অর্থনীতির বিপর্যয় জনগণ কতটা বুঝতে পারছেন?

 আমার দেশ
১২ নভেম্বর ২০২২

মাহমুদুর রহমান

মাহমুদুর রহমান

মাহমুদুর রহমান

খানিকটা শারীরিক সমস্যা, আর খানিকটা নির্বাসিত জীবনের নানাবিধ ব্যস্ততার কারণে সম্পাদকীয় লিখতে প্রায় এক সপ্তাহের বিরতি পরে গেল। পাঠকের কাছে দু:খ প্রকাশ করে আজকের বিষয়ে মনোযোগ দিচ্ছি।

আইএমএফ আগামী সাড়ে তিন বছরে বাংলাদেশকে ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে প্রাথমিকভাবে সম্মত হয়েছে বলে সংবাদ মাধ্যমে খবর বার হয়েছে। ইংরেজীতে একটা কথা আছে, ‘There is a slip between the cup and tea’, অর্থাৎ চায়ের পেয়ালা আর ঠোঁটের মধ্যে এখনও তফাৎ রয়েছে। আইএমএফ’র ঋণেরও বাস্তব অবস্থাটাও ওই ইংরেজী প্রবাদের মতই। আন্তর্জাতিক ঋণদানকারি সংস্থাটির মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বোচ্চ মহলের সাথে আলাপ-আলোচনা করে বেশ কিছু শর্ত সাপেক্ষে উপরোক্ত ঋণ প্রদানে প্রাথমিক সম্মতির কথা জানিয়েছেন। আগামী তিন মাসের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার সেই সব শর্ত মানার প্রতিজ্ঞা করলে তবেই আইএমএফ বোর্ডে এই ঋণ প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপিত হবে। রিজার্ভের জালিয়াতি বন্ধ, খেলাপি ঋণ কমানো, অপচয় রোধ, অর্থনৈতিক সংস্কার, ইত্যাদি নানাবিধ বিষয় রয়েছে আইএমএফের শর্তের মধ্যে। হাসিনার জন্য বিপদ হলো, এই সব শর্ত মানা শুরু হলে ফ্যাসিস্ট ক্ষমতাসীন মহলের তথাকথিত উন্নয়ন জালিয়াতির চিত্রও জনগণের কাছে আরো পরিষ্কারভাবে প্রকাশ পেতে আরম্ভ করবে। যেমন ধরুন, রিজার্ভের প্রকৃত চেহারা।

সরকার যে এতদিন প্রায় আট বিলিয়ন ডলার ভুয়া রিজার্ভ দেখিয়ে এসেছে সেটা আইএমএফের চাপে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর অনেকটা মিনমিন করে শেষ পর্যন্ত স্বীকার করেছেন। কিছুদিন আগেও এই একই ব্যক্তি জোর দিয়ে বলছিলেন যে, তাদের রিজার্ভের হিসাবে কোন ভুল নাই এবং আইএমএফের কোন কথা তারা শুনবেন না। কথায় আছে না না, ছাগল লাফায় খুঁটির জোরে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও হাসিনা নামক খুঁটির জোরে এতদিন লম্ফঝম্প করছিলেন। যখন টের পেয়েছেন যে, খুঁটির গোড়ার মাটি ধ্বসে গেছে, তার লাফালাফিও থেমে গেছে। যে দিন আমি এই সম্পাদকীয় লিখছি, সেই দিন বাংলাদেশের রিজার্ভ ২৪ বিলিয়ন ডলার যা দিয়ে মাত্র তিন মাসের আমদানি খরচ মেটানো যেতে পারে। এই জাতীয় আরো অনেক জালিয়াতির কথা আগামী তিন মাসের মধ্যে সরকার ফাঁস করলে তবেই আইএমএফ বোর্ড ঋণ মঞ্জুর করবে। যাই হোক, হাসিনা সরকার কি করবে তা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা নাই। আমার উদ্দেশ্য জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করা যে, শেখ হাসিনা এবং তার লুটেরা সাঙ্গপাঙ্গরা বাংলাদেশের অর্থনীতির কি পরিমাণ বারোটা বাজিয়েছেন।

শেখ হাসিনা জনগণের রায় নিয়ে ক্ষমতায় আসেন নাই। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাকে আন্তর্জাতিক ইসলামবিদ্বেষী গোষ্ঠী বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের সহযোগীতায় ক্ষমতাসীন করেছিল। তারপর এই ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী বিচারকদের ব্যবহার করে দেশে নির্বাচনের পাটই একেবারে চুকিয়ে দিয়েছেন। ২০১৪ সালে একদলীয় নির্বাচন এবং ২০১৮ সালে নিশিরাতের নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি দশ বছর তার বেআইনী ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করেছেন। সুতরাং, ভোটের প্রয়োজন নাই বিধায় বাংলাদেশের জনগণের প্রতি তার কোন দায়বদ্ধতাও নাই। তাই গত চৌদ্দ বছরের শাসনকালে, শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে একটি লুটপাটের ক্ষেত্র বানিয়ে কেবল সামরিক এবং বেসামরিক প্রশাসনের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করেছেন। সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের সন্তুষ্ট করবার জন্য এবং অন্যান্য অপচয়ের ফলে বাৎসরিক রাজস্ব ব্যয়কে এমন বৃদ্ধি করা হয়েছে যা বহন করার সাধ্য বাংলাদেশের নেই। তার উপর মেগা প্রকল্পের অযুহাতে রিজার্ভ চিবিয়ে এবং গিলে ভান্ডার শেষ করে ফেলা হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প এবং স্যাটেলাইটের কথা বলা যেতে পারে।

১৪ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে মাত্র ২৪০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রুপপুরে নির্মাণ করা হচ্ছে তা একটি বিপদজনক শ্বেতহস্তিতে পরিণত হওয়ার প্রবল আশংকা রয়েছে। বাংলাদেশের মত একটি ঘনবসতিপূর্ণ, উন্নয়নশীল দেশে এই বিপুল ব্যয়ের উচ্চাভিলাষী প্রকল্প অর্থনৈতিকভাবে চরম ক্ষতি করার পাশাপাশি সামাণ্য ভুলে ভয়ানক মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। চেরনোবিলের কথা আশা করি, বাংলাদেশের জনগণ ভোলেন নাই। এই প্রকল্প গ্রহণ করবার পিছনে কোন অর্থনৈতিক যুক্তি ছিল না। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবর্তে দেশে অনেক কম খরচে ভিন্ন প্রযুক্তিতে ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব ছিল। কেবল বিপুল পরিমাণে অর্থ লুটপাট এবং রুশ-ভারতকে সন্তুষ্ট করবার জন্য দেশের সম্পদের এমন ক্ষতিসাধন করা হয়েছে। এর আগে কুইক রেন্টালের নামে কিভাবে শেখ হাসিনার পরিবার এবং আওয়ামী ও ভারতীয় ব্যবসায়ীরা হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়ে গেছে সেটা এখন সবাই জানেন। শেখ হাসিনা জনগণের অর্থ অপচয় করে তার পিতার নামে দিকে দিকে ডংকা বাজানোর জন্য একেবারেই অপ্রয়োজনীয় এক স্যাটেলাইট মহাশূন্যে উড়িয়েছেন। আমার মতে বাংলাদেশের মত রাষ্ট্রের এই রকম বিলাসিতা রীতিমত ফৌজদারি অপরাধ। নির্লজ্জ সরকার এখন আবার দ্বিতীয় স্যাটেলাইট উড়ানোর পাঁয়তারা করছে। ঢাকা শহরেও বিভিন্ন মেগা প্রজেক্টের নামে আজ এক দশক ধরে কিভাবে জনদূর্ভোগ সৃষ্টি করা হয়েছে সেটা রাজধানীবাসী প্রতিদিন দেখতে পাচ্ছেন। বিশেষ করে, মিরপুর এবং উত্তরা এলাকায় বসবাসরত নাগরিকদের চলাচল বলতে গেলে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সকল মেগা প্রজেক্টে অর্থায়ন করতে গিয়ে কেবল দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারই উড়িয়ে দেওয়া হয় নাই, রাষ্ট্রকে ঋণভারে জর্জরিত করেছে বর্তমান দুর্নীতিবাজ শাসকশ্রেণি।

দেশের এতবড় সর্বনাশ জনগণের নিরবে সয়ে যাওয়া দেখে আমি একাধারে ভয়ানক আশ্চর্য্য এবং রাগান্বিত হই। আজকাল বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় প্রায়ই পড়ি যে, নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্তের জীবন নাকি আর চলছে না। এই সব পরিবারের সন্তানদের লেখাপড়া বন্ধ হচ্ছে, দুই বেলা ঠিকমত খাদ্য জুটছে না, পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়ে দিতে হচ্ছে, প্রতি মাসে ধারদেনা করে কোনক্রমে সংসার চালাতে হচ্ছে, ইত্যাদি খবর প্রায় প্রতিদিন পত্রিকায় থাকে। অপরদিকে প্রতি বছর কোটিপতি সৃষ্টি এবং টাকা পাচারে বাংলাদেশ এখন ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন। কথিত বীর বাঙ্গালীর চামড়া এতটা মোটা কি করে হলো ভেবে অবাক হই। নাকি আপনারা দেশের সর্বনাশের মাত্রা বুঝতে পারছেন না? প্রতিবাদ কোথায় আপনাদের? এতদিন অযুহাত দেখানো হতো যে, বিরোধী দল নাকি মাঠে নামছে না। এখন তো বিএনপি সর্বশক্তি দিয়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছে। পুলিশের গুলি মোকাবেলা করে, আওয়ামী ঠ্যাঙ্গারেদের লাঠিবল্লমের সাথে লড়াই করে, সুবিধাবাদি বাস মালিকদের অসহযোগিতাকে উপেক্ষা করে, মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে, খোলা আকাশের নীচে রাত্রিযাপন করে, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, বিএনপি’র লাখ লাখ নেতাকর্মী একের পর এক মহাসমাবেশে যোগ দিচ্ছেন। আহ্বান জানাই, অধিকার পুন:প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে এবার নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষ সদলবলে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামুন।

বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচাইতে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। প্রতিটি জেলায় সমাবেশস্থলের কয়েক মাইলের মধ্যে লাখ লাখ মানুষ বসবাস করেন। লুটেরা, ফ্যাসিবাদি সরকারের বিরুদ্ধে ডাকা সমাবেশে সর্বত্র আপনারা যোগদান করলে সকল প্রকার সরকারী জুলুম, আওয়ামী ক্যাডারদের সন্ত্রাস এবং দালাল বাসমালিকদের ডাকা ধর্মঘট বিফলে যেতে বাধ্য। আগামী ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর নাগরিকরা শান্তিপূর্ণভাবে মহাসমাবেশে যোগদানশেষে সরকার পতনের একদফা দাবি তুলে গণভবনের দিকে অগ্রসর হলে শেখ হাসিনার সিংহাসন ইনশাআল্লাহ মুহূর্তের মধ্যে ভেঙ্গে পড়বে। তিনিও ভারতে পালাবেন এবং জনজোয়ারে সকল জালিমও ভেসে যাবে। সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্যে শেষ কথা বলে আজকের সম্পাদকীয়তে ইতি টানবো। ২০০৭ সালে আপনাদের ভুলের জন্যই বাংলাদেশের জনগণ শেখ হাসিনা নামক দানবের হাতে পড়েছে এবং দেশ তার সার্বভৌমত্ব দিল্লির কাছে হারিয়েছে। দীর্ঘ চৌদ্দ বছর ধরে আপনারা এক চরম দুর্নীতিপরায়ন, জালিম শাসককে শুধু পার্থিব লাভের আশায় জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সমর্থন দিয়েছেন। অনেক তো টাকাপয়সা আয় হলো। এবার আশা করি, আপনাদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত হবে। এই দেশ আপনাদেরও। আপনারা কি এমন এক দেশ রেখে যেতে চান যে দেশ আপনাদের সন্তানদের জন্য আর বসবাসযোগ্য থাকবে না? সেনাবাহিনীর সকলেই তো আর কানাডা কিংবা দুবাই এর বেগম পাড়ায় পরিবার পাঠাতে পারবেন না। বর্তমান শাসকশ্রেণি গত চৌদ্দ বছরে দেশকে ধ্বংস করে ফেলেছে। এখনও হয়তবা পুনরুদ্ধারের সময় আছে। অতএব, আর দেরি নয়। আসুন সমবেতভাবে জালিম শাসককে বিতারিত করে বাংলাদেশকে রক্ষা করি। নইলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।

লেখক: সম্পাদক, আমার দেশ 

১২-১১-২০২২