্মিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স আহরণ বেড়ে যায়। মার্কিন সরকারের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে কর্মসংস্থান হওয়া বাংলাদেশীর সংখ্যা ১ লাখ ৫২ হাজার। অন্যদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স এসেছে ৩০৪ কোটি ৭৩ লাখ ৭০ হাজার ডলার। সে অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রত্যেক বাংলাদেশী প্রতি মাসে গড়ে ২ হাজার ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন বাংলাদেশে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশীরা জানিয়েছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে জীবনযাপনের ব্যয় নির্বাহ করে দেশে ২ হাজার ডলার করে পাঠানো সিংহভাগ প্রবাসী বাংলাদেশীর পক্ষে অসম্ভব। আবার বাংলাদেশীদের বড় একটি অংশ সেখানে অবস্থান করছেন মূলত শিক্ষার্থী হিসেবে। তাদের পক্ষেও মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর টিউশন ফি ও বসবাসের খরচ বহন করে দেশে এত বিপুল অংকের অর্থ পাঠানো সম্ভব নয়। বিভিন্ন পর্যবেক্ষক সংস্থা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানও এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা রেমিট্যান্সের প্রবাহ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। কেউ কেউ বিষয়টিতে সন্দেহ প্রকাশ করে দেয়া বক্তব্যে বলেছেন, দেশটি থেকে পাচারকৃত অর্থই এখন রেমিট্যান্স আকারে ফিরিয়ে আনা বা স্থানান্তর করা হচ্ছে।

এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বিধিনিষেধ ও ভিসা নীতি বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কূটনীতিকরাও বলছেন, মার্কিন বিধিনিষেধ বা ভিসা নীতির প্রভাব অনেক সুদূরপ্রসারী। শুধু আওতাধীন বা সংশ্লিষ্টদের পরেই এর প্রভাব সীমাবদ্ধ থাকে না। এ কারণে অর্থ পাচারকারীরাও এখন যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা দেশগুলোয় বিনিয়োগ বা অর্থ গচ্ছিত রাখাকে নিরাপদ বলে মনে করছেন না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যখন বাংলাদেশকে স্যাংশন দিল তখন কিন্তু এর সঙ্গে দেশটির ট্রেজারি বিভাগও জড়িত ছিল। আর ট্রেজারি বিভাগ জড়িত থাকা মানে ভবিষ্যতে আওতাভুক্তরা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোনো আর্থিক লেনদেনেই জড়াতে পারবেন না। এ বিষয়টি প্রত্যক্ষ করে অর্থ পাচারকারীদের মধ্যে অনেকেই সতর্ক হয়ে উঠতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তারা যুক্তরাষ্ট্রকে আর নিরাপদ মনে করতে না-ও পারেন। এখন এসব অর্থ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। আবার ভিসা নীতির ক্ষেত্রেও যদি কোনো বিধিনিষেধ আসে, সে ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ মানে শুধু বিধিনিষেধ না। এর সঙ্গে প্রক্রিয়াগত আরো অনেক বিষয় জড়িত থাকে। সুতরাং আমার মনে হয়, তাদের সে ক্ষেত্রেও আরো সতর্ক হয়ে ওঠার কথা। সব মিলিয়ে তারা আর যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ রাখতে না-ও চাইতে পারেন।’

বরাবরই মার্কিন মিত্র বা প্রভাববলয়ের আওতাভুক্ত পশ্চিমা দেশগুলোকে যুক্তরাষ্ট্র আরোপিত বিধিনিষেধ নীতি অনুসরণ করতে দেখা গেছে। এ বিষয়টিও পাচারকারীদের অর্থ স্থানান্তর সিদ্ধান্তে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এক সময় নিছক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি থাকলেও এখন প্রকাশ্য ও গোপন লগ্নির কেন্দ্র হিসেবে দুবাইয়ের নাম সামনে আসছে বারবার। দেশের অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানই এখন দুবাই থেকে ব্যবসা চালাচ্ছে। আকর্ষণীয় মুনাফার খোঁজে আরব আমিরাতের রিয়েল এস্টেট ছাড়াও অন্যান্য ব্যবসায়ও নাম লেখাচ্ছেন অনেক বাংলাদেশী। দেশটিও এখন যেকোনোভাবে হোক বিদেশ থেকে পুঁজির প্রবাহ বাড়াতে উদ্যোগী হয়ে উঠেছে। এজন্য বিদেশী ধনীদের স্থানান্তরিত হতে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধাও দেয়া হচ্ছে।

কয়েক দশক ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশ্যে-গোপনে বিপুল পরিমাণ মূলধন স্থানান্তরিত হচ্ছে দুবাইয়ে। এ অর্থ পুনর্বিনিয়োগে ফুলেফেঁপে উঠছে দুবাইয়ের আর্থিক, ভূসম্পত্তি, আবাসনসহ (রিয়েল এস্টেট) বিভিন্ন খাত। বিত্তবান বিদেশীদের আকৃষ্ট করতে ২০১৯ সালে গোল্ডেন ভিসা চালু করে ইউএই। এ সুযোগ লুফে নিয়ে ব্যাংক পরিচালক, ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী ও মাঝারি স্তরের কর্মকর্তা, পোশাক ব্যবসায়ী, রেল ও সড়কের সামনের সারির ঠিকাদারসহ দেশের বড় ও মাঝারি অনেক পুঁজিপতিই এখন আমিরাতের গোল্ডেন ভিসা নিয়েছেন। দুবাইয়ের এ গোল্ড কার্ডধারী ব্যবসায়ীদের মাধ্যমেই সেখানে বিপুল অংকের পুঁজি পাচার হয়েছে বলে সন্দেহ সংশ্লিষ্টদের। বর্তমান পরিস্থিতিতে সেখানে আবারো অর্থ পাচার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

আবার গন্তব্য হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত দূরপ্রাচ্যের (এশিয়ার পূর্বতম প্রান্ত) দেশগুলোয়ও বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এক্ষেত্রে বিশেষ করে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও হংকংয়ে বাংলাদেশীদের নতুন বিনিয়োগ নিয়ে নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।

বাংলাদেশ থেকে পরিচালিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অন্যতম বড় হাব সিঙ্গাপুর। বৈশ্বিক আর্থিক গোপনীয়তার সূচকে দেশটির অবস্থান এখন তৃতীয়। এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ এ আর্থিক ও বাণিজ্যিক হাবের সুবিধাগুলোকে কাজে লাগিয়ে সেখানে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। সামনের দিনগুলোয় তা আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, মূলত আমদানি-রফতানি বাণিজ্যই সিঙ্গাপুরে অর্থ পাচারের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। বস্ত্র ও পোশাক খাতের যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য খাতটির অনেক ব্যবসায়ীকে নিয়মিতভাবেই সেখানে আসা-যাওয়া করতে হয়। অভিযোগ রয়েছে, এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তাদের কেউ কেউ সেখানে অর্থ স্থানান্তর করছেন।

মুদ্রা পাচার বন্ধে সরকারের এখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ প্রয়োজন বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘পুঁজি পাচার করলেও কারো নাম জানা যেত না। এ গোপনীয়তাই অর্থ পাচারের জন্য সুইস ব্যাংকের আকর্ষণ বাড়িয়েছিল। এখন প্রযুক্তির উন্নতির ফলে পুঁজি পাচারের অনেক রকম ব্যবস্থা সামনে এসেছে। ফলে পাচারের জন্য সুইস ব্যাংকের দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা নেই। হুন্ডি ব্যবস্থার কারণে বিশ্বের বহু দেশে অতি সহজে পুঁজি পাচার করা যাচ্ছে। এখন সুইস ব্যাংকের চেয়েও অনেক আকর্ষণীয় ব্যবস্থা চালু হয়ে গেছে। আমাদের রেমিট্যান্সে মধ্যপ্রাচ্য আবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এখন সিংহভাগ প্রবাসী হুন্ডি ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশে রেমিট্যান্স পাঠায়। বিদেশী মুদ্রা বিদেশে থেকে যায়। তার সমপরিমাণ অর্থ হুন্ডিওয়ালারা দেশে পৌঁছে দেয়। ফলে হুন্ডি ব্যবস্থা জনপ্রিয় হয়েছে এবং প্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলে আর টাকা আসছে না। দেড় কোটি প্রবাসী দেশের বাইরে আছে, রেমিট্যান্স বাড়ার কথা। কিন্তু কমে গেছে। বিদেশে যে ডলার রয়ে গেছে সেগুলো বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারকারীরা কিনে বিদেশের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করছে। এখানে কোনো রকম ঝুঁকি নেই। এটিকে দমন করতে হলে সরকারকেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।’

সিঙ্গাপুরের মতোই পাচারকৃত অর্থের আরেক আকর্ষণীয় গন্তব্য মালয়েশিয়া। নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বিদেশীদের বিনিয়োগ কোটায় দ্বিতীয় নিবাস গড়ার সুযোগ করে দিচ্ছে দেশটি। বিশেষ করে ‘মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম’ বা এমএম২এইচ প্রোগ্রামের মাধ্যমে দেশটিতে অভিবাসনের জন্য আবেদনের সংখ্যা এখন বাড়ছে। এ কর্মসূচির আওতায় আবেদন করতে হলে আবেদনকারীকে লিকুইড অ্যাসেট বা তরল সম্পদ (নগদ অর্থ, ব্যাংকে জমা বা সহজে নগদায়নযোগ্য বিনিয়োগ) দেখাতে হয় কমপক্ষে ১৫ লাখ রিঙ্গিতের সমপরিমাণ। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী তা ৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকার কিছু বেশি (১ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত = ২৩ টাকা ১৩ পয়সা)। এছাড়া মাসিক আয় দেখাতে হয় অন্তত ৪০ হাজার রিঙ্গিতের সমপরিমাণ (৯ লাখ ২৫ হাজার টাকার কিছু বেশি)। মূলত ধনাঢ্য বিদেশীদের মালয়েশিয়ায় অবস্থানের সুযোগ করে দিতে প্রোগ্রামটি চালু করা হয়েছে বলে দেশটির সরকারি ওয়েবসাইটের তথ্যে উঠে এসেছে।

দেশ থেকে অর্থ পাচার শনাক্ত, এ-সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ ও নজরদারির কাজটি করে থাকে প্রধানত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীন বিএফআইইউ। সংস্থাটির প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাস বলেন, ‘সুইস ব্যাংকে টাকা কমে যাওয়ার পেছনে বিভিন্নমুখী কারণ থাকতে পারে। ডলার সংকটের কারণে দেশের ব্যাংকগুলোর সুইস ব্যাংকের সঙ্গে ব্যবসায়ে ব্যবহৃত নস্ট্রো অ্যাকাউন্টে আমানত কমে এসেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে ইউরোপে বসবাসকারী বাংলাদেশীরা জীবনযাপনে হিমশিম খাচ্ছেন। সুইস ব্যাংকে তাদের জমাকৃত অর্থ এজন্যও কমে আসতে পারে। ক্রেডিট সুইস দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার খবরেও বাংলাদেশীসহ আরো অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে সুইস ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিতে পারেন। আমরা সন্দেহ করছি, যেসব দেশে আর্থিক খাতে সুশাসন কম, সেসব জায়গায় পাচারকৃত অর্থ স্থানান্তর হয়ে থাকতে পারে।’

পাচারকৃত টাকা রেমিট্যান্স হয়ে ফিরছে কিনা সে বিষয়ে জানতে চাইলে মাসুদ বিশ্বাস বলেন, ‘আমাদের কাছে এ-সংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই। আমরা দেখছি ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো থেকে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। বৈধ চ্যানেলে আসা রেমিট্যান্সকে আমরা সব সময়ই স্বাগত জানাই।’

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগও (সিআইডি) বিভিন্ন সময় অর্থ পাচারসংক্রান্ত অপরাধের তদন্ত করে থাকে। অর্থ পাচার প্রতিরোধে সংস্থাটির পদক্ষেপ ও কর্মপদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে সিআইডির মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজাদ রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘হুন্ডি ও অর্থ পাচার প্রতিরোধে আমরা বিএফআইইউর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছি। এজন্য আমাদের মধ্যে নিয়মিতভাবে তথ্যও আদান-প্রদান হয়ে থাকে।’