bonikbarta.net
হাছান আদনান
দেশের প্রথম বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে ১৯৮৩ সালের ২৮ মার্চ উদ্বোধন হয় ন্যাশনাল ব্যাংকের। চার দশক আগে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকটি একসময় উদ্যোক্তা তৈরিতে বড় ভূমিকা রেখেছে। ব্যাংকটির বিস্তৃত ট্রেজারি ব্যবস্থাপনার সুবিধাভোগীর তালিকায় ছিল সরকারও। দক্ষ ব্যাংকারও তৈরি করেছে অনেক। কিন্তু প্রতিষ্ঠার ৪০ বছর পর বর্তমানে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় এসে পৌঁছেছে ব্যাংকটি। গত দেড় বছরে ন্যাশনাল ব্যাংকের সম্পদ সংকুচিত হয়েছে প্রায় ১২ শতাংশ।
একসময়ের সেরা ব্যাংকটি কার্যত ভেঙে পড়ার পেছনে দায়ী করা হচ্ছে অনিয়ম-দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনাকে। ন্যাশনাল ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৬০ শতাংশ থেকে কোনো আয় নেই। চলতি বছরের জুন শেষে ন্যাশনাল ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ৪২ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অন্তত ২৫ হাজার কোটি টাকা আদায় অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। এর মধ্যে ১০ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা উঠেছে খেলাপির খাতায়। মামলায় আটকা পড়েছে ৭ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা। বাকি টাকা এখনো খেলাপি না হলেও মেয়াদোত্তীর্ণ। আদায় অযোগ্য হওয়ায় অবলোপন করা হয়েছে আরো ১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকার ঋণ।
ঋণ বিতরণ, জনবল নিয়োগ ও ব্যবস্থাপনায় পরিচালকদের অনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে ন্যাশনাল ব্যাংক ২০০৯ সালের পর থেকে পথ হারাতে শুরু করে। ওই সময় ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন সিকদার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জয়নুল হক সিকদার। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি প্রয়াত হলে তার স্ত্রী মনোয়ারা সিকদার চেয়ারম্যান হন। বর্তমানে ব্যাংকটির পর্ষদে পরিচালক হিসেবে রয়েছেন সিকদার পরিবারের চার সদস্য। তবে কয়েক বছর ধরেই পর্ষদে রন হক সিকদারের একচ্ছত্র দাপট চলছে, জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি তাকে ব্যাংকটির পর্ষদ সভায় অংশ না নেয়ার জন্য চিঠি দিয়েছে বলে জানা গেছে।
ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. মেহমুদ হোসেন বলছেন, ‘এতদিন ন্যাশনাল ব্যাংকের মন্দ দিকগুলো কার্পেটের নিচে চাপা পড়া ছিল। গত বছর আমরা সেগুলো টেনে বের করেছি। এ কারণে ব্যাংকটির বিভিন্ন সূচক খারাপ দেখাচ্ছে।’ ২০২১ সালের শেষের দিকে ন্যাশনাল ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীর দায়িত্ব নেন মেহমুদ হোসেন। তবে ব্যাংক পরিচালনায় তার স্বাধীনতা খর্ব করায় গত বছরের জানুয়ারিতে তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে স্বপদে ফেরেন।
মেহমুদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমি মনে করি খারাপ দিকগুলো ব্যালান্সশিটে উঠে আসা ন্যাশনাল ব্যাংকের জন্য ভালো হয়েছে। ব্যাংকের প্রকৃত চিত্র সামনে আসায় আমরা ঘুরে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা নিতে পারছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক্ষেত্রে সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে। আশা করছি, আগামী বছর থেকে ন্যাশনাল ব্যাংকের সূচকগুলো ইতিবাচক ধারায় ফিরবে।’
দেশের প্রথম প্রজন্মের একঝাঁক শিল্প উদ্যোক্তার সম্মিলিত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যাশনাল ব্যাংক। কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৮৩ সালের ২৮ মার্চ। বর্তমানে সারা দেশে ২২১টি শাখা নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে ব্যাংকটি। ২০০৯ সালের পর ব্যাংকটির পর্ষদ থেকে উদ্যোক্তা পরিচালকদের অনেকেই ছিটকে পড়েন। কর্তৃত্ব বাড়ে জয়নুল হক সিকদার ও তার পরিবারের।
ন্যাশনাল ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১ সাল শেষে ব্যাংকটির মোট সম্পদ ও দায়ের পরিমাণ ছিল ৫৭ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা। কিন্তু চলতি বছরের জুন শেষে মোট সম্পদ ও দায় নেমে এসেছে ৫০ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকায়। অর্থাৎ গত দেড় বছরে ব্যাংকটির সম্পদ কমেছে ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এ সময়ে আমানত ও বিতরণকৃত ঋণ দুটোই কমেছে ন্যাশনাল ব্যাংকের।
জয়নুল হক সিকদার প্রয়াত হওয়ার পর ব্যাংকটির অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে রন হক সিকদারের বিরুদ্ধে এক্সিম ব্যাংকের তৎকালীন এমডি হায়দার আলী মিয়া ও এএমডি মোহাম্মদ ফিরোজ হোসেনকে গুলি করে হত্যা চেষ্টার অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় রন হক সিকদার গ্রেফতারও হয়েছিলেন। ন্যাশনাল ব্যাংকের আমানত কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে এসব ঘটনারও প্রভাব রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
বেনামি ঋণ ও ঋণ বিতরণে অনিয়ম ঠেকাতে ২০২১ সালের ৩ মে ন্যাশনাল ব্যাংকের ঋণ বিতরণ কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রভাবশালীদের তদবির ও চাপের মুখে অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক সে সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটে। ওই বছরের ৩০ ডিসেম্বর ন্যাশনাল ব্যাংকের ঋণ বিতরণের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। এরপর আবারো পরিস্থিতির অবনতি হলে গত বছরের মে মাসে বড় ঋণ বিতরণে নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। তিন মাস পর ফের ঋণ বিতরণ উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। তবে চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি তৃতীয় দফায় ব্যাংকটির বড় ঋণ বিতরণে বিধিনিষেধ আরোপ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, গত এক দশকে ন্যাশনাল ব্যাংকে যা হয়েছে সেটিকে ব্যাংকিং বলা যায় না। ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ যা চেয়েছে সেটিই হয়েছে। বিভিন্ন নিরীক্ষায় সেগুলো ধরা পড়লেও অজ্ঞাত কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীরব ছিল। এখন ব্যাংকটির পরিস্থিতি যে জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে, সেটি থেকে উত্তরণ ঘটানো খুবই কঠিন।
বিতরণকৃত ঋণের অর্ধেকের বেশি থেকে কোনো আয় না থাকলেও গত বছর ২ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করে দিয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক। চট্টগ্রামভিত্তিক প্রভাবশালী একটি গ্রুপের ঋণের বিপরীতে এ সুদ মওকুফ করা হয়। যদিও মওকুফকৃত সুদ এর আগে ব্যাংকটি নিজেদের মুনাফায় দেখিয়েছে। এর বিপরীতে সরকারকে করও পরিশোধ করেছে। মওকুফ করা সুদকে ‘ইনট্রানজিবল অ্যাসেট’ হিসেবে দেখিয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক। আগামী আট বছরে মুনাফা থেকে এটি সমন্বয় করার কথা। যদিও ব্যাংকটির বর্তমান পরিস্থিতিতে মুনাফায় ফেরার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা।
ন্যাশনাল ব্যাংকের তথ্য বলছে, ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের অর্ধেকের বেশি বড় কিছু গ্রাহকের কাছে কেন্দ্রীভূত। মাত্র ২৮টি শিল্প গ্রুপের কাছে থাকা ঋণের পরিমাণ ২৩ হাজার ৭৩৬ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে কিছু গ্রাহকের একাধিক বেনামি প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। ব্যাংকটির একাধিক কর্মকর্তা জানান, বড় গ্রাহকদের দুই-একজন ছাড়া কেউই টাকা ফেরত দিচ্ছেন না। জামানত ছাড়াই বেশির ভাগ ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এসব ঋণ যে আদায় হবে, সে সম্ভাবনাও ক্ষীণ।
গ্রাহকদের কাছ থেকে সংগৃহীত আমানতের নিরাপত্তার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নির্ধারিত হারে ব্যাংকগুলোকে সিআরআর ও এসএলআর সংরক্ষণ করতে হয়। যদিও অনেক দিন থেকেই নির্ধারিত এসএলআর সংরক্ষণ করতে পারছে না ন্যাশনাল ব্যাংক। গত বছর শেষে ব্যাংকটির এসএলআর ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা। একই সময়ে ৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকার প্রভিশন বা সঞ্চিতি ঘাটতিতেও ছিল। ন্যাশনাল ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণও ১ হাজার ৫৯ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) এখন ৯৯ শতাংশের বেশি। চলতি বছরের প্রথমার্ধে ব্যাংকটির পরিচালন লোকসান ৬২০ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। এ সময়ে পরিচালন কার্যক্রমে ক্যাশ ফ্লোর ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের শক্ত নজরদারির অভাব ও নিয়মনীতির ছাড়ে ন্যাশনাল ব্যাংক দুর্দশায় পড়েছে বলে মনে করেন সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘একসময় খুবই ভালো ব্যাংক হিসেবে ন্যাশনাল ব্যাংকের স্বীকৃতি ছিল। ব্যাংকটির কর্মকর্তারা দেশের ব্যাংক খাতের নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু এখন ব্যাংকটির যে পরিস্থিতি সেটি মোটেই ভালো নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলে এ পরিস্থিতি হতো না। এখন বাঁচাতে হলে ন্যাশনাল ব্যাংককে অন্য যেকোনো সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করে দিতে হবে। অন্যথায় ব্যাংকটিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রশাসক নিয়োগ দেয়া যেতে পারে।’