২ জুলাই ২০২৩
নিজস্ব প্রতিনিধি
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয় কাজে ব্যবহার করছে সরকার। এতে আওয়ামী সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের দাপটে গোটা জাতি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। আইন শঙ্খলাবাহিনীর সহযোগিতায় দেশকে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত করার ফলে শুধু সাধারণ মানুষ নয়, পুলিশ সদস্যদেরও জীবন যাচ্ছে।
রোববার (২রা জুলাই) নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা এতটাই ভেঙে পড়েছে, প্রতি পদে পদে মানুষের জীবন বিপন্ন। এই ঈদের ছুটিতে প্রায় ৩৫ জন মানুষের জীবনহানি ঘটেছে শুধুমাত্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাফিলতির কারণে। তারা বেপরোয়া চালকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
বিএনপির মুখপাত্র বলেন, ঈদের প্রাক্কালে মানুষ ঘরমুখি হলেও নিজ জেলা বা গ্রামে তারা নিরাপদ ছিল না। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ এদের নানা সহযোগী সংগঠনের সমন্বয়ে জনপদের পর জনপদ গঠিত রক্তাক্ত সন্ত্রাসের পরিকাঠামো এক আতঙ্কের পরিবেশ বিরাজ করছিল। মানুষ বাড়িতে ফিরেও স্বস্তিতে ছিল না। সমাজ, সংস্কৃতি, সভ্য আচরণ আজ বিপন্ন অশুভ রাষ্ট্রশক্তির দৌরাত্বে। আওয়ামী শাসনের তীব্র কষাঘাতে আজ জনগণের জীবন মরণের প্রশ্ন। ওরা হিংসা-প্রতিহিংসার পথে এগোতেই ভালোবাসে।
তিনি বলেন, বর্তমান সামাজিক অবক্ষয় এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, ক্ষমতার আশ্রয়প্রশ্রয়ে গড়ে ওঠা দানবদের আক্রমণে কেউ রেহাই পাচ্ছে না। বিশেষ করে এই সমাজে নারীদের জীবনের যেন কোনো মূল্যই নেই। এমনই এক দুঃসময় চলছে যখন বোনকে উত্যক্ত করার কারণে বিচার চাইতে গিয়ে তরুণ খুন হয়। পিতা-মাতা নিজের মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের কবলে পড়ে জীবন হারায়। প্রতিনিয়ত নিজের বোন বা কন্যা সন্তানের সম্ভ্রম বাঁচাতে গিয়ে নাজেহালসহ জীবন দিতে হয়। জেলায় গড়ে উঠেছে ক্ষমতার ছত্রছায়ায় বখাটেদের উৎপাত। কয়েক বছর আগে বরগুনায় নয়ন বন্ডের কথা আমরা জানি, এবারে ভোলায় শুনছি ‘‘০০৯’’ নামে এক ভয়াল গ্যাংয়ের নাম। এরই মধ্যে এই বিষয়ে সংবাদপত্রে যে কাহিনি ছেপেছে তা লোমহর্ষ। সর্বত্র মানবাধিকার আজ বিপন্ন।
রিজভী বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে শুধু বিরোধী দলের কর্মসূচি বানচাল করা, সহিংস আক্রমণ চালানো, বিরোধী দলের নেতাকর্মী ও স্বাধীন মতপ্রকাশকারীদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেফতার করার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে বলেই আজ সমাজে নৈরাজ্যের অন্ধকার নেমে এসেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দলীয় কাজে ব্যবহার ও নির্বিকার ভূমিকার জন্যই সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের দাপটে গোটা জাতি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
তিনি আরও বলেন, আজ দেশকে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত করার জন্যই শুধু সাধারণ মানুষ নয়, পুলিশ সদস্যদেরও জীবন যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা এতটাই ভেঙে পড়েছে, প্রতি পদে পদে মানুষের জীবন বিপন্ন। এই ঈদের ছুটিতে প্রায় ৩৫ জন মানুষের জীবনহানি ঘটেছে শুধুমাত্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাফিলতির কারণে। তারা বেপরোয়া চালকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
রিজভী বলেন, বর্তমান শাসন ব্যবস্থায় দখলদাররা কর্তৃত্ব করার কারণে চারদিকে গড-ফাদার, মাফিয়া আর সিন্ডিকেট-বাজদের জয়-জয়কার। যদি জনসমর্থিত ও জবাবদিহিমূলক সরকার থাকতো তাহলে বর্তমান খাদ্যপণ্যের এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটতো না। দলীয় লোকদের দিয়ে গঠিত সিন্ডিকেটের প্রতি সরকারের উদার দৃষ্টিভঙ্গির জন্যই আজ জনগোষ্ঠির অধিকাংশ মানুষকে অনাহারে থাকতে হচ্ছে। অস্বাভাবিক দাম দিয়ে ন্যূনতম প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পারছে না।
সরকারের মন্ত্রী ও প্রভাবশালী দলের নেতাদের জড়িত থাকার কারণে সিন্ডিকেট প্রচন্ড শক্তিশালী। যে কারণে ভারতে কাঁচা মরিচের কেজি ২৫ টাকা অথচ কাঁচা মরিচ আমদানির অনুমতি দিলেও সিন্ডিকেটের কারণে বাংলাদেশে তা বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকা কেজি। কোথাও কোথাও ১১০০/১২০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এহেন সিন্ডিকেশন শুধুমাত্র দূর্বৃত্তপরায়ণ অনাচারমূলক সরকার থাকলেই সম্ভব। এরা মানুষের ক্ষুধা নিয়ে তামাশা করে।
বিএনপি নেতা বলেন, শেখ হাসিনার হাতের মুঠোয় রয়েছে ধ্বংসের শক্তি। তার কথায় রয়েছে বিদ্বেষের শক্তি। এরা দেশের রাজনীতিতে জীবনীশক্তি ও সহমর্মিতার শক্তিকে নিঃশেষ করে ঠেলে দিয়েছে এক ব্যর্থ ও সীমাহীন অপচয়ের দিকে। ওরা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন না দিয়ে তৈরি করছে ক্রমবর্ধমান বিনষ্টির পথ। গণতন্ত্রের স্থায়ী নিরাপত্তা ও ঐতিহাসিক সার্থকতার প্রতি তারা বিদ্বেষপরায়ণ।
তিনি বলেন, এজন্য গণতন্ত্রকামী মানুষের কণ্ঠ চাপা দেওয়ার জন্য তারা গত ১৪ বছর ধরে লাখ মানুষকে কারাবন্দি ও অসংখ্য মরদেহ ইতস্তত বিক্ষিপ্ত, কোথাও স্তুপিকৃত করে গণতন্ত্রের পথকে করেছে জনশূন্য। তবে এবারের আন্দোলন হবে আওয়ামী প্রভূত্ববাদের অধীনতা থেকে মুক্তির আন্দোলন। বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং তারেক রহমানের মিথ্যা মামলা ও সাজা প্রত্যাহারের দাবির আন্দোলনে দেশবাসী আজ কঠিন ঐক্যবদ্ধ। এবারের মুক্তি ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার আদায়ের সংগ্রামে হবে ‘স্মরণীয় জয়’।
এ সময় তিনি সারাদেশে আওয়ামী সন্ত্রাসী ও পুলিশ বাহিনীর হামলা ও মামলার বিবরণ তুলে ধরে বলেন, গত ১ জুলাই কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম উপজেলায় বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ঈদ পরবর্তী গণসংযোগকালে অষ্টগ্রাম বাজারে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়।
হামলায় গুরুতর আহত হয় উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন মকুল, পল্লী বিষয়ক সম্পাদক আকছার মিয়া, যুবদল নেতা বাবুল মিয়া, খাইরুল মিয়া, সামাউন মিয়া, হোসেন মিয়া, টুটুল মিয়া, মোসাব্বির মিয়া, সাইফুল মিয়াসহ প্রায় ৩০ জন নেতাকর্মী আহত হয়েছে।
এছাড়াও ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ বিনা কারণে যুবদল কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ-মানবাধিকার সম্পাদক মাহাবুব আলম আক্তার, অষ্টগ্রাম উপজেলার বাঙালপাড়া ইউনিয়ন ১নং ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আলমগীর হোসেন আলমকে গ্রেফতার করেছে। অষ্টগ্রাম থানার ওসি মুর্শিদ জামান, এস আই নিপুণ রায়, কামরুজ্জামান, আসাদুজ্জামান, ইব্রাহিম, এ এস আই বকুল, আওয়ামী লীগ সভাপতি ফজলুল হক হায়দারী বাচ্চু, আইন বিষয়ক সম্পাদক বিপ্লব হায়দারী, আওয়ামী লীগ নেতা ছোয়াব, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা হেলু, ছাত্রলীগের আহ্বায়ক তারিফ, যুগ্ম আহ্বায়ক শামীম, যুগ্ম আহ্বায়ক তানভীরসহ প্রায় ৬০ থেকে ৭০ জন ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ সন্ত্রাসীরা বিএনপি নেতাকর্মীদের গত রাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে হানা দিয়েছে এবং পরিবারের লোকদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছে।
গত পহেলা জুলাই ভোলা জেলার দৌলতখান উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক সঞ্জীব মৃধা ও যুগ্ম আহ্বায়ক হারুনের ওপর দৌলতখান পৌরসভা মেয়রের ছেলে আলোচিত ‘০০৯ (জিরো জিরো নাইন)’ খ্যাত কিশোর গ্যাং আকাশ ও তার দলবল অতর্কিত হামলা চালিয়ে গুরুতর আহত করে। হামলায় গুরুতর আহত হয়ে সঞ্জীব মৃধা ও হারুন বর্তমানে ভোলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছে।
এছাড়াও কুমিল্লা জেলার লাকসাম উপজেলা ছাত্রদল নেতা টিপু সুলতানকে মুদাফ্ফরগঞ্জ দক্ষিণ ইউনিয়নের শ্রীয়াং গ্রামের বাড়ি থেকে ডিবি পুলিশের পরিচয় দিয়ে কয়েকজন তাকে তুলে নিয়ে যায়। গত ২৮ জুন বরিশালের গৌরনদী এলাকায় গৌরনদী পৌরসভার মেয়র মো. হারিছুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ সন্ত্রাসীরা মোটরসাইকেল নিয়ে এলাকায় মহড়া দিয়েছে। মোটরসাইকেলে থাকা সন্ত্রাসীরা গালাগালি করেছে এবং বিএনপি নেতাকর্মীরা যেন পবিত্র ঈদুল আজহার নামাজ পড়তে ঈদগাহে না যেতে পারে সেজন্য হুঁশিয়ারিও দিয়েছে।
গত মঙ্গলবার (২৭শে জুন) কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক তিতুমীর হোসেন সোহেলকে অষ্টগ্রাম বাজার থেকে বিনা পরোয়ানায় পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এছাড়াও বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি ও তাদের পরিবারকে হয়রানি করছে। গত ২১ জুন বিএনপির কেন্দ্রীয় শিল্পবিষয়ক সম্পাদক আবুল কালামের বাড়িতে মধ্যরাতে লাকসাম উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান মহব্বত আলীর নেতৃত্বে যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ হামলা চালিয়ে বাড়িঘর ব্যাপক ভাংচুর করে।
গত ২২শে জুন সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার কুশলিয়া ইউনিয়ন কৃষকদল নেতা আবুল কালাম আজাদকে কুশলিয়া ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি মিঠুসহ ৫ থেকে ৬ জন সন্ত্রাসী হাতুড়ি ও লাঠি দিয়ে গুরুতর আহত করে। ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি মাহবুব মিয়া স্থানীয় বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের নিয়ে গত ২৩ জুন কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়নে গেলে স্থানীয় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা রামদা, কুড়াল, ছোড়া ও লাঠিসোঠা নিয়ে তাদের ওপর হামলা চালিয়ে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের দোকানপাট ভাংচুর করে।
এছাড়াও হামলায় বিএনপি নেতা আজিজুল ইসলাম ও ইউনিয়ন যুবদল নেতা জাহাঙ্গীর আলম গুরুতর আহত হয়। গত ২৫শে জুন দুপুর ২:৩০মিনিটে ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলার নগর ইউনিয়ন যুবদল নেতা মো. ইলিয়াস হাওলাদারকে জেলার দক্ষিণ আইচা থানা যুবলীগের সভাপতি বাবুল, যুবলীগ নেতা মাহবুব ও যুবলীগ নেতা হাসানাতসহ বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে গুরুতর আহত করে।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আহমদ আযম খান, যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন নবী খান সোহেল, সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদ, স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক মীর শরফত আলী সপু, নির্বাহী কমিটির সদস্য আব্দুল কাদির ভুইয়া জুয়েল, তারিকুল আলম তেন জিং উপস্থিত ছিলেন।