সদ্য সমাপ্ত উপজেলা নির্বাচনে রাজনৈতিক কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে সংঘাতে জড়িয়েছেন। ফলে চার পর্বের এই উপজেলা নির্বাচনে প্রাণহানি হয়েছে সাতজনের। আহত হয়েছেন প্রায় এক হাজার।
স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনে এবার ছোটখাটো সংঘাত হয়েছে প্রায় সব পর্বেই। তবে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে যশোর, কুষ্টিয়া, কক্সবাজার, গোপালগঞ্জ, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সিরাজগঞ্জে। এই সাত জেলায় হত্যাকাণ্ডের এসব ঘটনায় আসামির সংখ্যা ১৭২। ১৯ জন গ্রেপ্তার হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মূল হোতা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন।
বিরোধী দলবিহীন এ নির্বাচনে ভোটারদের উৎসাহ ছিল না বললেই চলে। উপজেলা নির্বাচনের ইতিহাসে এবার ভোট পড়েছে সবচেয়ে কম।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ২০১৫ সাল থেকে দলীয় প্রতীক দেওয়া শুরু হয়। সেই থেকে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিভেদ প্রকট হতে থাকে। বিরোধী দলগুলো গত ৭ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়াতে নিজ দলের নেতাদের স্বতন্ত্র ভোট করার সুযোগ দেয় আওয়ামী লীগ। এর ফলে আরেক দফা দলীয় কোন্দল বেড়েছে।
বেসরকারি সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) তথ্য অনুসারে, ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোট গ্রহণের এক সপ্তাহ পর পর্যন্ত সহিংসতায় অন্তত ১৫ জন নিহত হয়েছিলেন। আহত হন প্রায় ২ হাজার ২০০ জন। প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য অনুসারে, এবার উপজেলা নির্বাচনের দিন থেকে পরবর্তী ১০ দিনে ভোটকেন্দ্রিক সংঘাতে সাতজন নিহত হয়েছেন। তাঁদের সবাই সরকারি দলের নেতা–কর্মী–সমর্থক।
জাতীয় নির্বাচনের ঠিক চার মাস পর শুরু হয় ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। মাসব্যাপী চলা নির্বাচন শেষ হয়েছে ৯ জুন। বিরোধী দলের বর্জনের কারণে দলীয় মনোনয়ন না দিয়ে প্রার্থিতা উন্মুক্ত করে দেয় আওয়ামী লীগ। ফলে প্রতিটি উপজেলায় দলের একাধিক নেতা একে অপরের বিরুদ্ধে প্রার্থী হন।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, চার ধাপের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল সর্বোচ্চ ৩৭ দশমিক ৫৭ এবং সর্বনিম্ন ৩৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ। গত দেড় দশকে এবারই উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটের হার সবচেয়ে কম।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলছেন, দলীয় বিভেদ এড়াতেই স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তারপরও সংঘাত-প্রাণহানি এড়ানো যায়নি। যা দলের বিভেদ আরও বাড়াতে সহায়তা করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও বলছে, দল দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায়। দলে এমন ধারণা তৈরি হয়েছে যে জনপ্রতিনিধি হলেই এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে রাতারাতি সম্পদের মালিক হওয়া সহজ হবে। এ জন্য অনেকে যেকোনো মূল্যে জেতার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। অভ্যন্তরীণ সংঘাত বৃদ্ধির এটাই বড় কারণ।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সহিংসতা ও প্রাণহানি নতুন নয়। বিএনপিসহ বিরোধীরা নির্বাচনে অংশ নিলেও ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে তাদের সংঘাত হতো।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম দাবি করেন, অন্য সময়ের চেয়ে এবার সংঘাত–প্রাণহানি কম হয়েছে। যা হয়েছে, সেটাও কাম্য নয়।
অভ্যন্তরীণ সংঘাতেই প্রাণহানি
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)–এর হিসাবে, ২০১৮ সাল থেকে গত মার্চ পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ সংঘাতে আওয়ামী লীগের ১৯১ জন মারা গেছেন। তাঁদের কেউ কেউ মারা গেছেন নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে। অনেকে মারা গেছেন নির্বাচনী সহিংসতায়।
এইচআরএসএস–এর তথ্যমতে, গত বছর ৯৩৩টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। নিহত হন ৯৬ জন। আহতের সংখ্যা ৯ হাজার ২৫৮।
আসকের হিসাবে, দেশের নির্বাচনী সহিংসতায় প্রাণহানির শীর্ষে ২০১৬ সাল। ওই বছর ১৭৭ জনের প্রাণহানি ঘটে। প্রায় সবাই মারা যান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সহিংসতায়।
আসামি ধরতে ঢিলেমি
রাজনীতি–সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে রাজনৈতিক সংঘাতের বিচার খুব একটা হয় না। আর যদি ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীরা জড়িত থাকেন, তাহলে বিচার পাওয়া আরও কঠিন হয়ে যায়।
সর্বশেষ ৬ জুন মধ্যরাতে যশোর সদর উপজেলার বাহাদুরপুরে যুবলীগের কর্মী আলী হোসেনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনি সদ্য সমাপ্ত সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী তৌহিদ চাকলাদারের অনুসারী ছিলেন। নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী ফাতেমা আনোয়ারের এক কর্মী নবাব তাঁকে হত্যা করে বলে অভিযোগ পরিবারের। এ ঘটনায় এখনো কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।
নরসিংদীর রায়পুরায় উপজেলা নির্বাচনে প্রচারণার সময় প্রতিপক্ষের হামলায় ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী সুমন মিয়া নিহত হন। হত্যাকাণ্ডের মামলায় প্রধান আসামি করা হয় সুমন মিয়ার প্রতিপক্ষ চশমা প্রতীকের ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী আবিদ হাসানকে। ২৬ জনের নামোল্লেখ করে আরও ৪০-৫০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়। পুলিশ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করলেও মূল আসামি ধরা পড়েননি।
তদন্ত কর্মকর্তা সজীব খান প্রথম আলোকে বলেন, অভিযান চলছে। পলাতক আসামিরা দ্রুতই গ্রেপ্তার হবেন।
নিহত সুমন মিয়ার বাবা নাসির উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, মামলার প্রধান আসামি আবিদ হাসানসহ আসামিরা গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত স্বস্তি নেই। পুলিশ বলছে, চেষ্টা করা হচ্ছে। কতটুকু চেষ্টা আসলে করছে, তারাই বলতে পারবে।
দ্বিতীয় ধাপের ভোটের দিন কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে একটি কেন্দ্রে ভোট গণনার সময় প্রতিপক্ষের হামলায় আহত হন চাপড়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড মৎস্যজীবী লীগের সাধারণ সম্পাদক তরিকুল ইসলাম। ২৬ মে ভোরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। মামলা হলেও এখনো কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
জেলা ডিবির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আসামিদের ধরতে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। আসামিরা হয়তো জেলার বাইরে চলে গেছে।
দ্বিতীয় ধাপে কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলায় ভোট গ্রহণ শেষে বাড়ি ফেরার পথে সফুর আলমকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ১০ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন সফুরের বাবা নুর উদ্দিন। ঈদগাঁও থানার ওসি শুভ রঞ্জন চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, চারজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও অপর ছয় আসামি উচ্চ আদালত থেকে জামিনে মুক্ত আছেন।
গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার চন্দ্রদিঘলিয়া বাজারে গত ১৪ মে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে গুলিতে একজন নিহত হন। নিহত ওসিকুর ভূঁইয়া পরাজিত চেয়ারম্যান প্রার্থী বিএম লিয়াকত আলীর সমর্থক। হামলাকারীরা বিজয়ী প্রার্থী কামরুজ্জামান ভূঁইয়ার সমর্থক। এ ঘটনায় কামরুজ্জামান ভূঁইয়াসহ ২৩ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতনামা ৪০-৫০ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা হয়েছে। চারজন গ্রেপ্তার হলেও মূল অভিযুক্তরা ধরাছোঁয়ার বাইরে।
প্রথম ধাপের ভোটে সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে ফল ঘোষণার পরপর বিজয়ী চেয়ারম্যান প্রার্থী আমিনুল ইসলাম সরকারের সমর্থকদের হামলার শিকার হন পরাজিত চেয়ারম্যান প্রার্থী বদিউজ্জামান ফকিরের স্বজন আবদুল আলিম। পরে তিনি মারা যান। এ ঘটনায় সাতজনকে আসামি করে থানায় মামলা হয়। এখন পর্যন্ত চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
৫ জুন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা নির্বাচনে জয়ী চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের আনন্দমিছিলে প্রকাশ্যে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে ছাত্রলীগ কর্মী আশরাফুল রহমানকে খুন করা হয়। পুলিশ ঘটনার ‘অন্যতম হোতা’ হাসান আল ফারাবী ওরফে জয়কে গ্রেপ্তার করেছে। আসামির বরাত দিয়ে পুলিশ বলছে, সংগঠনের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করায় আশরাফুলকে হত্যা করা হয়।
বিরোধী দলের বর্জনে নিরুত্তাপ এ নির্বাচনে সংঘাত ও হতাহতের ঘটনাগুলো সরকারি দলকেও চিন্তায় ফেলেছে। দলটির নেতাদের কেউ কেউ মনে করছেন, ভোটে বিরোধী দল না থাকায় তৃণমূলে নিজেদের মধ্যে বিভেদ আরও বেড়ে গেছে।
এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনে এখন ভোটারের কাছে কোনো আকর্ষণ নেই। মূল আকর্ষণ প্রার্থীদের। কারণ, এখন জনপ্রতিনিধি হওয়া বা কোনো দলীয় পদ পাওয়া খুবই লাভজনক ব্যবসা। ফলে যেকোনো মূল্যে সবাই জিততে চান। এ জন্য নিজ দল, অন্য দল যে–ই প্রতিপক্ষ হিসেবে, সামনে আসে, ঘায়েল করার চেষ্টা চলে।
prothom alo