‘ধরা পড়লেই বহিষ্কার’


‘ধরা পড়লেই বহিষ্কার’ এবং ‘কাউকে ছাড় দেয়া হবে না’ এ দুটি বাক্য এখন সরকারের উচ্চ মহল থেকে প্রায়ই প্রচার করা হয়। কথায় কথায় ওই দুটি বাক্য উল্লেখ করেই কর্তৃপক্ষ কর্তাব্যক্তিরা ঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটাতে চায় কি না তা তারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে বাক্যগুলো Prevention is better then cure প্রবাদটির পরিপন্থী। প্রবাদের মর্মমতে দুর্ঘটনা-অঘটন ঘটলেই মুখ রক্ষার জন্য ‘বহিষ্কার’ বা ‘ছাড় না দেয়ার’ হুমকি দেয়ার চেয়ে ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটতে না দেয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি করাই বেশি শ্রেয়। জনগণ রাষ্ট্রকে কর দেয় নিজেদের নিরাপত্তার জন্য, সরকারের কর্মচারী আমলাদের লালন পালন করে কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে, উদ্দেশ্য আপামর জনগণ যাতে অসম্মানিত বা প্রতারিত না হয়।

বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, রাতারাতি প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি এবং বিপুল অর্থের মালিক হওয়ার এক নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য বাহন হচ্ছে রাজনীতি তথা ক্ষমতাসীন দলের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, সরকারি দলে থাকলে বিপুল বিত্ত বৈভবের মালিক, অন্যদিকে বিরোধী দলে থাকলে জেল-জুলুম, নির্যাতন-নিপীড়ন। এটাই এখন প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি, এ ক্ষেত্রে সংবিধানকে একটি বাতিল কাগজের আবর্জনা বলে মনে হয়। সুবিধাবাদী বা সুবিধাভোগীরা সবসময়ই সুবিধাজনক অবস্থানেই থাকে। তারা নিজস্ব কোনো রাজনীতি মনে মগজে লালন করে না। তাদের দরকার ক্ষমতাসীনদের সাথে আন্তরিক একটি ছবি এবং পদ-পদবি সংবলিত ভিজিটিং কার্ড। এ ছবি ও ভিজিটিং কার্ড আমলা-কামলাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তারা মনে করেন, ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদপুষ্টদের সেবাদান আসলে ক্ষমতাসীনদেরই সেবা করা। আর এটাই তাদের একমাত্র দায়িত্ব। বিনিময়ে আমলা-কামলারা নিরাপদে জনগণকে চুষে খাওয়ার একটি লাইসেন্স পেয়ে যায়।

যারা রাজনীতিতে বহুরূপ ধারণ করতে পারে তারাই এখন সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। রাজনীতির অঙ্গন কলুষিত ও নোংরা হওয়ার কারণেই বহুরূপীরা রাজনৈতিক হিরো বনে যাচ্ছে এবং ক্ষমতাসীন আমলা-মন্ত্রীদের আশীর্বাদ ও ডিজিটাল পরিবেশ এ জন্য সহায়ক ভ‚মিকা পালন করছে। সন্ত্রাসী, প্রতারক ও ধাপ্পাবাজরা কেন সরকারি দলের আশ্রয় গ্রহণ করে? স্বাভাবিকভাবেই জনমনে এ প্রশ্ন ওঠে। এ মর্মে জবাবটা অত্যন্ত সোজা ও বোধগম্য। কারণ আমাদের দেশে রাজনীতির কোনো চর্চা নেই, রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবেলা করা হয় না। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে জনমতের মাধ্যমে পরাজিত করার কোনো উদ্যোগ নেই। কিছু দিন আগেই সন্ত্রাসী অর্থাৎ অস্ত্র ও গুণ্ডা দিয়ে প্রতিপক্ষকে দমানোসহ নির্বাচনী কেন্দ্র দখল করা হতো। এখন কেন্দ্র দখল ও ভিন্নমতাবলম্বীদের দমানো হয় আইন, আদালত এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অপব্যবহার করে। ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থেকে অপরাধের পর অপরাধ করলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের ধারেকাছেও যায় না বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সঙ্গ দিয়ে ফটোসেশনের ছবি ভাইরাল হয়েছে। যখনই অপরাধ মিডিয়াতে প্রকাশ পায় তখনই মুখ রক্ষার জন্য সরকারি দলের উচ্চ মাপের কণ্ঠওয়ালারা বলেন, ‘কাউকে ছাড় দেয়া হবে না’ এবং মুখ রক্ষার জন্য দল, অঙ্গ দল, পাতি দল, সহযোগী দল, ভাতৃপ্রতিম দল প্রভৃতি থেকে কথিত ‘রঙ্গলীলা বহিষ্কার’ করা হলেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা শুরু হয়, তখন আরো তৎপর হয় সরকারের দুদক বাহিনী। যাদের সাথে অভিযুক্তদের ছবি ফ্রেমবন্দী হয়েছে তখন তারাও বলে, ‘কাউকে ছাড় দেয়া হবে না’। নারীদের শ্রদ্ধা করি, সম্মান জানাই। কারণ তারা আমাদের মায়ের জাতি। যারা নষ্টা বা পরিবেশ যাদের নষ্ট করেছে তারা সমাজে দানবী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সাবেক সেনাপ্রধানসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে এমন ব্যক্তির ছবি ভাইরাল হয়েছে যার বিরুদ্ধে রয়েছে ভ‚মিদস্যুতার অভিযোগ। মন্ত্রী, এমপি ও আমলা বিশেষ করে যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত তাদের সাথে যখন সমাজবিরোধীদের ছবি ভাইরাল হয় তখন ভুক্তভোগী জনগণের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ ছাড়া অন্য কোনো পন্থা থাকে না।

যারা ক্ষমতাসীনদের সাথে ছবি ভাইরাল করে, তারা নিজ স্বার্থ হাসিল করে, কারণ এ ছবিগুলো সমাজবিরোধীদের অপকর্ম করার নিরাপত্তা দেয়। কিন্তু ক্ষমতার চাদর গায়ে জড়িয়ে সাদা চামড়ার ললনাসহ সমাজবিরোধীদের সাথে যারা ছবি তোলেন তাদের কি সমাজের পরিবেশ সুন্দর রাখার কোনো দায়-দায়িত্ব নেই? এহেন পরিস্থিতিতে ধরা খেলেই অভিযুক্ত ক্ষমতাসীন বলে, তার অজান্তে পেছনে দাঁড়িয়ে সেলফি বা অন্য কারো দ্বারা ছবি তুলেছে। এমনটা হতে পারে বলে এবং এভাবে কেউ কেউ হয়তো পরিস্থিতির শিকার হতে পারেন। কিন্তু কোনটা অজান্তে বা কোনটা স্বেচ্ছায় আন্তরিক পরিবেশে তোলা ছবি তা যেকোনো দর্শকই অনুমান করতে পারে। ফলে বাংলাদেশের আপামর জনগণকে বোকা ভাবার কোনো অবকাশ নেই। কারণ সব জনগণ ললিপপ চোষে না?

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্যাসিনো ও ললনাঘটিত কেলেঙ্কারিতে সরকারি দল থেকে অনেক বহিষ্কারের ঘটনা ঘটেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের দীর্ঘ সময়ের জন্য রিমান্ডে নিয়েছে। আদালতে প্রতিটি রিমান্ড প্রার্থনায় পুলিশ বলে, সংশ্লিষ্ট ঘটনায় এবং সংশ্লিষ্ট অপরাধী বা সংশ্লিষ্ট ললনার সাথে কাদের যোগাযোগ ও সংস্পর্শ ছিল তা খুঁজে বের করার জন্য রিমান্ড প্রয়োজন। হালে আমাদের বিচারব্যবস্থায় পুলিশের রিমান্ড প্রার্থনা নাকচ হওয়ার ঘটনা সাধারণত দেখা যায় না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই, বাংলাদেশের কোন কোন ধনাঢ্য ব্যক্তি ক্যাসিনোতে জুয়া খেলতেন বা ললনাদের সাথে ওঠাবসা করতেন তাদের তালিকা পুলিশ বা র‌্যাব বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কখনো প্রকাশ করেছে বা তাদের বিচারের আওতায় এনেছে এমন কথা আমি শুনিনি। রাষ্ট্রের মালিক ‘জনগণ’ শুনেছে কি না তা তারাই ভালো বলতে পারবে।

ললনাদের প্রতি আকর্ষণ পুরুষের সহজাত প্রবৃত্তি হতে পারে, কিন্তু তা সব পুরুষের জন্য প্রযোজ্য নয়। তবে বিকৃত রুচির বহুগামীদের বিষয়টি ভিন্ন। পতিতাবৃত্তি পৃথিবীর অন্যতম আদি পেশা যার এখন ভিন্নরূপে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে কথিত ভদ্র সমাজেও। ইতোপূর্বে কোনো কোনো রাজা, বাদশাহ, জমিদার, ক্ষমতাসীন মহল এবং ধনাঢ্য ব্যক্তিদের মাধ্যমে পাক-ভারত উপমহাদেশে ভদ্রোচিত পতিতাবৃত্তির প্রসার ঘটে ইংরেজদের খুশি করার জন্য উপঢৌকনের মাধ্যমে। তখন থেকেই পতিতাবৃত্তি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রচলিত হয়।

১১ জন স্বামী বদল করে অনেক বিত্ত বৈভবের মালিক হওয়া বিপুল পরিমাণ মাদকসহ এক নারীকে গত ৪ এপ্রিল ঢাকার অভিজাত এলাকা থেকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। অভিজাত মহলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুই-তিনটি স্বামী বদল করা এখন আর কোনো ব্যাপার মনে হয় না। এ প্রবণতা এখন ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ার কথা শোনা যাচ্ছে। তাদের স্বীকৃতি মতে, একাধিক স্বামী পরিবর্তন করে বিপুল অর্থের মালিক হওয়ার প্রমাণ মিলছে। ওই দেহপসারিণী নারীরা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে নারী নির্যাতন আইনকে। সরলপ্রাণ পুরুষদের ব্ল্যাকমেইল করে ওই আইনে ফাঁসিয়ে দেয়া হচ্ছে। স¤প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্ল্যাকমেইলার রমণীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে যা স্বস্তিকর।

বাংলাদেশের সংবিধান ১৮(১) মোতাবেক সরকার বা রাষ্ট্র বা কোনো কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশে মদ-মাদক বিক্রি ও প্রস্তুত করার লাইসেন্স দিতে পারে না। যদি দেয় তবে তা হবে সংবিধান পরিপন্থী। ঢাকা বোট ক্লাব বা অভিজাত ক্লাবগুলো সংবিধান লঙ্ঘন করে কোন ক্ষমতাবলে মদ বিক্রি করে? শোনা যায়, সরকারের অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এ জাতীয় ক্লাবগুলোর পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছে।

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী
(অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com