নির্বাচনে সঙ্গী খুঁজতে এখনো ব্যস্ত আওয়ামী লীগ

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। তবে বিএনপিবিহীন নির্বাচনে বেশি বেশি দলকে ভোটের মাঠে নামানোর যে কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে ক্ষমতাসীনেরা, তাতে এখনো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। বিএনপি থেকে নেতাদের অনেকে বেরিয়ে এসে নতুন দল গড়বেন, অন্য দলে যোগ দেবেন বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনের ঘোষণা দেবেন—আওয়ামী লীগের এমন প্রত্যাশাও অনেকটা আলোচনার মধ্যেই এখনো সীমাবদ্ধ রয়েছে।

সংবিধান মেনে ও যথাসময়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে অনড় আওয়ামী লীগ। তবে এই নির্বাচনী যাত্রায় আওয়ামী লীগের সঙ্গী ও প্রতিদ্বন্দ্বী কারা হবে, এ বিষয়ে এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছে না ক্ষমতাসীন দলটি। অথচ বিএনপিবিহীন ভোটে বেশিসংখ্যক দলকে ভোটে আনা এবং তা তফসিল ঘোষণার আগেই চূড়ান্ত করার লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগের।

দলটির নীতিনির্ধারণী একাধিক সূত্র বলছে, নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ভোটের তফসিল ঘোষণা করা হবে, তেমন সম্ভাব্য সময় ধরে নিয়েই কৌশল সাজাচ্ছিল ক্ষমতাসীনেরা। এর মধ্যে তফসিল ঘোষণা না হওয়ায় বেশিসংখ্যক দল এবং বিএনপির নেতাদের নির্বাচনে নিয়ে আসার চেষ্টা অব্যাহত আছে। কারও কারও মত হচ্ছে—ভোটে অংশগ্রহণকারীদের বিষয়ে ধারণা পেতেই হয়তো রয়েসয়ে তফসিল ঘোষণার চেষ্টা আছে।

বিএনপি ও এর মিত্ররা আগামী নির্বাচন বর্জন করতে পারে—এমনটা আওয়ামী লীগের ভাবনায় অনেক আগে থেকেই ছিল। দলটির সূত্রগুলো বলছে, এ জন্য বিকল্প হিসেবে ভোটে অংশগ্রহণ বাড়াতে ১৪–দলীয় জোট ও মিত্রদের বাইরে অনেক ইসলামি দলের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে আওয়ামী লীগ। বিএনপির নেতাদের দল থেকে বের করে এনে ভোটে রাখার বিষয়েও তৎপরতা চলছে। লক্ষ্য ছিল তফসিলের আগেই বড় কিছু ঘোষণার মাধ্যমে ভোটের হাওয়া তোলা। এখনো পর্যন্ত বিএনপির সাবেক দুই নেতা সমশের মবিন চৌধুরী ও তৈমুর আলম খন্দকারের তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দেওয়া ছাড়া বড় কোনো ঘোষণা আসেনি।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একটি সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগ যাদের ভোটে চাইছে, তারা নানা হিসাব-নিকাশ করছে। সময় নিতে চাইছে। কারও কারও চাওয়া পদ-পদবি, মন্ত্রিত্ব-সংসদ সদস্য পদ। কিছু কিছু দল, ব্যক্তি ভোটে আসার জন্য উল্টো তদবির করছে। তাদের চাওয়া টাকাপয়সা। অর্থাৎ চাওয়া-পাওয়া মিলতে সময় লাগছে।

সরকারের একজন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আগামী এক সপ্তাহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বিএনপির নেতাদের কারা দল থেকে বেরিয়ে আসছেন, তা স্পষ্ট হবে। এরপরই ভোটের হাওয়া সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কামরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ খালি মাঠে গোল দেবে না। তফসিল ঘোষণা হোক। বিএনপির অনেকে স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করবেন। জাতীয় পার্টি ৩০০ আসনে ভোট করবে। তৃণমূল বিএনপিও সব আসনে ভোট করার ঘোষণা দিয়েছে। তিনি বলেন, সময় আছে, অপেক্ষা করেন।

বিএনপির নেতা ও চরমোনাই লক্ষ্য

বিএনপির সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমদ দল ছাড়ছেন—গত সপ্তাহে তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ এমন বোমা ফাটান। তিনি ঢাকায় দলের সভায় বলেন, বিএনপির সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান মেজর হাফিজের নেতৃত্বে আরও একটি দল হতে যাচ্ছে।

এক দিন পরই মেজর হাফিজ সংবাদ সম্মেলন করে এই কথা নাকচ করে দেন। শেষ পর্যন্ত তিনি কিছুটা পিছিয়ে আসেন। তিনি বলেন, ‘আমি এখনো বিএনপিতে আছি। তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্য সঠিক নয়।’

আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও পরবর্তী করণীয় বিষয়ে মেজর হাফিজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও সম্প্রতি বৈঠক করেন। এই বৈঠকটি হাফিজের ইচ্ছায় নয়, তৃতীয় একটি পক্ষের মাধ্যমে হয়। এ সময় তাঁর ভোটে অংশ নেওয়ার বিষয়টি আলোচনা হয়। যদিও মেজর হাফিজ ওই বৈঠকের কথা অস্বীকার করেন।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশের পর গ্রেপ্তার অভিযানের মুখে বিএনপির নেতারা হুড়মুড়িয়ে না হলেও দলটিতে ভাঙন শুরু হবে বলে ধরে নিয়েছিলেন তাঁরা। বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা কোনো কোনো দল চলে আসতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছিল। তবে কাঙ্ক্ষিত ফল মিলছে না।

ক্ষমতাসীন দলের ওই নেতা মনে করেন, মার্কিন ভিসা নীতি ও এক–এগারোর সময় দল ভাঙার পরও কিছু করতে না পারা—এসব বিষয়ও বিএনপির নেতাদের সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাগ্রস্ত করছে।

বিএনপিবিহীন ভোটে চরমোনাই পীরের দল বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলনের অংশগ্রহণ চাইছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে দলটিকে জামায়াতে ইসলামীর বিকল্প হিসেবে গড়ে তোলারও একটা চেষ্টা ছিল। কিন্তু গত জুনে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী ও দলের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিমের ওপর হামলার পর দলটি সরকারবিরোধী ভূমিকা জোরদার করে। দলটি এখন সমঝোতা ছাড়া একতরফা তফসিল ঘোষণার ব্যাপারে হুঁশিয়ারি দিয়েছে। ফলে ইসলামী আন্দোলনের এই অবস্থান বিএনপির মতো দলটির নির্বাচন বর্জনের ইঙ্গিত বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম প্রথম আলোকে বলেন, সুষ্ঠু ভোট হবে। এতে অনেক দল ও ব্যক্তি অংশ নেবে।

জাপা, জামায়াত ও অন্যান্য দল

বিএনপিবিহীন ভোটে জাতীয় পার্টিকে নিশ্চিত মনে করছে আওয়ামী লীগ। এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে গত কয়েকটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কারণে এমনটা মনে করতে পারে তারা। এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। নির্বাচনের প্রস্তুতি জাতীয় পার্টির রয়েছে। তবে অংশ নেওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। আগামী কয়েক দিনের পরিস্থিতি দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকে মনে করেন, জাতীয় পার্টি আগেই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিতে রাজি নয়। এতে দলটির দর–কষাকষির ক্ষমতা কমে যাবে।

জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে কোনো সমঝোতা বা সখ্য দেখাতে রাজি নয় আওয়ামী লীগ। তবে দলটির নেতারা স্বতন্ত্র নির্বাচনে অংশ নিক, তা চায় ক্ষমতাসীনেরা।

আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা প্রথম আলোকে বলেন, জামায়াতকে বিশ্বাস করেন না তাঁরা। তবে একেবারে হাতছাড়াও করতে চান না। এ জন্যই দলটিকে নির্বাচনে আনার বিষয়ে চেষ্টা আছে।

আ.লীগ প্রস্তুত, প্রকল্প উদ্বোধন

নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তফসিল ঘোষণা করার কথা বলেছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে বেশ কিছু বড় প্রকল্প উদ্বোধন করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী মঙ্গলবার ১৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর প্রকল্প উদ্বোধনের কর্মসূচি শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। ইসি ১৬ নভেম্বরের মধ্যে তফসিল ঘোষণা করার প্রস্তুতি রেখেছে বলে জানা গেছে। যদিও উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধনের কর্মসূচিগুলোর কারণে তফসিল ঘোষণায় কিছু সময় নেওয়া হচ্ছে; এমন আলোচনা রয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকে বলছেন, নির্বাচনে তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বী কারা হবেন, সেটি বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ফলে এখনো তফসিল ঘোষণা না হওয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বী খুঁজতে তাঁরা কিছুটা সময় পেলেন।

প্রথম আলো