দিশেহারা মানুষ : উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কার

  • মো: মাঈন উদ্দীন
  •  ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৬:৫০
দিশেহারা মানুষ : উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কার – নয়া দিগন্ত

উচ্চহারে মূল্যস্ফীতিতে মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। চাল, ডাল, মাছ, আলু, সবজি, ডিমসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যেভাবে লাগামহীন হারে বাড়ছে তাতে নিবিত্ত, মধ্যবিত্তসহ সব শ্রেণীর ক্রেতার মধ্যে ক্ষোভ অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত তথ্য হলো, আগস্ট ২০২৩ মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে দাঁড়িয়েছিল, যা জুন ও জুলাইয়ে ছিল যথাক্রমে ৯ দশমিক ৭৪ ও ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। আগস্টের সার্বিক মূল্যস্ফীতির মধ্যে রেকর্ড বৃদ্ধি খাদ্য মূল্যস্ফীতি। এ হার ছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ, যা গত সাড়ে ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। অথচ সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য যেমন- আলু, তেল, পেঁয়াজ, ডিম ইত্যাদির দাম বাড়িয়ে চলেছে। সরকার কিছু পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিলেও বাজারে এর প্রতিফলন নেই।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলেছে, পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ ও অসাধুদের অতি মুনাফা রোধে সরকার একাধিকবার একাধিক পণ্যের দাম নির্ধারণ করেছে। কিন্তু সেই দাম কার্যকর করা যায়নি। ক্রেতাদের বাড়তি দরে পণ্য কিনতে হচ্ছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা আলু, পেঁয়াজ, ডিমসহ একেক সময় একেক পণ্যের দাম বাড়িয়ে তারা ভোক্তাদের পকেট কেটেছে। তাই ভোক্তার স্বার্থে অসাধুদের কঠোরভাবে দমন করতে হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কিছু দিন আগেও নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষিপণ্যের উৎপাদন, চাহিদা ও মূল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে পণ্যের দাম নির্ধারণের কথা বললেও বাজারে তার প্রতিফলন নেই। পত্রিকার খবর ও সরেজমিন ক্রেতাদের বক্তব্য অনুযায়ী দেখা যায়, প্রতি কেজি পেঁয়াজ পাইকারি আড়তে বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকা ও খুচরা বাজারে ৮০-৯০ টাকা। প্রতিটি ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৩-১৪ টাকা। সরকার পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দায়িত্ব শেষ মনে করে বসে থাকে, অথচ ভোক্তারা অসহায়ের মতো বাড়তি টাকা ব্যয় করে শেষ হয়ে যাচ্ছে।

বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এক বক্তব্যে বলেন, পণ্যের দাম কার্যকরকরণে সারা দেশে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। ঘোষিত মূল্য কার্যকর করতে কাজ চলমান আছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসংক্রান্ত সিন্ডিকেট নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রীও বিভিন্ন সময় নানা কথা বলছেন। কিন্তু এসব সিন্ডিকেট, অসাধু ব্যবসায়ীদের থেকে ভোক্তাদের কে রক্ষা করবে? কে কার কাছে জবাবদিহি করবে? নি¤œবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষসহ সাধারণ ভোক্তারা আজ সিন্ডিকেটের থাবায় বন্দী। মাছ গোশতের কাছে ঘেঁষতে পারছে না অনেকে। আলু ভর্তা, ডিম, ডাল জোগাড় করাও কঠিন হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি সাধারণ সবজি তরকারিসহ আদা-রসুনের দামও অত্যন্ত চড়া। অথচ আমাদের কৃষকরা সঠিক মূল্য পান না। তাদের কৃষিকাজের পেছনে যে উৎপাদন খরচ হয় তাও তাদের মেটাতে কষ্ট হয়। মধ্যস্বত্বভোগী ও সিন্ডিকেট অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে মানুষ দিশেহারা।

কৃষি বিপণন অধিদফতরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি কেজি আলু উৎপাদনে কৃষকের সাড়ে ১০ টাকা খরচ হয়। কৃষক সর্বোচ্চ ১৫ টাকায় বিক্রি করেন, যা খুচরা বাজারে ৩২ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়; অথচ বাজারে আলুর দাম কেজিপ্রতি ৪৫-৫০ টাকা। এদিকে দাম বৃদ্ধির পেছনে কারা দায়ী তা সরকারি সংস্থা জানে। তারপরও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। কয়েক মাস ধরে বাড়তি দরে ডিম বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বাজারে প্রতি ডজন ফার্মের ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৫৫-১৬০ টাকা; যা গত বছরে একই সময় ডজন প্রতি ডিম বিক্রি হয়েছে ১২০ টাকা। প্রতি কেজি মসুরডাল বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা যা আগে ১১৫ টাকা ছিল। আর ছোট দানা মসুরডাল বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ টাকা। বাজারে বয়লার মুরগি কেজি প্রতি ১৭৫ থেকে ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কক মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩২০ টাকা। এভাবে লাগামহীনভাবে যখন নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে তখন মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতি হারের অনেক নিচে। মূল্যস্ফীতির হার যখন ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ তখন মজুরি বৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ। এভাবে সমাজে শ্রেণিবিন্যাস-বৈষম্য দেখা দেয়। সমাজে মধ্যবিত্তরা নিমধ্যবিত্তে, নিমধ্যবিত্তরা দরিদ্র ও দরিদ্ররা অতিদরিদ্রের কাতারে নেমে আসছে। দেশে দরিদ্রের হার বেড়ে যাচ্ছে। তাই মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বহার হ্রাসে সরকারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।

নিত্যপণ্যের দাম নির্ধারণে সরকারও কি অসহায়? অথচ বাজারে নিত্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থাও স্বাভাবিক। তারপরও পণ্যের দাম বাড়ছে পাগলা ঘোড়ার গতিতে। ভোক্তার জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। চলমান অর্থনৈতিক মন্দায় মানুষের আয় কমে যাচ্ছে। মানুষ ঋণগ্রস্ত হচ্ছে। পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারকে আগে থেকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে। কেউ অনিয়ম করলে তার শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ভোক্তার সুরক্ষা দিতে সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে।

নিত্যপণ্যের দাম ভোক্তার সাধ্যের মধ্যে আনা অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। এই ব্যর্থতার দায় কি বাংলাদেশ ব্যাংকের, না বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। আমরা জানি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে থাকা মূল অস্ত্র হচ্ছে মুদ্রানীতির কার্যকর ব্যবহার। অর্থাৎ সুদহার বাড়িয়ে বা কমিয়ে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এ কাজ করে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি বিভাগ। মুদ্রানীতি তৈরি করা, সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্যতম দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, ভারত, থাইল্যান্ড, কানাডাসহ বহু দেশে মুদ্রানীতির কমিটির সদস্যদের মধ্যে অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক, গবেষকরা থাকেন। অথচ বাংলাদেশের যে মুদ্রানীতি কমিটি আছে তার সব সদস্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্র্ধ্বতন কর্মকর্তা। যেখানে অর্থনীতিবিদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ সরকারের অনেক অভিজ্ঞ কর্মকর্তাও থাকতে পারতেন। দুঃখের বিষয়, মুদ্রানীতি নিয়ে বিভিন্ন মতামত শোনা, জবাবদিহির চর্চা দেশে গড়ে ওঠেনি।

সাধারণ মানুষকে যে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তা খালি চোখে দেখেও কারো কোনো দায়িত্ব বা জবাবদিহি নেই। আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর ন্যস্ত থাকে। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির হার নির্ধারণ করে মুদ্রানীতি তৈরি করে। বেশির ভাগ দেশের লক্ষ্য থাকে মূল্যস্ফীতি ২ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে রাখা। আমাদের দেশের সরকারও বাজেটের সময় এলে মূল্যস্ফীতির হার কমিয়ে আনার ঘোষণা দিয়ে থাকে। যদিও পরবর্তীতে লক্ষ্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে উদাসীনতা লক্ষ করা যায়। বিশে^র অনেক দেশে মূল্যস্ফীতির হার নিন্মমুখী হলেও আমাদের দেশে ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু কেন হচ্ছে এসব! যুক্তরাজ্যে চলতি বছরের জুলাই বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হার কমে ১৫ মাসের মধ্যে সর্বনিন্ম হয়েছে। মূল্যস্ফীতির হার জুনে ৭.৯ থেকে কমে ৬.৮ শতাংশ দাঁড়িয়েছে। কানাডায় পরিসংখ্যান বিভাগের হিসাব থেকে জানা যায়, ২০২২ সালের জুনে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৮.১ শতাংশ দাঁড়ায়। মে মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭.৭ শতাংশ। ২০২৩ সালে জুলাইয়ে এই হার দাড়ায় ৩.২৭ শতাংশ। এভাবে দেখা যায়, বিশে^র অধিকাংশ দেশে মূল্যস্ফীতির হার নিন্মমুখী। অথচ আমাদের দেশে উচ্চ হারে মূল্যস্ফীতিতে মানুষ দিশেহারা। সরকার চোখের সামনে তা দেখতে পেয়েও যেন অসহায়ের মতো শুধু নানা বক্তব্য বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোনো সিন্ডিকেট বা অসাধু ব্যবসায়ীর কারসাজির হাত থেকে ভোক্তাদের মুক্তির কোনো ব্যবস্থা হচ্ছে না। সব কিছুর মূলে রয়েছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব, আইনের কঠোর প্রয়োগের ঘাটতি।

অর্থনীতিকে সাবলীলভাবে চালাতে হলে দুর্নীতি দূর করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। দেশের সম্পদ সুরক্ষায়, অপচয় রোধ ও দেশপ্রেমে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। মুনাফাখোরি এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীর মূলোৎপাটন করে মজুদদারিতার ও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। কৃষকের ন্যায্য পণ্যমূল্য পেতে মধ্যস্বত্বভোগীদের স্তর ভাঙতে হবে। অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে, জনগণকে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতে মূল্যস্ফীতির উচ্চহার হ্রাসে সরকারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।

লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক