গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার উজানে বাঁধ নির্মাণ ও পানি প্রত্যাহার
নিজস্ব প্রতিবেদক
এপ্রিল ২৯, ২০২৩
বিশ্বের বৃহত্তম নদীব্যবস্থা গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা (জিবিএম)। এ ব্যবস্থার আওতাভুক্ত নদী-উপনদী-শাখানদীগুলো দিয়ে প্রতি বছর উজান থেকে আসা পলি প্রবাহিত হয় ১০০ কোটি টনেরও বেশি। জোয়ার-ভাটানির্ভর প্রতিবেশ ব্যবস্থায় এ পলিপ্রবাহের মাধ্যমেই নির্মাণ হয়েছে জিবিএম অববাহিকার ভূতাত্ত্বিক গঠন। বর্তমানে এ পলিপ্রবাহের স্বাভাবিকতায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে নদীগুলোর উজানে ভারত ও চীনের একের পর এক বাঁধ নির্মাণ। সামনের দিনগুলোয়ও আরো বাঁধ নির্মাণের পাশাপাশি আন্তঃনদী সংযোগের মাধ্যমে নদীগুলোর পানি সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে দেশ দুটির।
এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে ভাটিতে বাংলাদেশে পানি ও পলিপ্রবাহ বিপুল মাত্রায় কমে আসবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, ভারত ও চীনে এসব বাঁধ নির্মাণ এবং আন্তঃনদীসংযোগ প্রকল্পের কারণে ব্যাপক মাত্রায় পানি ও পলিপ্রবাহ হারাবে বাংলাদেশের নদীগুলো। উচ্চতা বাড়বে সমুদ্রপৃষ্ঠের। আরো নিচু হয়ে পড়বে বাংলাদেশের ভূমি।
বিশ্বের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে জনবহুল নদী অববাহিকা অঞ্চলটি গড়ে উঠেছে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর সমন্বয়ে। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান ও চীনের এক লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে গড়েছে অববাহিকা অঞ্চলটি। এখানে বসবাস করছে ১৭ কোটিরও বেশিসংখ্যক মানুষ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগামীতে এ অঞ্চলে মৌসুমি বৃষ্টিপাত ও পলিপ্রবাহ বাড়ার পূর্বাভাস রয়েছে। কিন্তু প্রত্যক্ষ মনুষ্যসৃষ্ট কারণে নদীগুলোর পানি ও পলিপ্রবাহ এর চেয়েও অনেক বেশি মাত্রায় কমবে বলে ব্রিটিশ, মার্কিন ও বাংলাদেশী বিশেষজ্ঞদের এক যৌথ গবেষণায় উঠে এসেছে। ‘জিওমরফিক চেঞ্জ ইন দ্য গ্যাঞ্জেস-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা ডেল্টা’ শীর্ষক ওই গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, উজানে একের পর এক বাঁধ নির্মাণ ও আন্তঃনদীসংযোগ তৈরির মাধ্যমে পানি প্রত্যাহারের কারণে চলতি শতকের শেষে জিবিএম অববাহিকার নদীগুলোয় পলিপ্রবাহ হ্রাস পেতে পারে ৮৮ শতাংশ পর্যন্ত।
বর্তমানে জিবিএম অববাহিকার দেশগুলোয় পরিকল্পনার অধীন বাঁধের সংখ্যা ৪১৪। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক নির্মাণের কথা রয়েছে নেপালে—২৮৫টি। এছাড়া ভারতে ১০৮টি, ভুটানে ১২, চীনে আট ও বাংলাদেশে একটি বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। গবেষণায় পরিকল্পনাধীন এসব বাঁধের সবগুলোই নির্মাণ হবে ধরে নিয়ে পলিপ্রবাহ হ্রাসের মাত্রা হিসাব করা হয়েছে। গবেষকদের হিসাব অনুযায়ী, পরিকল্পনাধীন বাঁধগুলো নির্মাণ শেষে আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট ও প্রভাবকের ভিন্নতা বিবেচনায় বার্ষিক পলিপ্রবাহ হ্রাসের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে কমপক্ষে ৭ কোটি ৯২ থেকে ৯ কোটি ২০ লাখ টন। অন্যসব প্রভাবক অপরিবর্তিত থাকবে ধরে নিলে বার্ষিক পলিপ্রবাহ হ্রাসের পরিমাণ হবে প্রায় ৬৭ কোটি টন।
সাউথ টু নর্থ ওয়াটার ডাইভারশন প্রজেক্টের মাধ্যমে ইয়ারলুং স্যাংপো (ব্রহ্মপুত্র নদীর চীনা অংশের নাম) থেকে পীত নদীতে বছরে ২০ হাজার কোটি ঘনফুট পানি সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে চীনের। ন্যাশনাল রিভার লিংকিং প্রজেক্টের (এনআরএলপি) আওতায় ৯ হাজার ৬০০টি খাল খননের মাধ্যমে নিজ সীমানার ৪৪টি নদীকে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে ভারতের। পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়ন বাংলাদেশের নদীগুলো দিয়ে পানি ও পলিপ্রবাহ ব্যাপক মাত্রায় হ্রাস পাবে। গবেষণায় উঠে আসে, এর মধ্যে ব্রহ্মপুত্রের পানি পীত নদীতে সরিয়ে নেয়া হলে নদীটির পলিপ্রবাহ হ্রাস পেতে পারে ৯ থেকে ২৫ শতাংশ। ভারতে এনআরএলপির মাধ্যমে গঙ্গার পানি সরিয়ে নেয়া হলে পদ্মা নদীতে পলিপ্রবাহ কমতে পারে ৩৯ থেকে ৭৫ শতাংশ। উজানের দুই দেশে এ দুই প্রকল্পের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার হলে তা বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক গঠন প্রক্রিয়ায় মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটাবে। পলি জমা হওয়ার হারে আসবে নাটকীয় পরিবর্তন। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং ভূমি নিচু হয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে পরিবর্তন আসবে ব-দ্বীপ এলাকার গঠনগত ভারসাম্যে।
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড, যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যান্ডারবিল্ট ইউনিভার্সিটি এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বিশেষজ্ঞরা যৌথভাবে গবেষণাটি পরিচালনা করেন। গবেষক দলের একমাত্র বাংলাদেশী সদস্য বুয়েটের ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার অ্যান্ড ফ্লাড ম্যানেজমেন্টের (আইডব্লিউএফএম) অধ্যাপক মো. শাহ আলম খান। বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করায় বিষয়টি নিয়ে তাত্ক্ষণিকভাবে তার মন্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
উজানে বাঁধ নির্মাণের কারণে বাংলাদেশসহ গোটা জিবিএম অববাহিকা অঞ্চলে এরই মধ্যে ভূতাত্ত্বিক গঠন, নদীর পানিপ্রবাহসহ সার্বিক প্রতিবেশ ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। এর একটি বড় উদাহরণ বাংলাদেশে পদ্মার শাখানদী গড়াই। ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি ভারতের ভাগীরথী-হুগলি নদীতে প্রবাহিত করা হচ্ছে। এতে গড়াইয়ের পানিপ্রবাহ ব্যাপক মাত্রায় হ্রাস পেয়েছে। প্রবাহ না থাকায় কমেছে পানির পলি বহনের সক্ষমতা। ফলে পলি জমতে জমতে নদীটির বিভিন্ন স্থানে চর পড়েছে।
বড় নদীগুলোর শাখানদী-উপনদীগুলোর প্রায় সবক’টিতেই এখন মোটামুটি এ ধরনের পরিস্থিতি দেখা যায়। উজানি প্রবাহ কমে আসায় দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় জেলাগুলোয় লবণাক্ততার সমস্যা এখন প্রকট হয়ে উঠেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান ও স্থানীয়দের জীবন-জীবিকা। শুষ্ক মৌসুমে পদ্মার পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় নদীটির অববাহিকা অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানি জমা হওয়ার মাত্রাও এখন হ্রাস পেয়েছে।
রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘স্বাধীনতার পর দেশে নদীর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ২০০টির মতো। নদীরক্ষা কমিশনের তথ্য অনুযায়ী এখন নদী আছে সম্ভবত ৭৫৬টি। অর্থাৎ স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় ৫০০ নদী বিলীন হয়ে গেছে। এর পেছনে বড় কারণ হচ্ছে প্রবাহ না থাকা। আর প্রবাহ না থাকলে দখল হয়। প্রবাহিত নদী দখল করা কঠিন। ৫০ বছরে ৫০০ নদী বিলীন হওয়ার বড় কারণ আন্তঃসীমান্ত নদীর প্রবাহ না থাকা। চীন ও ভারতের নদীসংযোগ প্রকল্পগুলোর কারণে আমাদের এখানে লবণাক্ততা বাড়বে। মানব স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এখানে মানুষ বসবাস করতে পারবে না। এছাড়া নদীর ভাঙন বাড়বে। এখন ২২টি জেলায় ভাঙন হয়, তখন আরো বাড়বে। এটা বাড়তেই থাকবে। কারণ শুকনো নদীতে হঠাৎ করে পানি এলে সেটা ভাঙবেই।’
জিবিএম অববাহিকার দেশগুলোর মধ্যে অভিন্ন (আন্তঃসীমান্ত) নদীগুলোর পানিবণ্টন নিয়ে ব্যাপক মতানৈক্য রয়েছে। এ অঞ্চলে এখন পর্যন্ত অভিন্ন নদ-নদীর পানিবণ্টন নিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মতৈক্যে পৌঁছানোর নজির খুবই কম। বিষয়টি শিগগিরই মিটে যাওয়ার সম্ভাবনাও কম। যদিও এ মতানৈক্যের কারণে দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
নদীর পানিবণ্টনসংক্রান্ত আঞ্চলিক কর্মসূচি ট্রান্স-বাউন্ডারি রিভারস অব সাউথ এশিয়া (টিআরওএসএ) প্রোগ্রামের উদ্যোগে পরিচালিত আরেক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে আসে, অভিন্ন নদীগুলোর পানিবণ্টন নিয়ে একমত হতে না পারার কারণে শুধু গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা (জিবিএম) অববাহিকার দেশগুলোর বছরে ক্ষতি হচ্ছে ১ হাজার ৪২০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ। ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে চুক্তি সইয়ের আগ পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে মতবিরোধ ছিল দীর্ঘদিন। দুই দেশ পরস্পরের সঙ্গে একমত হতে না পারায় ১৯৭৬ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১৮ কোটি ৬৬ লাখ ডলারের সমপরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বাংলাদেশের, যা দেশের তত্কালীন জিডিপির দশমিক ৬ শতাংশের সমান। একইভাবে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে মতবিরোধসহ নদীর পানিবণ্টন নিয়ে নানা অসহযোগিতার কারণে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে নেপাল ও ভুটানের বার্ষিক ক্ষতি হচ্ছে সাড়ে ১০ কোটি থেকে ১৮০ কোটি ডলার। পানিবণ্টন নিয়ে দেশগুলো মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাব তৈরি হলে এ ক্ষতি খুব সহজেই এড়ানো যেত।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পৃথিবীর যেকোনো জায়গায়ই অভিন্ন নদীর ব্যবস্থাপনা অববাহিকার দেশগুলো একযোগে করে থাকে। আমাদের উজানের দেশগুলো বিশেষ করে ভারত দীর্ঘদিন ধরে এককভাবে অভিন্ন নদীর পানি ব্যবস্থাপনা করে আসছে। নদী একটি জীবন্ত সত্তা। নদী তার নিজস্ব অবস্থান নিয়ে চলে। এতে যেকোনো হস্তক্ষেপই নদীর উজান-ভাটিতে পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য এবং নদীকেন্দ্রিক সম্পদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আমাদের দেশ গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকার ভাটির দেশ। উজানের একতরফা বিভিন্ন প্রকল্পে নদীগুলো নাব্যতা হারিয়েছে। যে কারণে শুকনো মৌসুমে পানি থাকে না। আবার বর্ষা মৌসুমে বাঁধ খুলে দেয়ার পর আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি হয়। এটি মোটা দাগের সমস্যা। আরো সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অনেক সমস্যা আছে। মানুষ স্থানান্তরিত হয়। জীবিকা হারিয়ে যায়। নদীর সঙ্গে সম্পৃক্ত খালগুলো নষ্ট হয়ে যায়। অন্যান্য জলাশয় হারায়। বিল-হাওরগুলো নষ্ট হয়ে যায়। মাছের প্রজনন নষ্ট হয়। এর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। অভিন্ন নদীর ওপর কিছু করতে হলে তা যৌথভাবে করতে হবে।’
জলবায়ুগত দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে নাজুক অঞ্চলগুলোর একটি জিবিএম অববাহিকা। এ অঞ্চলের অভিন্ন নদীগুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে সহযোগিতার মাত্রা বৃদ্ধির পাশাপাশি তা টেকসই করতে দ্রুত ও জরুরিভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বুয়েটের আইডব্লিউএফএমের অধ্যাপক সুজিত কুমার সাহা বলেন, ‘বাংলাদেশ বা বেঙ্গল ডেল্টা পুরোপুরি পলি দিয়েই গঠিত। উজানে বাঁধ দেয়ার কারণে আমাদের দেশের নদীগুলোয় পলি ও পানির প্রবাহ কমে গেছে। সাতক্ষীরাসহ অনেক জায়গায় কপোতাক্ষের মতো অনেক নদী মরে গেছে। দক্ষিণের বিভিন্ন জায়গায়ই এ রকম হয়েছে। পলিপ্রবাহ আরো কমলে সামনে আমাদের জন্য আরো বিরূপ অবস্থা ও উদ্বেগময় পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।’