তল্লাশি ধরপাকড় ভয়ভীতি : ডেটলাইন ২৮ অক্টোবর

 

উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার পারদ চড়ানো সেই ২৮ অক্টোবর চলেই এলো। আর এক দিন পেরোলেই সেই উত্তেজনার ক্ষণ। কোন দিকে যাচ্ছে রাজনীতি, কাল কী হবে রাজপথে। রাজধানীর নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে মহাসমাবেশ করার অনুমতি মিলবে কি বিএনপির? নাকি খোলা মাঠে সাজাতে হবে সমাবেশ মঞ্চ? মহাসমাবেশ ঘিরে জনমনেও আছে ভয়ভীতি। একই দিন আওয়ামী লীগসহ একাধিক রাজনৈতিক সংগঠনও কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে। ২৮ অক্টোবর ঘিরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাল্টাপাল্টি কথার যুদ্ধে রাজনীতির ময়দান এখন প্রবল উদ্দীপনায় ঠাসা।

গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বড় দুই দলের সমাবেশস্থল বিষয়ে ফয়সালা হয়নি। পুলিশের চিঠির জবাবে বিএনপির তরফ থেকে গতকাল জানানো হয়েছে, নয়াপল্টনেই মহাসমাবেশ করতে তারা অটল। আওয়ামী লীগও চিঠি দিয়ে পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছে, বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটেই তারা সমাবেশ করবে।

এদিকে গতকাল রাতে সমকালকে একটি সূত্র জানায়, নাটকীয়ভাবে সিদ্ধান্ত বদল না হলে পছন্দের ভেন্যুতেই দুই দলকে তাদের কর্মসূচি পালনের অনুমতি দেবে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিবি)। সেই ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছে পুলিশ। আজ শুক্রবার পুলিশের তরফ থেকে আওয়ামী লীগ-বিএনপিকে সে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হতে পারে।

বিএনপির কর্মসূচি সামনে রেখে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় ধরপাকড় শুরু করেছে বলে অভিযোগ করেছেন দলটির নেতারা। বুধবার ভোর থেকে বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত চার শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। রাজধানীতে গত পাঁচ দিনে রাজনৈতিক মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত ৩১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তবে বিএনপি দাবি করেছে, সারাদেশে পাঁচ দিনে তাদের দেড় সহস্রাধিক নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে।

রাজধানীর প্রবেশমুখসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার মহাসড়কে বাড়তি চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি শুরু করেছে পুলিশ ও র‍্যাব। কোথাও কোথাও বাসযাত্রীকে তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আমিনবাজার, সাভার ও কেরানীগঞ্জে ঢাকার প্রবেশমুখগুলো বাড়তি নজরদারিতে রাখা হয়েছে। ঢাকাগামী বিভিন্ন যানবাহন থামিয়ে যাত্রীদের গন্তব্যস্থল, কোথায় থেকে এসেছেন এবং কী প্রয়োজনে ঢাকা যাচ্ছেন– এসব প্রশ্ন করা হচ্ছে। অনেকের কাছে জানতে চাওয়া হচ্ছে তাদের পেশাগত পরিচয়। চেকপোস্টে গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ ও মালপত্র তল্লাশির কারণে কোনো কোনো এলাকায় যানবাহন চলাচলে কিছুটা ধীরগতি লক্ষ্য করা গেছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) ড. খ. মহিদ উদ্দিন সমকালকে বলেন, সমাবেশের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কাছে কিছু বিষয় জানতে চেয়েছি। চিঠি দিয়ে দুই দলই তা জানিয়েছে। ভেন্যু ও সমাবেশের অনুমতির বিষয়ে আমরা নানা ধরনের গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখছি। অনুমতি দেওয়ার বিষয়ে পুলিশ ইতিবাচক বিবেচনা করছে। কে কোথায় অনুমতি পারে সে সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। আজ হয়তো ডিএমপি কমিশনার মতামত জানিয়ে দেবেন।

ধরপাকড় ও তল্লাশির ব্যাপারে তিনি বলেন, তল্লাশি পুলিশের নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ। কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘিরে কাউকে আটক করা হচ্ছে না। যাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে তাদের ধরা হচ্ছে।

এর আগে গতকাল দুপুরে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (অপারেশন) বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, পুলিশ যেখানে অনুমতি দেবে সেখানে সমাবেশ করতে হবে। রাজনৈতিক নেতারা কর্মীদের চাঙা রাখার উদ্দেশ্যে অনেক কিছুই বলেন। আমরা সেটিকে বিবেচনায় নিচ্ছি না। আইনে কী আছে, আমরা সেটা বিবেচনা করব। ডিএমপির যে অর্ডিন্যান্স আছে, সেখানে বলা আছে, ঢাকা শহরে কোনো সভা-সমাবেশ করতে হলে অবশ্যই কমিশনারের অনুমতি নিতে হবে। কেউ যদি অনুমতি না নেয়, সেটি আইন অমান্য হবে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি হলে তা মোকাবিলার সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে পুলিশ। সুষ্ঠুভাবে সমাবেশ সম্পন্ন হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এক ধরনের ভূমিকায় থাকবে। আর সমাবেশ ঘিরে কেউ ‘বসে পড়ার’ চিন্তা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ঢাকায় থাকবে বিভিন্ন স্তরের নিরাপত্তা। পল্টন এলাকা ঘিরে থাকবে নিশ্ছিদ্র বলয়। এ ছাড়া জামায়াতের কর্মকাণ্ডের ওপর আলাদাভাবে নজর রাখছে গোয়েন্দারা।

নয়াপল্টনেই মহাসমাবেশ করতে চায় বিএনপি

২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশের জন্য নয়াপল্টনের বিকল্প খোঁজাসহ সাত তথ্য জানতে পুলিশ যে চিঠি দিয়েছিল, এর জবাব দিয়েছে বিএনপি। দলটি বলেছে, মহাসমাবেশ তারা নয়াপল্টনেই করতে চায়। বিকল্প কোনো স্থানে তাদের পক্ষে যাওয়া সম্ভব না। ওই দিনের সমাবেশে এক থেকে সোয়া লাখ লোক হতে পারে বলেও দলটি উল্লেখ করেছে তাদের চিঠিতে। গতকাল বিএনপির পক্ষে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এ চিঠি দিয়েছেন পুলিশকে।

সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে মহাসমাবেশ করার জন্য পুলিশকে চিঠি দিয়েছিল বিএনপি। তাদের চিঠির জবাবে বুধবার বিকল্প দুটি স্থানের নামসহ সাত তথ্য চেয়েছে পুলিশ। সেই চিঠিতে সমাবেশে লোকসমাগমের সংখ্যা, সময়, বিস্তৃতি, কোন কোন স্থানে মাইক লাগানো হবে, অন্য দলের কেউ উপস্থিত থাকবেন কিনাসহ সাতটি তথ্য জানতে চাওয়া হয়। বিএনপি বৃহস্পতিবার পুলিশকে পাল্টা চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, তাদের মহাসমাবেশ ওই দিন দুপুর ২টায় শুরু হবে এবং মাগরিবের আজানের আগে শেষ হবে। সমাবেশের বিস্তৃতি প্রসঙ্গে বিএনপি বলেছে, সমাবেশটি পশ্চিমে বিজয়নগর মোড় ও পূর্বে ফকিরাপুল মোড় পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। বিজয়নগর মোড় ও ফকিরাপুল মোড় পর্যন্ত কিছুদূর অন্তর অন্তর মাইক লাগানো হবে। আগামীকাল শনিবারের সমাবেশে বিএনপি ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা অংশগ্রহণ করবেন না। সমাবেশের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য দলের ৫০০ স্বেচ্ছাসেবক দায়িত্ব পালন করবেন বলে জানায় বিএনপি।

এদিকে গণতন্ত্র মঞ্চকে ২৮ অক্টোবর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে কর্মসূচি পালনের অনুমতি দিয়েছে পুলিশ।

আওয়ামী লীগ চায় বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেট

পুলিশের তরফ থেকে একই ধরনের একটি চিঠি আওয়ামী লীগকেও দেওয়া হয়েছিল। সেখানেও দলটির পছন্দের স্থান বায়তুল মোকাররম মসজিদের বিকল্প দুটি স্থানের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল। জবাবে দলটি জানিয়েছে, ২৮ অক্টোবর শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশ জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে আয়োজনের জন্য সব প্রস্তুতি এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। এ অবস্থায় স্বল্প সময়ের মধ্যে অন্য কোনো ভেন্যুতে নতুনভাবে সমাবেশের প্রস্তুতি নেওয়া দুরূহ। চিঠিতে আরও জানানো হয়, সমাবেশে লোকসমাগম সকাল ১০টা থেকে শুরু হবে এবং সন্ধ্যা ৭টায় শেষ হবে। প্রায় ২ লাখ লোক জমায়েতের প্রস্তুতি রয়েছে। সমাবেশ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেট থেকে পল্টন মোড়, জিপিও মোড়, শিক্ষা ভবন, গোলাপ শাহ মাজার, নতুন ভবন, নবাবপুর সড়ক, মহানগর নাট্যমঞ্চ, দৈনিক বাংলা মোড়, মতিঝিল সড়ক এবং স্টেডিয়াম পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। সমাবেশে বক্তব্য প্রচারের জন্য উল্লিখিত স্থানে মাইক স্থাপন করা হবে। সমাবেশে আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মী, সমর্থক, নারী সংগঠন, তরুণ প্রজন্ম ও সর্বস্তরের জনগণ অংশ নেবে। সমাবেশে অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা হবে।

তল্লাশি ও ধরপাকড়

সাভারে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন অংশে বিভিন্ন যানবাহনে যৌথভাবে তল্লাশি চালিয়েছে র‍্যাব ও ঢাকা জেলা ট্রাফিক পুলিশ। এ ছাড়া ধামরাইয়ের ইসলামপুর এলাকায় মহাসড়কে তল্লাশি চালাচ্ছে স্থানীয় পুলিশ। সকাল ১০টার দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ঢাকাগামী সড়কে বিভিন্ন পরিবহন থামিয়ে চালকদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে দেখা যায়। বৃহস্পতিবার বিকেলে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী বুড়িগঙ্গা প্রথম সেতুর দক্ষিণ দিক ইকুরিয়া এলাকায় গণপরিবহনে তল্লাশি চালানো হয়। ঢাকা জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সাভার সার্কেল) শাহিদুল ইসলাম বলেন, রাজধানীর সমাবেশ ঘিরে কেউ যেন ঢাকায় প্রবেশ করে নাশকতা বা বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে না পারে, সে জন্য তল্লাশি জোরদার করা হয়েছে। মূলত এটি রুটিন কাজেরই অংশ। ঢাকার প্রবেশমুখে যাত্রাবাড়ী, ডেমরার সুলতানা কামাল ব্রিজ এলাকায় চেকপোস্ট এবং নিরাপত্তা জোরদার করেছে র‍্যাব। এসব স্থানে যাত্রীদের মোবাইল ফোন ও ব্যাগ তল্লাশি করতে দেখা গেছে।

চট্টগ্রামে গতকাল বিএনপির সাত নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। বৃহত্তর ফরিদপুরের চার জেলায় ৫৪ বিএনপি নেতাকর্মী, গাজীপুরের টঙ্গীতে শ্রমিক দলের সভা চলাকালে অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পিরোজপুরের ইন্দুরকানীতে গত বুধবার রাতে কালাইয়া গ্রামের এক জামায়াত সমর্থককে আটক করেছে পুলিশ। এ ছাড়া গতকাল সকাল থেকে পুলিশ ঢাকাগামী যাত্রীদের তল্লাশি করছে। মেহেরপুরের মুজিবনগরে জামায়াতের ৫ নারীকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে উপজেলার আনন্দবাস গ্রামের আসাদুল ময়রার বাড়িতে বৈঠককালে তাদের আটক করা হয়। পাবনার সাঁথিয়ায় পুলিশ অভিযান চালিয়ে বিএনপি-জামায়াতের চার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। গত বুধবার রাতে ও বৃহস্পতিবার দুপুরে বিএনপির দুই নেতাকর্মীকে পুলিশ আটক করেছে। ঢাকাগামী যানবাহনে তল্লাশি করা হচ্ছে। নেতাকর্মীকে ঢাকায় যেতে বাধা দিচ্ছে পুলিশ। ফেনীর ফুলগাজী থেকে ২ বিএনপি নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

টাঙ্গাইলের ১০ বিএনপি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। খুলনা বিভাগজুড়ে বিএনপি নেতাকর্মীর বাড়ি বাড়ি তল্লাশি ও ধরপাকড় চলছে। দু’দিনে বিভাগের ১০ জেলা থেকে বিএনপির ১০৫ নেতাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। রাজশাহী বিভাগ বিএনপির দুই শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বুধবার মধ্যরাতে ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলা যুবদলের সভাপতিসহ ৫ জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। গতকাল বিকেলে বরিশাল নগরীতে র‍্যাব চেকপোস্ট বসিয়ে যাত্রীদের তল্লাশি করে। বরগুনার পাথরঘাটার কাকচিড়া লঞ্চঘাটে ঢাকামুখী নেতাকর্মীর ওপর হামলা করে আওয়ামী লীগ। দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদকসহ ২ নেতাকে আটক করে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।

উচ্চ আদালত থেকে জামিনের পর মুক্তির সময় গতকাল সন্ধ্যায় বাগেরহাট কারাগারের ফটক থেকে বিএনপির ১২ এবং জামায়াতের ৯ নেতাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। কিশোরগঞ্জে জেলা শ্রমিক দল সভাপতি সালাহ উদ্দিন বাচ্চু ও নিকলী উপজেলা শ্রমিক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ফরিদ উদ্দিনকে গতকাল পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।

সূত্র : সমকাল