নিন্মমুখী রিজার্ভ ও ঊর্ধ্বমুখী বিদেশি ঋণ

শেয়ার বিজ :

কয়েক বছর ধরে বিদেশি ঋণ দ্রুত বাড়ছে। বেসরকারি-সরকারি উভয় খাতেই এ ঋণ বেড়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের বিদেশে ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯৯ বিলিয়ন ডলার। মোট ঋণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মাথাপিছু বিদেশি ঋণের পরিমাণও। মাত্র সাত বছরেই তা সোয়া দুই গুণ বা ২২৫ শতাংশ হয়েছে। এছাড়া বিদেশি ঋণের বিপরীতে রিজার্ভের অনুপাত ক্রমেই কমছে।

সূত্রমতে, গত সাত বছরের মধ্যে বর্তমানে রিজার্ভ সবচেয়ে নি¤œ অবস্থায় রয়েছে। অথচ এ সময় বিদেশি ঋণ দ্রুত বেড়েছে। ফলে বিদেশি ঋণের বিপরীতে রিজার্ভে নেমে গেছে দুই-তৃতীয়াংশ। এ অনুপাতটি যতই কমবে বিদেশি ঋণ পরিশোধ ততই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় যাবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে সব মিলিয়ে বিদেশি ঋণের ঝুঁকিপূর্ণ পথের দিকে বাংলাদেশ যাচ্ছে বলেই মত তাদের।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছর দেশে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৪১ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার। পরের অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছর বিদেশি ঋণ প্রথমবারের মতো ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। সে অর্থবছর বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৫৬ দশমিক ০১ বিলিয়ন ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছর তা আরও বেড়ে হয় ৬২ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার ও ২০১৯-২০ অর্থবছর ৬৮ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার।

২০২০-২১ অর্থবছর বিদেশি ঋণ এক লাফে বেড়ে দাঁড়ায় ৮১ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার, ২০২১-২২ অর্থবছর ৯৫ দশমকি ৪৫ বিলিয়ন ডলার ও ২০২২-২৩ অর্থবছর ৯৮ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার। আর সাত বছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় বিদেশি ঋণ সাড়ে ১৫ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ২১ দশমিক ৮০ শতাংশ। এর মধ্যে শেষ তিন বছরে জিডিপির তুলনায় এক শতাংশের বেশি হারে বেড়েছে বিদেশি ঋণ।

এদিকে বিদেশি ঋণ বাড়লেও রিজার্ভ সে অনুপাতে বাড়েনি। বিভিন্ন সময় তা ওঠানামা করেছে। বিশেষত শেষ দুই অর্থবছর ধরে তা দ্রুত কমছে। এতে বিদেশি ঋণের বিপরীতে রিজার্ভ আনুপাতিক হারে কমেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩০ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রিজার্ভ কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৩২ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আরও কমে হয় ৩২ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার। তবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে আবার বেড়ে দাঁড়ায় ৩৬ দশমিক ০৩ বিলিয়ন এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে বেড়ে হয় ৪৬ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার।

এদিকে ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে রিজার্ভ কমতে শুরু করে। ওই অর্থবছর মোট রিজার্ভ কমে ৪১ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এক লাফে ১০ বিলিয়ন ডলার কমে রিজার্ভ ৩১ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।

রিজার্ভের ওঠানামায় বিদেশি ঋণের বিপরীতে এর অনুপাতও হ্রাস/বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছর বিদেশি ঋণের বিপরীতে রিজার্ভের অনুপাত ছিল ৭৩ দশমিক ৭০ শতাংশ। পরের অর্থবছর তা কিছুটা কমে হয় ৭৩ দশমিক ৫০ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছর বিদেশি ঋণ দ্রুত বৃদ্ধি ও রিজার্ভ কমায় এ অনুপাত এক লাফে ৫৮ দশমিক ৮০ শতাংশে নেমে আসে। পরের অর্থবছর তা আরও কমে হয় ৫২ দশমিক ২০ শতাংশ।

২০১৯-২০ অর্থবছর বিদেশি ঋণের বিপরীতে রিজার্ভ সামান্য বেড়ে হয় ৫২ দশমিক ৬০ শতাংশ। রিজার্ভ দ্রুত বাড়ায় পরের অর্থবছর অনুপাতটি আরও বেড়ে হয় ৫৬ দশমিক ৮০ শতাংশ। তবে ২০২১-২২ অর্থবছর রিজার্ভ দ্রুত কমায় বিদেশি ঋণের অনুপাত কমে দাঁড়ায় ৪৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। বিদায়ী অর্থবছর তা আরও কমে হয় ২৪ দশমিক ৮০ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর শেয়ার বিজকে বলেন, গত কয়েক বছরে সরকারি ও বেসরকারি খাতে যে পরিমাণ বিদেশি ঋণ এসেছে সেটি স্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে সরকারি এমন কিছু প্রকল্পে বিদেশি ঋণ নেয়া হয়েছে, যেগুলোর কোনো প্রয়োজন ছিল না। এতে আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে সরকারের বিদেশি ঋণ পরিশোধের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যাবে, যা অর্থনীতিকে চাপে ফেলতে পারে। আর সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের ভয়াবহ সংকট তৈরি হয়েছে, রিজার্ভও কমছে। তাই বিদেশি ঋণ পরিশোধ আগামীতে ডলার ও রিজার্ভের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তখন বিনিময় হারও দ্রুত পরিবর্তন হবে।

তথ্যমতে, বিদেশি ঋণের স্থিতি বাড়ায় মাথাপিছু বিদেশি ঋণও দ্রুত বাড়ছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছর এর পরিমাণ ছিল ২৫৭ দশমিক ৪৭ ডলার। পরের অর্থবছর তা বেড়ে হয় ২৮৩ দশমিক ১৩ ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছর মাথাপিছু বিদেশি ঋণ আরও বেড়ে হয় ৩৪২ দশমিক ১৫ ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছর তা আরও বেড়ে হয় ৩৭৮ দশমিক ২০ ডলার, ২০১৯-২০ অর্থবছর ৪০৯ দশমিক ৫১ ডলার, ২০২০-২১ অর্থবছর ৪৮২ দশমিক ৬৫ ডলার, ২০২১-২২ অর্থবছর ৫৫৭ দশমিক ২৩ ডলার ও ২০২২-২৩ অর্থবছর ৫৭৯ দশমিক ২৮ ডলার।