ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে

৩১ আগস্ট, ২০২২

মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ছাত্রলীগ যেন বেপরোয়া ও লাগামহীন হয়ে পড়েছে। দেশের সব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত ছাত্রলীগের একশ্রেণীর নেতা-কর্মী সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মাদকের কারবারসহ বেপরোয়া অগ্নিকান্ডসাধারণ শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত ও অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃশংস খুন-খারাবি, অগ্নিকান্ড, পিটিয়ে মিক্ষার্থী হত্যা, ছাত্রী ও নারী ধর্ষণের মত অসংখ্য অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়েছে ছাত্রলীগের একশ্রেণীর নেতা-কর্মী। হেন কোনো অপকর্ম নেই সংগঠনটির বিরুদ্ধে উঠছে না। একশ্রেণীর নেতা-কর্মীর অপকর্মের দায় নিতে হচ্ছে সংগঠনটিকে। একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সালের ৫ বছরে ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীণ কোন্দলে প্রাণ হারিয়েছে ৩৯ জন এবং প্রায় নিস্ক্রিয় প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনগুলোর ১৫ সদস্য তাদের হাতে নিহত হয়েছে। কখনো কখনো ছাত্রলীগের অগ্নিকান্ড এতটাই বিতর্কিত ও দৃষ্টিকটু হয়ে পড়েছে যে, এক সময় প্রধানমন্ত্রী বিরক্ত হয়ে ছাত্রলীগের অভিভাবকত্ব ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তারপরও সংগঠনটির অপকর্ম বন্ধ হয়নি। বরং দিন দিন বেড়ে চলেছে। কোথাও অপকর্ম ঘটলে সাময়িকভাবে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কর্মকান্ড স্থগিত করা এবং অভিযুক্তদের সংগঠন থেকে বহিষ্কার করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এ ধরনের পদক্ষেপকে পর্যবেক্ষকরা গুরুপাপে লঘুদন্ড হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এমন লঘু পদক্ষেপের কারণে ছাত্রলীগের একশ্রেণীর নেতা-কর্মীর অপরাধকর্ম থামেনি। আওয়ামী লীগের তৃতীয় মেয়াদের শেষ প্রান্তে এসে ছাত্রলীগের বেপরোয়া আচরণ যেন আরও গতি পেয়েছে।

ঐতিহ্যবাহী সংগঠনের কেন্দ্র থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও তৃণমূলের কিছু নেতাকর্মী এমনসব অপকর্মে জড়াচ্ছে, যা অচিন্তনীয়। ক্যাম্পাস ও হল দখল, সিট ও কমিটি বাণিজ্য, চাঁদা ও টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, শিক্ষার্থী নির্যাতন-হয়রানির মাত্রা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। তাদের এই অপকর্মে ছাত্র সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগের ইতিহাস ও ঐতিহ্য ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। ছাত্রলীগের সাবেক প্রথিতযশা নেতারাও তা স্বীকার করে বলেছেন, সংগঠনটির একশ্রেণীর নেতাকর্মীর এ ধরনের অপকর্ম ছাত্র রাজনীতির অন্তরায়। তারা বলেছেন, ছাত্র নেতারা দেশের ভবিষ্যত নেতা। তারাই যদি চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, খুন, ধর্ষণের মতো অপরাধকর্মে জড়িয়ে পড়ে তাহলে কিভাবে দেশে সুনেতৃত্ব সৃষ্টি হবে? তারা এ কথাও বলেছেন, ছাত্রলীগ নিয়ে যা শুনি তা আমাদের জন্য খুবই লজ্জার ও দুঃখের। এ সংগঠনের সাথে আমরা জড়িয়ে ছিলাম। এখন সংগঠনের নেতাকর্মীদের অপকর্মের কথা শুনলে খুব খারাপ লাগে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিগত এক যুগের অধিক সময় ধরে ঐতিহ্যবাহী সংগঠনটির নেতাকর্মীরা এমনসব অপরাধকর্মে জড়িয়েছে, যা সংগঠনটির ভাবমর্যাদাকে তলানিতে নিয়ে গিয়েছে। ২০১০ সালে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী আবুবকর সিদ্দিক এবং জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবায়ের আহমেদ। শিবিরকর্মী সন্দেহে দর্জি দোকানের কর্মচারি বিশ্বজিৎ দাসকে কুপিয়ে হত্যা করেছিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতারা। ফেনী নদীর পানি নিয়ে ভারতের সাথে অসম চুক্তির বিরোধিতা করে ফেসবুকে পোস্ট দেয়ায় বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফয়সালকে রাতভর পিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ২০২০ সালে করোনাকালে সিলেটের এমসি কলেজ চত্ত¡রে এক নারীকে ৯ ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর গণধর্ষণসহ এমন অসংখ্য অপকর্ম ছাত্রলীগের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের এহেন অপকর্মের ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে কখনো কখনো সংগঠন থেকে বহিষ্কার, গ্রেফতার করা হলেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না নেয়ার ফলে তাদের আচরণ আরও বেপরোয়া হয়ে উঠে এবং তা চলমান রয়েছে। ছাত্রলীগের অপকর্মের কারণে সরকারের উন্নয়ন এবং প্রশংসনীয় উদ্যোগগুলোর সাফল্য ¤øান হওয়ার কথাও এখন বিশ্লেষকরা বলছেন।

সরকারের তৃতীয় মেয়াদের শেষ প্রান্তে এসে ছাত্রলীগকে আগের চেয়ে বেপরোয়া ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে। বিএনপিসহ বিরোধীদলগুলোর সভা-সমাবেশে হামলার অগ্রভাগে থাকছে সংগঠনের নেতাকর্মীরা। বিএনপি জ্বালানি তেলসহ নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে সারাদেশে স্থানীয়ভাবে বিক্ষোভ সমাবেশ করছে। এসব সমাবেশ ভন্ডুল করতে ছাত্রলীগ বেপরোয়া ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। সমাবেশ পন্ড করতে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রের পাশাপাশি আগ্নেয়াস্ত্র ও মটরসাইকেল নিয়ে মহড়ার চিত্র গণমাধ্যমে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উঠে আসছে। গতকাল একাধিক জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সচিত্র প্রতিবেদনে দেখা যায়, মাগুরার শ্রীকোল ইউনিয়ন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আজাদুর রহমানকে ছাত্রলীগ-আওয়ামীলীগ কর্মীরা চাপাতি ও চাইনিজ কুড়াল দিয়ে প্রকাশ্য কোপাচ্ছে। এমন ভয়াবহ দৃশ্য কল্পনাও করা যায় না। ছাত্রলীগের অপকর্মের ছবি ও সংবাদ গণমাধ্যমে উঠে আসলেও তাদের বিরুদ্ধে মামলা বা গ্রেফতারের ঘটনা খুব কম দেখা যায়। যেকোনো ছাত্র সংগঠনের কাজ হচ্ছে, শিক্ষাঙ্গণে শিক্ষার পরিবেশ ও শিক্ষার অধিকার নিয়ে ভূমিকা রাখা। এর পরিবর্তে ছাত্রলীগের একশ্রেণীর নেতাকর্মীকে দেখা যায় বিভিন্ন অপকর্ম ও অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়াতে। গত একযুগে সরকারের সাফল্য অনেক। এ সাফল্য আগামী জাতীয় নির্বাচনে ভোটের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ছাত্রলীগের অপরাধমূলক কর্মকান্ড সেই সাফল্যকে এখন ম্লান করে দিচ্ছে। বিরোধীদল দমন-পীড়নে সংগঠনটিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ বিনষ্ট করে দিচ্ছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে ছাত্রলীগ যেন এখন সরকারের জন্য বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধীদলের সভা-সমাবেশ বানচাল করার ছাত্রলীগের এমন কর্মকান্ড রাজনৈতিক পরিবেশকে উত্তপ্ত করে তুলছে। এতে অনিবার্যভাবে এক সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি ও জননিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এমতাবস্থায়, সরকারের স্বার্থে ছাত্রলীগের অপকর্ম ও অপরাধমূলক কর্মকান্ডে লাগাম টেনে ধরা জরুরি।