দেশপ্রেমের মাত্রাভেদ


দেশপ্রেম পরিমাপের স্বীকৃত কোনো মানদণ্ড না নেই। তবে একজন ব্যক্তির কাজ, কথা ও আচরণে দেশপ্রেমের হার নির্ধারণ সম্ভব। দেশপ্রেম বিষয়ে ইসলামী চিন্তাবিদদের উক্তি- ‘হুব্বুল ওয়াতানে মিনাল ঈমান’। যার অর্থ- দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। ঈমান বলতে আমরা বুঝি আন্তরিক বিশ্বাস, মৌখিক স্বীকৃতি এবং সে অনুযায়ী কাজ। যেকোনো দেশের একজন জাতীয় নেতার মধ্যে পরিপূর্ণ দেশপ্রেম না থাকলে তার পক্ষে সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়।

 

আমাদের দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি কৃষক, শ্রমিক ও প্রবাসে কর্মরত কর্মজীবীরা। দেশের কৃষক অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে যে কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন করেন তা অনেকাংশেই আমাদের চাহিদা পূরণ করে ও কিছু বিদেশে রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়তা করছে। কৃষকদের কৃষিজাত পণ্য বিশেষ করে ধান ও শাকসবজি পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপাদনের কারণে এগুলো রফতানি বিকল্পের কাজ করছে; অন্যথায় এসব পণ্য আমদানির জন্য যে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার আবশ্যকতা দেখা দিতো তার জোগান আমাদের মতো দেশের জন্য অনেকটা অসম্ভব ছিল। আমাদের কৃষকদের তেমন একটা চাহিদা নেই। তারা দু’বেলা পেট পুরে খেতে পারলে এবং পরিধেয় বস্ত্রাদির ব্যবস্থা করতে পারলেই তৃপ্ত। আমাদের কৃষকরা ধান ও শাকসবজির পাশাপাশি মাছ ও ফলমূল উৎপাদনেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছেন। কৃষকরা এ দু’টি পণ্য উৎপাদনে মনোনিবেশ করায় এসব পণ্য ভোক্তাদের কাছে সহজলভ্য এবং এগুলোর ক্রয়মূল্য তাদের নাগালের মধ্যে। কৃষকদের বড় অংশ কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত নন বিধায় তাদের পেছনে শিক্ষা সংশ্লেষে রাষ্ট্রের ব্যয় নেই বললেই চলে। কৃষকরা গ্রামে বসবাস করেন বলে তারা সরকারি স্বাস্থ্যসেবা থেকে অনেকটাই বঞ্চিত। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় সাধারণ রোগব্যাধির ক্ষেত্রে তারা নিজ উদ্যোগে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে রোগ নিরাময়ে সহায়তা নেন। কৃষকদের অনেকে হাঁস, মুরগি ও পশুপালন করে নিজেদের চাহিদার জোগানসহ এটিকে বাড়তি অর্থ আহরণের একটি খাত হিসেবে বিবেচনা করেন। সামগ্রিক অর্থে দেশের অর্থনীতিতে কৃষকের যে অবদান এর বিনিময়ে রাষ্ট্র বা সরকার থেকে তাদের প্রাপ্তি নগণ্য। তাই দেশপ্রেমের মানদণ্ডে কৃষকের অবস্থান যে মাত্রার শীর্ষে এ বিষয়ে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়।

বর্তমানে প্রবাসে কর্মরত দেশের কর্মজীবীর সংখ্যা এক কোটির কোঠা অতিক্রম করেছে। এদের উল্লেখযোগ্য অংশ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। এসব কর্মজীবীর অনেকেই স্বল্পশিক্ষিত ও অদক্ষ। তা ছাড়া মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়ায়ও বেশ কিছু শিক্ষিত ও দক্ষ কর্মজীবী রয়েছেন। এ কারণে সমপেশায় নিয়োজিত পাশের দেশগুলোর কর্মজীবীদের তুলনায় তাদের মজুরি কিছুটা কম। এসব কর্মজীবী তাদের কর্মস্থলের সন্নিকটে কায়ক্লেশে জীবন ধারণ করে উপার্জিত অর্থের বেশির ভাগই দেশে বাবা-মা ও পরিবার-পরিজনের জন্য পাঠিয়ে থাকেন। তাদের পাঠানো অর্থ দেশের বৈদেশিক মুদ্রাপ্রাপ্তির অঙ্ক ক্রমাগত বৃদ্ধির পাশাপাশি এর মজুদ সমৃদ্ধ করে চলেছে। এদের কর্মজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র বা সরকারের তেমন বিনিয়োগ না থাকলেও অনবরত রাষ্ট্র ও সরকারের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার জোগান সৃষ্টি করে চলেছেন। ইউরোপ আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে যেসব কর্মজীবী রয়েছেন তাদের বেশির ভাগ উচ্চশিক্ষিত। বিভিন্ন পেশায় বিশেষায়িত জ্ঞানসমৃদ্ধ। তাদের অনেকেই দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে শিক্ষা গ্রহণান্তে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি দিয়ে শিক্ষা সমাপনান্তে তথায় কর্মে নিয়োজিত হয়েছেন। আবার অনেকে উচ্চশিক্ষা সমাপনান্তে দেশে ফিরে আগের কর্মস্থলে নিয়োজিত হয়েছেন। আমাদের দেশের অনেকে ছাত্র হিসেবে বিদেশে পাড়ি দিয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বা আরো উচ্চতর শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে কর্মে নিয়োজিত হয়েছেন। উল্লিখিত শ্রেণীদ্বয়ের মধ্যে প্রথমোক্তদের শিক্ষা অর্জনে রাষ্ট্রকে অনেক ব্যয় গুনতে হয়, অপর দিকে শেষোক্তদের ক্ষেত্রে বিদেশে অধ্যয়ন ও আবাসনের ব্যয় মিটানোর জন্য রাষ্ট্রের বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় আবশ্যক হয়ে পড়ে। শেষোক্তদের প্রায় শতভাগই শিক্ষা গ্রহণ সমাপনান্তে বিদেশে কর্মে নিয়োজিত হয়ে পড়েন। প্রবাসে কর্মরত কর্মজীবীর দেশপ্রেমের মাত্রা কোনো অংশে দেশের কৃষক ও শিল্প-কারখানায় নিয়োজিত শ্রমিক ও আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত শ্রমিকের চেয়ে কম নয়; যদিও এ দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে শিক্ষা গ্রহণ শেষে বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণকরত এবং ছাত্র হিসেবে বিদেশে পাড়ি দেয়া পরবর্তী শিক্ষা সমাপনান্তে তথাকার নাগরিকত্ব গ্রহণ পরবর্তী তথায় স্থায়ীভাবে বসবাসরতদের দেশপ্রেম কোনোভাবেই প্রবাসে কর্মরত কর্মজীবীদের সাথে তুল্য নয়।

দেশে বা বিদেশে অধ্যয়ন শেষে যারা জীবনসঙ্গী হিসেবে স্বজাতিকে বেছে নেন তাদের দেশপ্রেমের সাথে যারা বিদেশীদের জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেন তাদের দেশপ্রেমের ফাঁরাক রয়েছে। আবার বিদেশীদের জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়ে যারা বিদেশে স্থিত হয়েছেন তাদের সাথে সমজাতীয় যারা নিজ দেশকে বসবাসে বেছে নিয়েছেন এদের দেশপ্রেমের পার্থক্য রয়েছে।

এমন অনেক আছেন যারা রাজধানী শহরের অভিজাত আবাসিক এলাকায় বাজারদরের তুলনায় নামমাত্র মূল্যে সরকারি প্লটপ্রাপ্ত হওয়ার পর তথায় ভবন নির্মাণ করে তারা নিজে অথবা তাদের উত্তরাধিকারীরা ভূমিসহ এসব ভবন বিক্রি করে বিক্রয়লব্ধ অর্থে বিদেশে স্থায়ী নিবাস গড়েছেন। তাদের দেশপ্রেমের মাত্রা যে তলানিতে বা একেবারেই শূন্য এ বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে কি!

এ দেশে বসবাসরতদের মধ্যে যারা পরিধেয় বস্ত্রাদি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিসহ খাদ্যদ্রব্য হিসেবে দেশে উৎপাদিত পণ্যকে প্রাধান্য দেন তাদের দেশের প্রতি মমত্ববোধ, একাগ্রতা, আন্তরিকতা ও সর্বোপরি দেশপ্রেম যে নিষ্কলুষ ও অকৃত্রিম এ বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই।

গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি নামক অর্থ পাচারবিষয়ক গবেষণাধর্মী একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিগত কয়েক বছরে আমাদের দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে। পাচারকারীরা পাচারকৃত অর্থ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশে ভূসম্পদ ক্রয়পূর্বক সুখের নীড় গড়ে তুলেছেন। এদের কেউ রাজনীতিবিদ, কেউ ব্যবসায়ী আবার কেউ সামরিক বা বেসামরিক আমলা। এদের পাচার করা অর্থ জ্ঞাতসূত্রে আয়ের সাথে সঙ্গতিবিহীন এবং এটি সম্পূর্ণরূপে দুর্নীতিলব্ধ অর্থ। এরা ক্ষমতাকে অবৈধ অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে স্ত্রী-সন্তানদের বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের নিমিত্ত প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান নিশ্চিতে কখনো এতটুকুও কুণ্ঠাবোধ করেননি।

এদের দেশপ্রেম শুধু তলানিতেই নয় বরং ঋণাত্মক কিন্তু এর পরও এরা ভাবলেশহীন ও নির্বিকার এবং অহঙ্কার ও দম্ভের মোহে নীতিনৈতিকতা ও মূল্যবোধবিহীন এক অসাড় মনুষ্য নামধারী জীব।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: [email protected]