সংখ্যালঘু ‘ভোট ব্যাংক’ রাজনীতির সমাধান কোন পথে

সংখ্যালঘু ‘ভোট ব্যাংক’ রাজনীতির সমাধান কোন পথে

মহিউদ্দিন আহমদ

এ অঞ্চলের অনেক বৈশিষ্ট্যের একটি হলো হিন্দু-মুসলমানের ঝগড়া। এর শুরু কবে থেকে? আমরা অনেকেই নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে সাফসুতরো থাকতে চাই। তাই আমরা বলি, ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি’ দিয়ে আমাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধ্বংস করে দিয়েছে। তা না হলে আমরা তো বেশ ছিলাম, আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম!

আমার মনে হয়, ব্যাপারটা উল্টো। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা যেটা করেছে, সেটা হলো ‘ইউনাইট অ্যান্ড রুল, ডিভাইড অ্যান্ড কুইট’। তারা ভারতকে এক করেছিল। আধুনিক ভারত রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হয় তাদের হাতে। বিদায় নেওয়ার সময় তারা দেশটা ভাগ করে দিয়ে গেছে। বাংলার ভয়াবহতম হিন্দু-মুসলমান খুনোখুনির পটভূমিতে ছিল দেশের এই বিভক্তি।

হাজার বছর আগের চালচিত্র কেমন ছিল? এগারো শতকে পর্যটক ও পরে ভারততত্ত্ববিদ হিসেবে খ্যাত আল বিরুনির চোখে বিষয়টি ধরা দিয়েছিল।

একজন মুসলমান একজন হিন্দুকে কী চোখে দেখে, তার বিবরণ তিনি দিয়েছেন এভাবে:

‘ধর্মের দিক থেকে তারা আমাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। যা আমরা বিশ্বাস করি, তারা তা করে না এবং যা তাদের, তা আমরা মানি না। তারা আমাদের পোশাক, জীবনযাত্রা এবং নিয়মকানুন সম্পর্কে তাদের সন্তানদের বাজে ধারণা দেওয়া থেকে শুরু করে যা কিছু ভালো এবং সংগত, তা থেকে আমাদের অন্যভাবে চেনায়। সব বিদেশির বিরুদ্ধেই তাদের সংকীর্ণতা, তারা বলে ম্লেচ্ছ অর্থাৎ অপবিত্র। আন্তসম্প্রদায় বিয়ে এবং একসঙ্গে বসা, খানাপিনা করাসহ সব ধরনের যোগাযোগ নিষিদ্ধ। তারা আমাদের ছোঁয়া অপবিত্র মনে করে, তা আগুন হোক কিংবা পানি। যে তাদের সম্প্রদায়ভুক্ত নয়, তাকে তারা গ্রহণ করে না, এমনকি তাদের ধর্মের প্রতি আকর্ষণ থাকলেও। ফলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা প্রায় অসম্ভব এবং এটাই তাদের সঙ্গে বিশাল পার্থক্য তৈরি করে দিয়েছে।’

ভারতভাগের পর পাকিস্তান হলো মুসলমানের রাষ্ট্র আর ভারত হলো হিন্দুর রাষ্ট্র। কাগজে-কলমে ভারত সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে দাবি করলেও বাস্তবে তা হয়নি। দেশভাগের পর থেকে ভারতের কোথাও না কোথাও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটেনি, এমন একটি দিনও সম্ভবত খুঁজে পাওয়া যাবে না।

এ দেশে একসময় ছিল পৃথক নির্বাচনব্যবস্থা। মুসলমান ভোট দেবেন মুসলমানকে, হিন্দু ভোট দেবেন হিন্দুকে। ১৯৫৩ সালে সাম্প্রদায়িক দল আওয়ামী মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম পার্টি ও খেলাফতে রব্বানি পার্টি অসাম্প্রদায়িক দল কৃষক-শ্রমিক পার্টির সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট তৈরি করে ১৯৫৪ সালে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করে।

যুক্তফ্রন্টের অন্যতম দাবি ও অঙ্গীকার ছিল পৃথক নির্বাচনব্যবস্থার বদলে যুক্ত নির্বাচনব্যবস্থা চালু করা। যুক্তফ্রন্টের বড় দল হিসেবে আওয়ামী লীগ চায়নি হিন্দু আর মুসলমানের ভোট ভাগ হয়ে যাক। হিন্দু নেতারা, বিশেষ করে কংগ্রেস ও তফসিলি ফেডারেশন আওয়ামী লীগের কাছে প্রতিশ্রুতি চেয়েছিল যে দলটি অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি করবে। আওয়ামী লীগ কথা দিয়েছিল।

ফলে ১৯৫৫ সালের কাউন্সিল অধিবেশনে আওয়ামী মুসলিম লীগ নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ পড়ে এবং এই দলে অমুসলমানের প্রবেশাধিকার স্বীকৃত হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানে জারি হওয়া সংবিধানে যুক্ত নির্বাচনব্যবস্থার বিধান রাখা হয়। ১৯৬২, ১৯৬৫ ও ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যুক্ত নির্বাচনব্যবস্থা বহাল থাকে।

বাবরি মসজিদ ভাঙা ছিল বড় রাজনৈতিক পুঁজি। এটা ব্যবহার করে ভারতে বিজেপির বিস্ময়কর উত্থান হয়েছে। এর ছোঁয়া লেগেছে অন্যান্য দলেও। ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে আদর্শের বাইরে গিয়েও আপস করতে হয়। বাংলাদেশে মুসলমানেরা হচ্ছে সবচেয়ে বড় ভোট ব্যাংক। তাদের ভোট পেতে অনেকেই ‘হিন্দু’ আর ‘ভারত’ কার্ড খেলে। নিজেদের খাঁটি মুসলমান প্রমাণে সচেষ্ট থাকাতে হয়। জায়নামাজে মোনাজাতরত নেতার ছবি থাকে নির্বাচনী পোস্টারে।

১৯৪০ সালের ‘লাহোর প্রস্তাবে’ ভারতে মুসলমানপ্রধান প্রদেশগুলো নিয়ে মুসলমানের আলাদা সার্বভৌম রাষ্ট্রপুঞ্জের কথা বলা হয়েছিল। ১৯৭১ সালে মুসলমানের রাষ্ট্র পাকিস্তান ভেঙে তৈরি হয় বাঙালি মুসলমানের রাষ্ট্র বাংলাদেশ। বাস্তবায়িত হয় লাহোর প্রস্তাব।

আওয়ামী লীগ সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি ঢোকালেও রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ হয়নি। আওয়ামী লীগের কাছে ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ছিল রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে কোরআনের সঙ্গে গীতা পাঠ এবং ‘হিন্দু’ ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব। মননে-মগজে আওয়ামী লীগ ১৯৪০-এর দশকের ইসলামি আইডেনটিটি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। পরে দেখা গেছে, এই দলটি সব সময় হিন্দুদের ‘ভোট ব্যাংক’ হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে।

শাসকেরা সংকটে পড়লে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার উসকানি দিয়ে জনগণের দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেয়। এমনটি দেখা গেছে পাকিস্তানে, ভারতে ও বাংলাদেশে। বাবরি মসজিদ ভাঙা নিয়ে পুরো অঞ্চলে সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে পড়েছিল। এর কারণ কি? ভারতে মুসলমানেরা সংখ্যালঘু। তাদের ব্র্যান্ডিং করা হয় পাকিস্তানপ্রেমী হিসাবে। আর পাকিস্তান হচ্ছে ভারতের শত্রুরাষ্ট্র। সুতরাং শত্রুকে আঘাত করা যায়। বাংলাদেশেও তাই। এখানে হিন্দু সংখ্যালঘু। তাদের ব্র্যান্ডিং হলো ভারতপ্রেমী হিসাবে।

বাবরি মসজিদ ভাঙা ছিল বড় রাজনৈতিক পুঁজি। এটা ব্যবহার করে ভারতে বিজেপির বিস্ময়কর উত্থান হয়েছে। এর ছোঁয়া লেগেছে অন্যান্য দলেও। ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে আদর্শের বাইরে গিয়েও আপস করতে হয়। বাংলাদেশে মুসলমানেরা হচ্ছে সবচেয়ে বড় ভোট ব্যাংক। তাদের ভোট পেতে অনেকেই ‘হিন্দু’ আর ‘ভারত’ কার্ড খেলে। নিজেদের খাঁটি মুসলমান প্রমাণে সচেষ্ট থাকাতে হয়। জায়নামাজে মোনাজাতরত নেতার ছবি থাকে নির্বাচনী পোস্টারে।

চার দশক ধরে এ দেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে বড় দুটি দল, আওয়ামী লীগ আর বিএনপি। মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে সুড়সুড়ি দিয়ে ভোট আদায়ের ফন্দিতে কেউ পিছিয়ে ছিল না। হিন্দু সম্প্রদায় আওয়ামী লীগের হাতে অপেক্ষাকৃত বেশি নির্ভরতা খুঁজে পায়। এটা পুঁজি করে আওয়ামী লীগ হিন্দুদের একচ্ছত্র ভোট ব্যাংক হিসেবে কাজে লাগানো চেষ্টা করে গেছে।

বিএনপি এদিকে নজর দেয়নি। এ দলের দৃষ্টি ছিল বড় ব্যাংকটির অর্থাৎ মুসলমান ভোটের দিকে। একটা উদাহরণ দিই। ১৯৯৬ সালের ১২ মে নিজের দল এনডিপি বিলুপ্ত করে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বিএনপিতে যোগ দেন। তিনি কড়া মেজাজের জাতীয়তাবাদী হয়ে যান। তিনি বললেন, ‘যারা মনে করছেন মায়ের বোনকে মাসি এবং পিতার বোনকে পিসি সম্বোধন করতে হবে, তাদের স্বপ্নকে চুরমার করে দিতে হবে। আমরা পানি খেতে চাই, জল খেতে চাই না। বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদীরা গোসল করে, স্নান করে না’ (সূত্র: আওয়ামী লীগ: উত্থানপর্ব ১৯৪৮-১৯৭০, প্রথমা প্রকাশন)। বিএনপি তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেছিল। ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী হয়ে খালেদা জিয়া তাঁকে রাজনৈতিক উপদেষ্টা বানিয়েছিলেন।

২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ ১৫ বছর ক্ষমতা কবজা করে রেখেছিল। তখন এ দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হয়েছিল সবচেয়ে বেশি। একে একে রামু, নাসিরনগর, সুনামগঞ্জ, গোবিন্দগঞ্জ, কুমিল্লা, ফেনীতে এসব ঘটেছে। মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুর হয়েছে। সব জায়গায় দেখা গেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের লোকেরা জড়িত। আওয়ামী লীগ সব সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একটা বার্তা দিতে চায় যে, এ দেশে জঙ্গিবাদ দিন দিন বাড়ছে। এটা নিয়ন্ত্রণের জন্য আওয়ামী লীগের কোনো বিকল্প নেই। ক্ষমতার জন্য একটা দল যে কত নিচে নেমে যেতে পারে, এটা তার একটা উদাহরণ।

ভোট ব্যাংক ইস্যুর সুরাহা করা যায় কীভাবে? আমার এক আওয়ামী বিরোধী ‘হিন্দু’ বন্ধু ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেছেন, পৃথক নির্বাচনব্যবস্থা আবার চালু করলে ভালো হয়। তাহলে হিন্দুরা যথেষ্টসংখ্যক সদস্য নিয়ে জাতীয় সংসদে আসতে পারবে। কোনো দল তাদেরকে ব্ল্যাকমেল করতে পারবে না। প্রস্তাবটি মন্দ নয়। তখন তথাকথিত ‘অসাম্প্রদায়িক’ দলগুলোরও একটা পরীক্ষা হয়ে যাবে, তারা কয়জন সংখ্যালঘুকে আসন ছেড়ে দেওয়ার মতো উদারতা দেখাতে পারবে।

অনেক বছর আগে কাজী নজরুল ইসলাম একটা কবিতায় লিখেছিলেন:
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোন্‌ জন?
কাণ্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!

নজরুল মরে গিয়ে বেঁচে গেছেন। আমরা তাঁকে জাতীয় কবি বানিয়েছি ঠিকই কিন্তু একে অন্যের প্রতি বিষ উগরে দিচ্ছি।

  • মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক
  • prothom alo