ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খানের ঘনিষ্ঠ তিনি। নাহিয়ান খানের আনুকূল্যে তিনি ছাত্রলীগের ‘বড়’ নেতা হয়েছেন। এই পরিচয় ও প্রভাব ব্যবহার করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে অবৈধভাবে থাকেন। তাঁর কক্ষে আছে রেফ্রিজারেটর, এয়ার কুলার।
সম্প্রতি তিনি শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিয়েছেন। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, সরকারি চাকরিজীবীদের ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত থাকার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু তিনি এখনো দলীয় কার্যক্রমে যুক্ত থাকছেন। এই ‘সফল’ ও ‘প্রভাবশালী’ নেতার নাম এস এম রিয়াদ হাসান।
ছাত্রলীগের নেতারা বলছেন, নাহিয়ান খানের সঙ্গে রিয়াদের ঘনিষ্ঠতার প্রধান কারণ হলো—তাঁদের দুজনের গ্রামের বাড়ি বরিশাল জেলায়। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি রিয়াদ ছাত্রলীগের রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিলেন। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে নাহিয়ান খান সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব পান। তারপরই সংগঠনে ‘ব্যাপক’ সক্রিয় হয়ে ওঠেন রিয়াদ।
করোনাকালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থীর হলে থাকার সুযোগ ছিল না, তখনো রিয়াদ অবৈধভাবে হলে থেকেছেন। করোনাকালের কঠোর বিধিনিষেধ ভেঙে ক্যাম্পাসে তাঁর জন্মদিনও উদ্যাপিত হয়েছে।
রিয়াদ ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। কয়েক বছর আগেই তাঁর স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষ হয়েছে। গত ১ আগস্ট ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশনে সহকারী ব্যবস্থাপক হিসেবে যোগ দেন রিয়াদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, নিয়মিত স্নাতক-স্নাতকোত্তর কোর্সের শিক্ষার্থীদের বাইরে কারও হলে থাকার সুযোগ নেই। কিন্তু রিয়াদ রেফ্রিজারেটর-এয়ার কুলার নিয়ে জহুরুল হক হলের ৩১৩ নম্বর কক্ষটি দখল করে থাকছেন।
জহুরুল হক হলের একাধিক আবাসিক শিক্ষার্থী বলেন, হলে প্রশাসনের কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় রিয়াদ নির্বিঘ্নেই আছেন। ছাত্রলীগ সভাপতির ঘনিষ্ঠ এই নেতার আড়ম্বরভাবে হলে থাকার বিষয়টি ‘ওপেন সিক্রেট’।
হলের প্রাধ্যক্ষ আবদুর রহিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘হলের কক্ষে রেফ্রিজারেটরসহ কোনো অছাত্রের থাকার বিষয়টি আমার জানা নেই। হলের কক্ষে রেফ্রিজারেটর ব্যবহারের সুযোগ নেই। অছাত্র হয়ে কেউ হলে থেকে থাকলে বিষয়টি খুবই খারাপ। এ ব্যাপারে আমি খোঁজ নিচ্ছি।’
সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার রিয়াদ নতুন করে আলোচনায় আসেন তাঁর কয়েকজন অনুসারী-সমর্থকের ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে। রিয়াদ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি মনোনীত হয়েছেন—এমন একটি চিঠি তাঁর একাধিক অনুসারী-সমর্থক নিজেদের ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। পোস্টে তাঁরা রিয়াদকে শুভেচ্ছা-অভিনন্দন জানিয়েছেন। কিছু পোস্টের মন্তব্যের ঘরে রিয়াদ তাঁর অনুসারী-সমর্থকদের ‘ভালোবাসা’ জানিয়েছেন।
রিয়াদের ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি মনোনীত হওয়ার যে চিঠিটি ফেসবুকে পোস্ট করা হয়েছে, সেটি ইস্যুর তারিখ হিসেবে অবশ্য ৩১ জুলাইয়ের কথা লেখা রয়েছে। তার পরদিনই রিয়াদ সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন।
ছাত্রলীগ সভাপতির ঘনিষ্ঠ আরেক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘নাহিয়ান খান ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়ার আগে এক বছরের মতো রিয়াদ সংগঠনের রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। কিন্তু নাহিয়ান খান সভাপতি হওয়ার পর তিনি ব্যাপক সক্রিয় হয়ে ওঠেন। সভাপতির বিশ্বস্ত হওয়ায় রিয়াদই মূলত তাঁর সবকিছু দেখভাল করেন। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর পরামর্শ নেন সভাপতি। সভাপতির সুপারিশের কারণেই রিয়াদ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশনে চাকরিটি পেয়েছেন।’
নাহিয়ান খানের ঘনিষ্ঠ আরেক নেতা বলেন, ‘সরকারি চাকরিতে যোগদানের পর রিয়াদের সাংগঠনিক পদ স্বয়ংক্রিয়ভাবেই শূন্য হয়ে গেছে। তারপরও তিনি ছাত্রলীগের নিয়মিত কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। তিনি আগের মতোই সব ধরনের রাজনৈতিক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। আমরা যাঁরা সভাপতির সঙ্গে রাজনীতি করি, তাঁদের অনেকের ওপর রিয়াদ খবরদারি করেন।
এসব কারণে অনেকেই তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ।’ চাকরিজীবী হয়েও রিয়াদ যে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় গত এক মাসে তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া নানা পোস্টে।
সবশেষ গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় অংশ নেওয়ার ছবি তিনি পোস্ট করেছেন। ছবিতে তাঁকে ছাত্রলীগের সভাপতি নাহিয়ান খান ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের পাশে বসে থাকতে দেখা যায়।
অবৈধভাবে হলে থাকা, সরকারি চাকরিজীবী হয়েও ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত থাকার বিষয়ে জানতে গতকাল একাধিকবার রিয়াদের মুঠোফোনে কল করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। আজ শুক্রবার কল করা হলে রিং হয়। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি।
জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সভাপতি নাহিয়ান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিনি (রিয়াদ) সংগঠনের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বা সাংগঠনিক সম্পাদক হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এসব পদের কোনোটিই শূন্য না থাকায় আমরা তাঁকে তা দিতে পারিনি। তাঁকে সহসভাপতির পদ দেওয়া হয়। প্রত্যাশিত পদ না পাওয়ায় তাঁর মন খারাপ ছিল। যখন তাঁকে পদ দেওয়া হয়, তখন তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেননি। কিন্তু যেহেতু এখন তিনি চাকরিতে যোগ দিয়েছেন, তাই তাঁর পদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে শূন্য হয়ে গেছে।’