তপশিল ঘিরে বাড়ছে জটিলতা: প্রত্যাখ্যান করে আসছে কঠোর কর্মসূচি

নির্দলীয় সরকারের অধীনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের দাবি আদায় ছাড়া ‘শেষ মুহূর্তেও’ ভোটে যাবে না বিএনপি ও সমমনারা। শেষ মুহূর্তে বিএনপি নির্বাচনে যাবে বলে আওয়ামী লীগ নেতাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্য নাকচ করে দিয়েছেন আন্দোলনরত নেতারা।

তারা বলছেন, আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। দরকার হলে আরও কিছুদিন মামলা-হামলা, গ্রেপ্তারসহ অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হবেন। একই সঙ্গে সরকারকে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের মতো আবারও একতরফা নির্বাচনের পরিকল্পনা বাতিল করে শুভবুদ্ধির পরিচয় দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক সংকট সমাধান ছাড়া তড়িঘড়ি করে তপশিল ঘোষণা থেকে বিরত থাকার কঠোর হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করেছেন বিরোধী নেতারা।

তাদের বক্তব্য, প্রয়োজনে তপশিল প্রত্যাখ্যান করে দাবি আদায়ে দেশ অচল করে দেওয়া হবে। গণতন্ত্রের স্বার্থে ‘অলআউট’ আন্দোলনে যাওয়া ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো বিকল্প থাকবে না। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আন্দোলনের নানা বিকল্প কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করছেন বিএনপি নেতারা। এ ক্ষেত্রে অবরোধের সঙ্গে হরতাল, ঢাকা অবরোধ বা ১০০ পয়েন্টে বিক্ষোভ সমাবেশ এবং এক পর্যায়ে অসহযোগ কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করার পরিকল্পনা রয়েছে। একই সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে সমমনা ৩৬ দলের বাইরে থাকা বিরোধী দলগুলোকে এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশাসহ জনগণকে আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত করারও জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন বিরোধী নেতারা।

বিএনপিসহ সমমনাদের দেশজুড়ে তৃতীয় দফা অবরোধ শেষে আবারও ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণার পরও কঠোর অবস্থানেই সরকার। গত ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সহিংসতার জেরে দলের শীর্ষ নেতাসহ প্রায় ১০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন দলটির নেতারা। গত বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় নেতাদের বিএনপি শেষ মুহূর্তে নির্বাচনে আসবে ধরে নিয়েই প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। আবার একই দিন রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে দেখা করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, সংবিধানের বাধ্যবাধকতার কারণে যে কোনো পরিস্থিতিতে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন করতে হবে। আগামী সপ্তাহে নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করা হবে বলেও জানান তিনি।

বিএনপি ও সমমনা দলীয় সূত্র জানায়, চলমান যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপির সমমনা ৩৬ দলের বাইরে অন্য বিরোধী দলগুলোকেও একসঙ্গে রাজপথে নামানোর চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যে দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে বিএনপির। তারা আশাবাদী, অচিরেই বিরোধী দলগুলো একসঙ্গে চূড়ান্ত আন্দোলনে শরিক হবে।

সূত্র জানায়, চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন এবং সিপিবি-বাসদের নেতৃত্বাধীন বাম জোটসহ অন্যান্য ছোট বাম-ইসলামী দল আন্দোলনের সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছতে পারে। একই সঙ্গে ইসলামী আন্দোলন বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। সামনে দাবি আদায়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন সমমনা জোটের সঙ্গেও মিল রেখে কর্মসূচি দিতে পারে তারা। বাম জোটের নেতারাও একই দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে নেই তারা। পৃথকভাবে আন্দোলন করলেও সামনের দিনগুলোতে তারা পৃথক মঞ্চ থেকে একই সময়ে যুগপৎ কর্মসূচি পালন করতে পারে।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, অত্যাচার-নির্যাতন করে অবৈধ সরকারের শেষ রক্ষা হবে না। অতীতে কোনো স্বৈরশাসক জনগণের দাবির বিপক্ষে গিয়ে টিকতে পারেনি, তারাও পারবে না। খুব দ্রুত সরকারকে জনগণের দাবি মেনে নিয়ে নির্দলীয় সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানান তিনি।

বিএনপি সূত্র জানায়, দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির যেসব নেতা আত্মগোপনে রয়েছেন, তারা নিয়মিত ভার্চুয়াল সভা করছেন। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে সভাগুলোতে আন্দোলনের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন। একই সঙ্গে সমমনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরবর্তী কর্মসূচি প্রণয়নের জন্য নেতাদের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে।

বিএনপির অন্যতম সমমনা জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহিদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনারই নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নেই বলে এখন তপশিল ঘোষণার কথা বলছেন। ইসির উচিত– অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক ভোট অনুষ্ঠানে সরকারকে রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য ন্যায়সংগত চাপ দেওয়া। তা না করে তল্পিবাহক হিসেবে একতরফা নির্বাচনের পথে হাঁটে, তাহলে দেশে উদ্ভূত যে কোনো পরিস্থিতির জন্য তারা দায়ী থাকবে।

সূত্র জানায়, দলের সাবেক মন্ত্রী-এমপি এবং আগামী নির্বাচনে সম্ভাব্য মনোনয়নপ্রত্যাশী ও কেন্দ্রীয় নেতাদের নিজ নিজ এলাকায় যেতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তৃণমূল নেতাদের পাশে থেকে আন্দোলন জোরদার করার ক্ষেত্রে তাদের গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব ও ভূমিকা রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রের নির্দেশনা পেয়ে এরই মধ্যে নেতারা নিজ নিজ এলাকায় চলে গেছেন। অনেকে গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে থেকে নেতাকর্মীকে নির্দেশনা দিচ্ছেন। দলীয় হাইকমান্ড সবাইকে গ্রেপ্তার এড়িয়ে আন্দোলনে ভূমিকা রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। একই সঙ্গে যেসব জেলা, মহানগরসহ বিভিন্ন স্তরের কমিটির শীর্ষ নেতারা আটক হচ্ছেন, সেখানে পরবর্তী পদের নেতাকে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে।

বিএনপির কয়েকজন নেতা জানান, কেন্দ্রীয়, জেলা, মহানগর ও উপজেলা পর্যায়ের শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার ও মামলা দিয়ে লাভ হচ্ছে না। তৃণমূল নেতারাই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। গ্রেপ্তার এড়াতে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা ধানক্ষেতে ও বন-জঙ্গলে রাতযাপন করছেন। এ করুণ পরিস্থিতি থেকে দেশ, গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে বর্তমান স্বৈরশাসকের পতনের এক দফা আন্দোলন সফল করেই তারা ঘরে ফিরবেন।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, নির্বাচন কমিশন নিজেরাই বলেছে, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের চাপ তাদের বহন করতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বিরোধী দলকে বাইরে রেখে তপশিল দিলে বাস্তবে তারাও একতরফা নির্বাচনের সহযোগী হবে। উচিত ছিল আগে সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ তৈরি করা। না হয় একযোগে পদত্যাগ করা। তিনি বলেন, সরকার যতই চেষ্টা করুক, মানুষ প্রতিরোধ করবে। গায়ের জোরে যেতে চাইলে অনাকাঙ্ক্ষিত ও গৃহযুদ্ধের দিকে দেশকে ঠেলে দেবে সরকার।