সংঘাত ও অনিশ্চয়তার মধ্যে রাজনীতি

দেশের রাজনীতি সংঘাতে ঢুকে পড়েছে। নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেপ্তার, রিমান্ডের মুখে অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে বিএনপি। সরকারও কঠোর থেকে আরও কঠোর হচ্ছে। দুই পক্ষ এখন সংলাপ ও সমঝোতার বা কোনো ছাড় দেওয়ার মানসিকতায় নেই। জাতীয় নির্বাচনও ঘনিয়ে আসছে। তবে রাজনীতিতে সংঘাত, অনিশ্চয়তা বাড়ছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন।

নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে বিরোধ থেকে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছিল। এই উত্তেজনার পর গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে ঘটেছে সহিংসতা, প্রাণহানি। এমন পরিস্থিতির জন্য একে অপরকে দায়ী করেছে বিএনপি ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

তবে পরদিনই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। দলটির জ্যেষ্ঠ নেতা থেকে শুরু করে মাঠের নেতাদের একের পর এক গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এমনকি জ্যেষ্ঠ নেতাদের রিমান্ডেও নেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতির মুখে বিরোধী দল হরতালের পর অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে।

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগপর্যন্ত বিএনপির নেতা–কর্মীদের গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত রাখবে সরকার। একাধিক মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া গেছে। তাঁদের যুক্তি হচ্ছে, ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় প্রাণহানি ঘটেছে। সে কারণে ঘটনার ব্যাপারে মামলায় এসব গ্রেপ্তার হচ্ছে। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি সহিংসতার পথে নেমেছে। ফলে সহিংস ঘটনার ব্যাপারে সরকারকে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে। নির্বাচন পর্যন্ত সহিংসতার বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থান থাকবে।

কিন্তু ক্ষমতাসীনদের কেউ কেউ বলছেন, মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর নেতাদের গ্রেপ্তার করে বিএনপিকে চাপে ফেলা বা কোণঠাসা করা তাদের অন্যতম লক্ষ্য। সরকার যখন কঠোর অবস্থান নেওয়ার কথা বলছে, তখন অবরোধের মতো কর্মসূচি অব্যাহত রেখে বিএনপিও বলছে, এ ধরনের কর্মসূচি দেওয়া ছাড়া তাদের সামনে বিকল্প নেই।

বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রথম আলোকে বলেন, সরকার বিরোধী দলের নেতা–কর্মীদের গ্রেপ্তার, রিমান্ডে নেওয়াসহ দমন–নিপীড়ন বাড়িয়ে দিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকেই সংঘাত সৃষ্টি করা হচ্ছে। ক্ষমতাসীনদের এমন আচরণের মুখে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া ছাড়া তাঁদের পিছু হটার কোনো সুযোগ নেই।

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, রাজনীতি এখন সংঘাতময় হয়ে উঠেছে। মহাসমাবেশের পরও অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সংঘাত হচ্ছে। যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটছে। যদিও কোনো পক্ষই এসব ঘটনার দায় নিচ্ছে না। তবে অনিশ্চয়তা থেকেই পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজনীতিতে সংঘাত, উদ্বেগ, অনিশ্চয়তা বেড়েই চলেছে। দুই পক্ষের কেউই তা উপলব্ধি করছে না।’

সংলাপ–সমঝোতার মানসিকতায় নেই কোনো পক্ষ

টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ তাদের অধীনেই নির্বাচন করার লক্ষ্যে এগোচ্ছে। আর বিএনপি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকার ছাড়া নির্বাচন না করার অবস্থানে অটল রয়েছে। দুই পক্ষের অনড় অবস্থানের মুখে রাজনীতি এখন সংঘাত ও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। কিন্তু কোনো পক্ষ থেকেই ছাড় দেওয়ার কোনো লক্ষণ নেই।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, বিপরীতমুখী অবস্থানে থাকা দুই দল কোনো চাপে না পড়লে নিজেরা আলোচনায় বসে সমাধান করতে পারবে, তাদের সেই মানসিকতা নেই। তারা সে ধরনের পরিস্থিতিও রাখেনি। এ ছাড়া সংঘাত ও অনিশ্চয়তার ব্যাপারে দুই দল কতটা উপলব্ধি করছে, এ নিয়েও সন্দেহ রয়েছে বিশ্লেষকদের।

অন্যদিকে অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর তৎপরতা রয়েছে। ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস কয়েক দিন আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের কাছে বলেছিলেন, শর্তহীনভাবে সব পক্ষ সংলাপে বসে সমাধান করবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন মহল থেকে আলোচনা–সমঝোতার কথা বলা হচ্ছে। দুই দল তা আমলে নিচ্ছে না বলে মনে হচ্ছে।

আওয়ামী লীগ বলে আসছে, তাদের সরকারের অধীনে নির্বাচন করার ব্যাপারে বিএনপি রাজি হলে তখন সংলাপ হতে পারে। ক্ষমতাসীনেরা এখন বিএনপির মহাসমাবেশকে ঘিরে সহিংসতার বিষয়কেও তুলে ধরে সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও গত বৃহস্পতিবার সংসদে বক্তব্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে কোনো ধরনের সংলাপের সম্ভাবনা আবারও নাকচ করে দিয়েছেন।

বিএনপি নেতারা বলছেন, সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও সংলাপ নিয়ে যে বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে, তাতে সরকার আবারও একতরফা নির্বাচন করতে চাইছে বলে তাঁরা মনে করছেন। তবে বিএনপিও নির্দলীয় সরকারের দাবির ব্যাপারে সরকার একমত না হওয়া পর্যন্ত কোনো সংলাপে যেতে রাজি নয়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, দুই পক্ষের তিক্ততা, উত্তেজনার রাজনীতি যে সংঘাতে গড়িয়েছে, তাতে দেশের অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের ওপরই নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সরকারের দিক থেকেই নমনীয় হয়ে সংকটের সমাধান করা প্রয়োজন। কিন্তু সরকার যখন নিষ্ঠুরতা দেখাচ্ছে, তখন অনিশ্চয়তা আরও বাড়ছে।

প্রথম আলো