আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো মামলায় একজন আসামি ‘অ্যাপ্রুভার’ হলেন। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন গত বৃহস্পতিবার অ্যাপ্রুভার (দোষ স্বীকার করে ঘটনার সত্য বিবরণ প্রকাশ করেন যে আসামি, সাধারণত তিনি রাজসাক্ষী হিসেবে পরিচিত) হওয়ার আবেদন করলে তা মঞ্জুর করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
ট্রাইব্যুনাল আইনের ১৫ ধারায় অ্যাপ্রুভারের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। এই ধারার শিরোনাম ‘পারডন অব এন অ্যাপ্রুভার’। বাংলায় বিষয়টিকে ‘দোষ স্বীকারকারী সাক্ষীর ক্ষমা’ বলা যেতে পারে।
ট্রাইব্যুনাল আইনের ১৫ নম্বর ধারায় তিনটি উপধারা রয়েছে। এর মধ্যে উপধারা-১–এ কী করলে একজন দোষ স্বীকারকারী সাক্ষী (যিনি আগে আসামি ছিলেন) ক্ষমা পেতে পারেন, সে সম্পর্কে বলা আছে। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, বিচারের যেকোনো পর্যায়ে ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তিকে ট্রাইব্যুনাল এই শর্তে ক্ষমা করতে পারেন যে সেই ব্যক্তি ঘটনার মূল হোতা বা সহায়তাকারীসহ পুরো ঘটনা সম্পর্কে যা জানেন, সে বিষয়ে সম্পূর্ণ সত্য বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করবেন; অর্থাৎ অপরাধের কোনো ঘটনা সম্পর্কে পূর্ণ ও সত্য তথ্য প্রদান করার শর্তে দোষ স্বীকারকারী সাক্ষীকে ক্ষমা করতে পারেন ট্রাইব্যুনাল।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের আগে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জড়িত কোনো আসামি অ্যাপ্রুভার হননি বলে প্রথম আলোকে জানান ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম। গতকাল শুক্রবার দুপুরে তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, অ্যাপ্রুভার একটি সুবিধা, এটি একটি প্রক্রিয়াও। একটি প্রস্তাব থেকে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়। সাবেক আইজিপি মামুন সেই প্রস্তাব দিয়েছেন। ট্রাইব্যুনাল তা গ্রহণ করেছেন। প্রক্রিয়া অনুযায়ী এখন তিনি সাক্ষ্য দেবেন, ট্রাইব্যুনাল তা বিবেচনা করবেন। তারপর এ মামলার রায়ের সময় ট্রাইব্যুনাল সিদ্ধান্ত দেবেন। বিচারে ট্রাইব্যুনাল অ্যাপ্রুভারকে (রাজসাক্ষী) সম্পূর্ণভাবে মুক্তি দিতে পারেন, অল্প মাত্রায় সাজা দিতে পারেন কিংবা অন্য কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেন।
ট্রাইব্যুনাল আইনের ১৫ ধারার উপধারা-৩–এ বলা হয়েছে, বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেই ব্যক্তিকে (অ্যাপ্রুভার) কারাগারে রাখা হবে। সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এখন কারাগারে আছেন।
প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম প্রথম আলো বলেন, সাবেক আইজিপি মামুন ট্রাইব্যুনালের আইনে অ্যাপ্রুভার হয়েছেন। তাঁর ক্ষেত্রে শুধু ট্রাইব্যুনাল আইন প্রযোজ্য হবে। অ্যাপ্রুভার বিষয়ে দেশের অন্য আইন বিবেচিত হবে না।
ট্রাইব্যুনালে এটিই প্রথম
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন করা হয় ১৯৭৩ সালে। সেই আইনের আলোকে ২০১০ সালে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ২০১২ সালে আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়, যা ট্রাইব্যুনাল-২ নামে পরিচিতি পায়।
এ দুই ট্রাইব্যুনাল থেকে ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত ৫৫টি মামলায় রায় দেওয়া হয়েছে। এসব রায়ে সাজাপ্রাপ্ত আসামি ১৪৯ জন। তাঁদের মধ্যে ১০৬ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে। এই আসামিদের মধ্যে গত মার্চ পর্যন্ত পলাতক ছিলেন ৫০ জন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে জামায়েত ইসলামীর তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামীসহ শীর্ষ পর্যায়ের ছয়জনের ফাঁসি কার্যকর (২০১৩–২০১৬ সালে) হয়েছে।
ট্রাইব্যুনাল সূত্র বলছে, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় কোনো আসামি এখন পর্যন্ত ‘রাজসাক্ষী’ হননি।
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছরের অক্টোবরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। এখন দুটি ট্রাইব্যুনালেই গণ–অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং আওয়ামী লীগের বিগত দেড় দশকের শাসনামলে গুম–খুন–নির্যাতনসহ সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার গুরুত্ব পাচ্ছে।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের (রাষ্ট্রপক্ষ) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে গত ২৫ জুন পর্যন্ত ২৭টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২০৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৭৩ জনকে। কারাগারে মৃত্যু হয়েছে এক আসামির। গ্রেপ্তার আসামিদের মধ্যে একমাত্র সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন করেছেন।
মামুনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আরও একটি মামলা
মানবতাবিরোধী অপরাধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত দুটি মামলা হয়েছে। একটি মামলায় তাঁর সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানও আসামি। এ মামলাতেই তিনি অ্যাপ্রুভার হয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে হওয়া অপর মামলায় মোট আসামি ২৩ জন। আসামিরা সবাই পুলিশ ও র্যাবের সাবেক সদস্য।
এ মামলার আসামিদের মধ্যে এখন পর্যন্ত আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সাবেক আইজিপি মামুন ছাড়াও গ্রেপ্তার অন্যরা হলেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান (র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালকও ছিলেন), ডিএমপির মিরপুর বিভাগের সাবেক উপকমিশনার (ডিসি) জসিম উদ্দিন মোল্লা, ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহিল কাফী, ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সাভার সার্কেল) মো. শাহিদুল ইসলাম, গুলশান থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাজহারুল হক, যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ও ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি-উত্তর) সাবেক পরিদর্শক মো. আরাফাত হোসেন। ২০ জুলাই এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার কথা রয়েছে।
সাবেক আইজিপি মামুনের আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ প্রথম আলোকে বলেন, একটি মামলায় শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন আসামি। আরেকটি মামলায় তিনি (মামুন) নিজেই প্রধান আসামি। একটি মামলায় অ্যাপ্রুভার হওয়ার প্রভাব অন্য মামলায় পড়বে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সেটা আমরা চিন্তা করছি, কী ধরনের অ্যাপ্লিকেশন (আবেদন) ট্রাইব্যুনালে দেওয়া যায়। এখনো সবকিছু ফাইনাল হয়নি।’
অ্যাপ্রুভার হওয়ার পর চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের নিরাপত্তার সংকট দেখা দিতে পারে বলে মনে করেন তাঁর আইনজীবী আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ। তিনি বলেন, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের যথাযথ নিরাপত্তা চেয়ে একটি আবেদন করা হয়েছে ট্রাইব্যুনালে।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এত দিন ‘ডিভিশন’ (কারাবন্দিদের জন্য বিশেষ সুযোগ–সুবিধা) পেয়ে আসছিলেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। নিরাপত্তা বিবেচনায় গত বৃহস্পতিবারই তাঁকে কারাগারের অন্য একটি কক্ষে (ডিভিশনসহ) সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই কক্ষে তিনি একাই থাকছেন বলে প্রথম আলোকে জানান তাঁর আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।
Source: Prothom Alo