মিয়ানমার আরেকটি সেনা অভ্যুত্থানের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে

জ্যেষ্ঠ জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের নেতৃত্বে জান্তা সরকারের ক্ষমতার মুঠো আলগা হয়ে যাওয়ার অনেকেই অসন্তুষ্ট হয়ে উঠছেন।

মিয়ানমারে সংকট ক্রমাগত ঘনীভূত হচ্ছে। দেশটির সেনাবাহিনী পিপলস ডিফেন্স ফোর্স ও অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীর কাছে ক্রমাগত ভিত্তি হারাচ্ছে সেনাবাহিনী। এ প্রেক্ষাপটে আরেকটি সেনা অভ্যুত্থানের অশুভ আশঙ্কা দেশটির সামনে দেখা দিয়েছে। জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যেই অসন্তোষ দানা বেঁধেছে। জ্যেষ্ঠ জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের নেতৃত্বে জান্তা সরকারের ক্ষমতার মুঠো আলগা হয়ে যাওয়ার সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের অনেকেই বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন।

যাহোক, এর থেকেও বেশি উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এরপর যিনিই ক্ষমতা কুক্ষিগত করবেন, বর্তমান জান্তাপ্রধানের থেকেও তিনি বেশি নিষ্ঠুর ও নিপীড়ক হবেন।

গত বছর আমরা মিয়ানমারের জনগণের দিক থেকে অনন্যসাধারণ প্রতিরোধ দেখেছি। সামরিক সরকার সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন ব্যাপকভাবে বাড়ানোর পরও তাঁরা গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার দাবি করেছেন। পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের উত্থান জান্তা সরকারকে আরও বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। সাধারণ জনগণ ও সেনাবাহিনী নিয়ে হতাশ সেনারা মিলে এই জনগণের এই প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে উঠেছে। একেকটা করে দিন যাচ্ছে আর জান্তা সরকার ক্রমাগতভাবে নিজেদের বিচ্ছিন্ন ও পরাজিত অবস্থায় দেখতে পাচ্ছে।

এই বিশৃঙ্খলা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে আরেকটি সামরিক অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা মোটেই খারিজ করে দেওয়া যাবে না। বিদ্রোহী ও ভিন্নমতাবলম্বী জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাদের নিয়ে সেনা নেতৃত্বের মধ্যে উপদল গঠনের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। ফলে সেনাবাহিনীর ভেতরে ক্ষমতার লড়াইয়ের উর্বর ক্ষেত্রে হয়ে উঠেছে। বর্তমান সংকট মোকাবিলা ও বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থতা মিন অং হ্লাইংয়ের নেতৃত্বকে বড় ধরনের পরীক্ষার মুখে ফেলেছে। সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থদের মধ্যে এই অসন্তোষ বিদ্রোহী জেনারেলদের নতুন অভ্যত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার পথ তৈরি করে দিয়েছে।

যাহোক, বর্তমান জান্তা সরকার জনসাধারণের ওপর যে নিষ্ঠুরতা চালিয়েছে, সেই বিবেচনা থেকে মিয়ানমারে নতুন একটি সেনা সরকার আসার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে সেটি নিঃসন্দেহে ভীতিকর। এখানে ভয়টা একেবারে বাস্তব যে অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই নতুন কেউ ক্ষমতায় বসলেই ভিন্নমতাবলম্বীদের দমন ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য আরও কঠোর পদক্ষেপ নেবে। মিয়ানমারের বর্তমান জান্তা সরকার ইচ্ছেমতো গ্রেপ্তার, নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে যে রকম নৃশংসতা চালিয়েছে, সেটা আমাদের সামরিক বাহিনীর নির্দয় কৌশলকে মনে করিয়ে দেয়।

মিয়ানমারে আরেকটি সেনা অভ্যুত্থান হলে তার যে প্রভাব পড়বে, সেটাকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় খাটো করে দেখতে পারে না। দেশটির সংকট এরই মধ্যে মানবিক বিপর্যয় তৈরি করেছে। লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। তাঁরা খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকিতে পড়েছেন। নতুন শক্তিতে বলীয়ান সামরিক জান্তা সহিংসতার নতুন যে ঢেউ শুরু করবে, তা বেসামরিক জনসাধারণের দুর্ভোগ আরও অসহনীয় করে তুলবে এবং দেশটিকে আরও অস্থিরতার মধ্যে টেনে নিয়ে যাবে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে আসিয়ানকে (অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট নেশনস) এই পরিস্থিতির জন্য অবশ্যই প্রস্তুত হতে হবে।  মিয়ানমারের সংকটে কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে, তার জন্য আসিয়ানকে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করতে হবে।

সবার আগে আসিয়ানকে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের প্রতি তাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করতে হবে। সামরিক পদক্ষেপের মাধ্যমে জনগণের যেকোনো ধরনের অধিকার হরণের ঘটনার সমস্বরে নিন্দা জানাতে হবে। মিয়ানমারে একটি বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অব্যাহতভাবে আহ্বান জানিয়ে যেতে হবে।

আঞ্চলিক সংঘ হিসেবে আসিয়ানের গ্রহণযোগ্যতা, স্বৈরতন্ত্র ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে এই মৌলিক মূল্যবোধ কতটা ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে পারছে, তার ওপর নির্ভর করবে।

এ ছাড়া আসিয়ানকে সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানে কূটনৈতিক মধ্যস্থতা ও আলাপ-আলোচনার পথ খোলা রাখা উচিত। সামরিক জান্তা, বেসামরিক বিরোধী পক্ষ ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের মধ্যে সংলাপের ব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমানে এ ধরনের সংলাপের বাস্তবতা একেবারেই অনুপস্থিত, কিন্তু কূটনৈতিক চাপ ও সহযোগিতার বিনিময়ে প্রণোদনা দেওয়ার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন করা সম্ভব।

উপরন্তু নতুন মাত্রায় সহিংসতা শুরু হলে আসিয়ানকে মানবিক সহায়তা ও বেসামরিক জনসাধারণের দুর্ভোগ যাতে কমিয়ে আনা যায়, সে জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সংঘাতকবলিত এলাকা ও বাস্তুচ্যুত মানুষদের খাবার, আশ্রয় ও চিকিৎসাসেবা দেওয়ার প্রস্তুতি রাখতে হবে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার শাস্তির হাত থেকে বাঁচতে যাঁরা দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন, তাঁদের শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় দিতে হবে।

একই সময়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মিয়ানমারের জান্তা সরকারকে পরিষ্কার বার্তা দিতে হবে যে আর কোনো সহিংসতা সহ্য করা হবে না। মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে। জাতিসংঘের মতো বহুপক্ষীয় সংস্থায় চাপ তীব্র করতে হবে। সামরিক জান্তা যেন বুঝতে পারে তাদের কর্মকাণ্ডের পরিণতি তাদের ভোগ করতে হবে এবং তাদেরকে খুব নিবিড়ভাবে দেখছে।

মিয়ানমারে আরেকটি সেনা অভ্যুত্থানের যে বাস্তবতা দেখা দিয়েছে, সেটাকে উপেক্ষা করার কোনো উপায় নেই। বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর আক্রমণ যত তীব্র হচ্ছে এবং সেনাবাহিনীর ভেতরে বিরোধিতা যত বাড়ছে, অসন্তুষ্ট সেনা কর্মকর্তাদের দ্বারা আরেকটি অভ্যুত্থানের ঝুঁকি ততই তীব্র হচ্ছে।

  • আজিম ইব্রাহিম, ওয়াশিংটনের নিউ লাইনস ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসির একজন পরিচালক
    আরব নিউজ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত
  • prothom alo