ব্যারিস্টার নাজির আহমদ
(২০ ঘন্টা আগে) ১৯ আগস্ট ২০২৫, মঙ্গলবার, ১২:১০ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৫:৫২ অপরাহ্ন
লেখক
গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তি এবং পতিত সরকারের প্রধান শেখ হাসিনার পলায়নের প্রথম বর্ষপূর্তির দিনে জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। গত ৫ আগস্ট ২০২৫ (মঙ্গলবার) বিকেলে রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউতে এ ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তবে পঠিত জুলাই ঘোষণাপত্রে অনেক গ্যাপ, ফাঁক (loophole) এবং অনেক উপাত্তের অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাই প্রশ্ন উঠেছে- গণঅভ্যুত্থানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয়া আপামর জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার কতটুকু প্রতিফলন ঘটেছে।
গণঅভ্যুত্থানে প্রবাসী বাংলাদেশিরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। বিভিন্ন দেশে তারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে দূতাবাস ও হাইকমিশন ঘেরাও করেছেন, সভা-সমাবেশ করেছেন ঐতিহাসিক পার্ক ও ভেন্যুতে এবং স্থাপনায় দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ। মধ্যপ্রাচ্যে বিক্ষোভ করতে গিয়ে অর্ধশত প্রবাসী জেল খেটেছেন। গণঅভ্যুত্থানের আগে একমাস রেমিট্যান্স শাটডাউন করে পতিত সরকারের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন। দেড় কোটি প্রবাসী বাংলাদেশের নাগরিক। তারা রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখেন। বস্তুত: তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সকে বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফলাইন বলা হয়। জাতিসংঘের অধীনে পৃথিবীর প্রায় ১২০টি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ আছে যাদের একেকটি দেশের মোট জনসংখ্যা দেড় কোটি হবে না। দেশের প্রায় এক-দশমাংশ জনগণ তথা দেড় কোটি প্রবাসীদের অবদান জুলাই ঘোষণাপত্রে অনুপস্থিতি। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ও হতাশাজনক।
জুলাই ঘোষণাপত্রে ১৫ই আগস্ট ও ৩’রা নভেম্বরকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে। জুলাই ঘোষণার ৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “যেহেতু স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার স্বাধীনতার মূলমন্ত্র গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিপরীতে বাকশালের নামে সাংবিধানিকভাবে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করে এবং মতপ্রকাশ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণ করে, যার প্রতিক্রিয়ায় ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর দেশে সিপাহী-জনতার ঐক্যবদ্ধ বিপ্লব সংঘটিত হয়….”। এটা অনেকটা ইতিহাস বিকৃতি বা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার নামান্তর। একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম এবং মতপ্রকাশ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণের প্রতিক্রিয়ায় ৭ই নভেম্বরের বিপ্লব হয়নি, হয়েছে ১৫ই আগস্ট। ৭ই নভেম্বরের বিপ্লব হয়েছে বরং ৩’রা নভেম্বরের খালেদ মোশাররফের প্রতি-বিপ্লবের প্রতিক্রিয়ায়। ইতিহাসের সঠিক তথ্য ও ধারাবাহিকতা জুলাই ঘোষণাপত্রে থাকা উচিৎ ছিল।
পিলখানায় ৫৭ জন চৌকস সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি ছিল জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড। পৃথিবীর ইতিহাসে একটি পূর্ণাঙ্গ (full-fledged) যুদ্ধেও এক বা দু’দিনে এত সেনা কর্মকর্তা নিহত হননি। অপরদিকে শাপলা চত্বরে গণহত্যা চালিয়ে অসহায় মাদ্রাসাছাত্র ও শিক্ষকদের হত্যা করা হয়। এই দুটি ট্র্যাজেডি ও হত্যা জুলাই ঘোষণাপত্রে অনুপস্থিত। অথচ এগুলো বাংলাদেশে দেড় যুগের স্বৈরাচার পতনের ধারাবাহিকতায় সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দুটি অধ্যায়।
জুলাই ঘোষণাপত্র কখন থেকে শুরু বা কার্যকর হবে এ ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট উল্লেখ নেই। গণঅভ্যুত্থান হয়েছে গত বছর ৫ আগস্ট। জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়েছে এক বছর পর। এখন এই ঘোষণাপত্রের কার্যকারিতা কখন থেকে শুরু হবে – এ বছর না ভূতাপেক্ষ (retrospectively) কার্যকরতা দিয়ে গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে তারও উল্লেখ নাই। ঘোষণায় বলা হয়েছে “৫ আগস্ট ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানে বিজয়ী বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে এই ঘোষণাপত্র প্রনয়ণ করা হলো”। তবে কবে থেকে কার্যকর হবে তার উল্লেখ নেই। জুলাই ঘোষণার ৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “যেহেতু গত দীর্ঘ ষোল বছরের ফ্যাসিবাদী, অগণতান্ত্রিক এবং গণবিরোধী শাসনব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে এবং একদলীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অতি উগ্র বাসনা চরিতার্থ করার অভিপ্রায়ে…..”। কার্যকরের তারিখ স্পষ্ট করে উল্লেখ না থাকায় এবং গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পর জুলাই ঘোষণাপত্রে ষোল বছর বলায় কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গত এক বছর তাতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়!
ঘোষণাপত্রে জুলাই অভ্যুত্থানে শহিদদের সংখ্যা নিয়েও ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। জুলাই ঘোষণাপত্রের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে এক হাজার শহিদের কথা বলা হয়েছে। অথচ জাতিসংঘের রিপোর্টে চৌদ্দশত শহীদের কথা উল্লেখ আছে। জনসমক্ষে (publicly) সরকারের কর্তাব্যক্তিরা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ প্রায় সময় দুই হাজার শহিদের কথা উল্লেখ করেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে শহিদের প্রকৃত সংখ্যা কত? কোন ভিত্তিতে জুলাই ঘোষণাপত্রে শহিদদের সংখা এক হাজার বলা হলো? এক বছর অতিক্রান্ত হলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শহিদদের সঠিক সংখ্যা ও তালিকা প্রণয়ন করতে পারলেন না। জুলাই ঘোষণাপত্র একটি ঐতিহাসিক দলিল যা ভবিষ্যতে সাংবিধানিক ভিত্তি পাবে। অথচ এতে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগকারী আমাদের শহিদদের সঠিক সংখ্যা দেয়া হলো না।
জুলাই ঘোষণাপত্র সংবিধানের প্রস্তাবনায় (Preamble) না রেখে তফসিলে রাখাও যুক্তিযুক্ত নয়। সময়ের কাজ সময়েই করতে হয়। সময় পার হলে ঐ ফেলে আসা সময়ের গুরুত্ব ও তাৎপর্য একভাবে থাকে না। অনেকটা এমন যে – সকাল ১০ টার সময় ঘুম থেকে উঠে যদি বলা হয় সেহরি খাব, তাকে সেহরি খাওয়ানো যাবে? মোটেই সম্ভব নয়। যদি গত বছর জুলাই গণঅভ্যূত্থানের পরপরই সংবিধান স্থগিত করে জুলাই ঘোষণাপত্র বা প্রোক্লেমেশন দেয়া হতো তাহলে তা সংবিধানের প্রস্তাবনায় রাখা যেত বা রাখা সম্ভব ছিল। দেরি হওয়ায় অনেক বাঁধা ও চ্যালেঞ্জ চলে এসেছে। এই দেরির কারণেই জুলাই ঘোষণা স্থান পাবে সংবিধানের তফসিলে, একটি অগুরুত্বপূর্ণ স্থানে। যেমন পতিত সরকার অনেকটা গায়ের জোরে তাদের ইচ্ছামতো শেখ মুজিবের বিতর্কিত ওয়ারলেসের মাধ্যমে পাঠানো কথিত স্বাধীনতার ঘোষণাও সংবিধানের তফসিলে নিয়ে রাখে, অথচ এটা সর্বজন স্বীকৃত যে, জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
পরবর্তী নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারের সংস্কারকৃত সংবিধানের তফসিলে এ ঘোষণাপত্র সন্নিবেশিত থাকবে বলে জুলাই ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে। স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রাপ্ত ক্ষমতা হচ্ছে বড় ম্যান্ডেট, the solemn expression of the will of the people (জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে)। আলাদা সংসদের বা নির্বাচিত সরকারের অনুমোদনের প্রয়োজন নেই। রাষ্ট্রপতির প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বা গণভোটের মাধ্যমে এখনই বলবৎ করা যায়, দেয়া যায় আইনি ভিত্তি। তিনটি উপায়ে জনগণের ম্যানডেট নেয়া যায়: নির্বাচন, গণভোট ও গণঅভ্যুত্থান। আবার তিনটি উপায়ে সরকার পরিবর্তন হয়: নির্বাচন, doctrine of necessity এর আওতায় সেনাঅভ্যুত্থান ও গণঅভ্যুত্থান। উল্লেখিত দুটি ক্ষেত্রেই গণঅভ্যুত্থানের মর্যাদা, ডিগ্রী ও অবস্থান সবার উপরে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ওয়াদা ও কমিটমেন্ট রক্ষা করার ইতিহাস মোটেই সুখকর নয়। নব্বই দশকের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় প্রস্তুতকৃত এক্যমত্য হওয়া তিনজোটের রূপরেখার কথা জাতির মনে থাকার কথা। পরবর্তি নির্বাচিত সরকারগুলো তিনজোটের ঐ রূপরেখা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করেনি। সুতরাং অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়- জুলাই ঘোষণাপত্রকে যদি এখনই আইনি ভিত্তি না দিয়ে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের উপর রেখে দেয়া হয় তাহলে জুলাই ঘোষণাপত্র নব্বই দশকের তিন জোটের রূপরেখার ভাগ্যবরণ করতে পারে এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থানে দেশে বড় রকমের একটা ওলটপালট ঘটে গেছে। বাংলাদেশের শত বছরের গণ-আন্দোলনের ইতিহাসে এটি ছিল অনন্য। তাই এটির একটি রাষ্ট্রীয় বয়ান থাকা অত্যাবশ্যক। রাজনীতির ভেতরে ও বাইরে সবার একটা চাওয়া ছিল, একটা ঘোষণাপত্র থাকা উচিত, যেখানে গণঅভ্যুত্থানের পটভূমি এবং জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন থাকবে। আন্দোলন যখন শুরু হয়, তখন তার গতি-প্রকৃতি ছিল এক রকম। তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় আন্দোলনের চরিত্র ক্ষণে ক্ষণে পাল্টাতে থাকে এবং একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে এটি সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। ঘটনার আকস্মিকতায় তখন কেউ বুঝে উঠতে পারেনি বা হৃদয়ঙ্গম করতে পারেনি যে এর একটি সুস্পষ্ট দলিল থাকতে হবে, যেমনটি ছিল উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ১১ দফা দাবির মধ্যে।
কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ঘোষিত ঘোষণাপত্র অনেকটা দায়সারা গোছের মনে হয়েছে। এতে অনেক কিছু মিসিং। ইতিহাসের কিছু বাঁককে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। গত দেড় যুগের প্রাসঙ্গিক একাধিক ঘটনা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। দেড় কোটি প্রবাসীদের অবদানের স্বীকৃতি অনুপস্থিত। তাই অনেক তোড়জোড় করে দেয়া জুলাই ঘোষণাপত্রকে “পর্বতের মূষিক প্রসব” বললে সম্ভবত: অত্যুক্তি হবে না।
তবে এখনও সময় আছে। জুলাই ঘোষণাপত্রটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। এটির ঐতিহাসিক মূল্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। তাই জুলাই ঘোষণাপত্রটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পুনর্বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা দরকার যাতে এটি গণঅভ্যুত্থান-উত্তর জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার সঠিক প্রতিফলন হয়। সংশ্লিষ্টরা উপরের পর্যালোচনাগুলো বিবেচনায় নিতে পারেন।
নাজির আহমদ: বিশিষ্ট আইনজীবী, রাষ্ট্র চিন্তক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার।
email: ahmedlaw2002@yahoo.co.uk
(মতামত লেখকের নিজস্ব)