দেশে গ্যাসের চাহিদা বর্তমানে দৈনিক প্রায় ৩৫০ কোটি ঘনফুট। তবে সরবরাহ করা হয় ২৭০-২৭৫ কোটি ঘনফুট। কখনও কখনও তা আরও কমে যায়। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করা হলেও, তা চাহিদার এক-চতুর্থাংশও পূরণ করতে পারছে না। তবে ঘাটতি পূরণ না করেই বিভিন্ন খাতে গত ১৫ বছরে দফায় দফায় গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে খাতভেদে গ্যাসের দাম কয়েকগুণ হয়ে গেছে।
পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে দেশে গ্যাসের দাম বেড়েছে সাতবার। তবে শুধু আবাসিকে বেড়েছে পাঁচবার। যদিও আবাসিক, শিল্প-বাণিজ্যিক বা বিদ্যুৎ কোনো খাতই চাহিদামতো গ্যাস পাচ্ছে না। এমনকি গত বছর ফেব্রুয়ারিতে সরবরাহ বাড়ানো হবে যুক্তি দিয়ে শিল্প, বিদ্যুৎ, ক্যাপটিভ ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। এরপরও চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস দেয়া হচ্ছে না খাতগুলোয়।
গ্যাসের দাম বৃদ্ধির চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০৯ সালের শুরুতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় একমুখী চুলায় গ্যাসের দাম ছিল ৩৫০ টাকা ও দ্বিমুখী চুলায় ৪০০ টাকা। আর মিটারযুক্ত চুলায় আবাসিকে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ছিল ৪ টাকা ৬০ পয়সা। ওই বছর আগস্টে সব ধরনের গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। এতে একমুখো চুলায় গ্যাসের বিল দাঁড়ায় ৪০০ টাকা ও দ্বিমুখী চুলায় ৪৫০ টাকা। আর মিটারভিত্তিক গ্রাহকদের প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৫ টাকা ১৬ পয়সা।
আবাসিকে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির পুরোনো সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যায় আওয়ামী লীগ সরকারের পরের মেয়াদে। ওই সময় মাত্র সাড়ে তিন বছরে আবাসিকে গ্যাসের দাম বাড়ে চুলাপ্রতি ৩৫০ টাকা। এর মধ্যে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে একমুখো চুলার বিল দাঁড়ায় ৬০০ টাকা ও দ্বিমুখী চুলায় ৬৫০ টাকা। আর মিটারযুক্ত গ্রাহকদের প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম দাঁড়ায় সাত টাকা। এরপর ২০১৭ সালের মার্চে একমুখো চুলার বিল দাঁড়ায় ৭৫০ টাকা ও দ্বিমুখী চুলায় ৮০০ টাকা। সে সময় মিটারভিত্তিক গ্রাহকদের বিল বেড়ে দাঁড়ায় ঘনমিটারে ৯ টাকা ১০ পয়সা।
আওয়ামী লীগ সরকারের চলতি মেয়াদেও দুই দফা বাড়ানো হয়েছে গ্যাসের দাম। এর মধ্যে ২০১৯ সালের জুলাইয়ে আবাসিকে এক চুলার মাসিক বিল করা হয় ৯২৫ টাকা ও দুই চুলার ৯৭৫ টাকা। আর মিটারভিত্তিক গ্রাহকদের গ্যাসের দাম বেড়ে হয় প্রতি ঘনমিটারে ১২ টাকা ৬০ পয়সা। এদিকে ২০২২ সালের জুনে এক চুলার মাসিক বিল দাঁড়ায় ৯৯০ টাকা ও দুই চুলার এক হাজার ৮০ টাকা। মিটারভিত্তিক গ্রাহকদের গ্যাসের দাম বেড়ে হয় প্রতি ঘনমিটারে ১৮ টাকা। এছাড়া ২০১৭ সালের জুনে আবাসিকে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলেও উচ্চ আদালতের রায়ে তা বাতিল হয়ে যায়।
এদিকে ২০০৯ সালের শুরুতে সার উৎপাদনে সরবরাহকৃত প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ছিল ২ টাকা ২৪ পয়সা, বিদ্যুতে ২ টাকা ৬১ পয়সা, চাসহ সব ধরনের শিল্পে ৫ টাকা ২৩ পয়সা, ক্যাপটিভে ৩ টাকা ৭৩ পয়সা ও বাণিজ্যিক খাতে (হোটেল-রেস্টুরেন্ট ও অন্যান্য) ৮ টাকা ২৩ পয়সা। তবে ওই বছর আগস্টে দাম বৃদ্ধির ফলে সার উৎপাদনে সরবরাহকৃত গ্যাসের দাম বেড়ে হয় প্রতি ঘনমিটার ২ টাকা ৫৮ পয়সা, বিদ্যুতে ২ টাকা ৮২ পয়সা, শিল্পে ৫ টাকা ৮৬ পয়সা, ক্যাপটিভে ৪ টাকা ১৮ পয়সা ও বাণিজ্যিকে ৯ টাকা ৪৭ পয়সা।
২০১২ সালে পেট্রোবাংলা সব ধরনের গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আবেদন করলেও, তা খারিজ করে দিয়েছিল বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এরপর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে বিভিন্ন খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। সেবার বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহƒত গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়নি। আর প্রথমবারের মতো অন্যান্য শিল্প থেকে চা শিল্পকে পৃথক করে দাম কিছুটা কম হারে বাড়ানো হয়। সে সময় সার উৎপাদনে সরবরাহকৃত গ্যাসের দাম বেড়ে হয় প্রতি ঘনমিটার ২ টাকা ৫৮ পয়সা, চা শিল্পে ৬ টাকা ৪৫ পয়সা, অন্যান্য শিল্পে ৬ টাকা ৭৪ পয়সা, ক্যাপটিভে ৮ টাকা ৩৬ পয়সা এবং বাণিজ্যিকে ১১ টাকা ৩৬ পয়সা।
২০১৭ সালে দুই ধাপে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়া হয় ফেব্রুয়ারিতে। এর মধ্যে প্রথম ধাপ মার্চে ও দ্বিতীয় ধাপ জুনে কার্যকর হয়। সেবার সব খাতেই গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছিল দুই ধাপে। মার্চে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহƒত গ্যাসের দাম বেড়ে হয় প্রতি ঘনমিটারে ২ টাকা ৯৯ পয়সা, সারে ২ টাকা ৬৪ পয়সা, চা শিল্পে ৬ টাকা ৯৩ পয়সা, অন্যান্য শিল্পে ৭ টাকা ২৪ পয়সা, ক্যাপটিভে ৮ টাকা ৯৮ পয়সা এবং বাণিজ্যিকে ১৪ টাকা ২০ পয়সা।
তিন মাস পর অর্থাৎ ২০১৭ সালের জুনে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহƒত গ্যাসের দাম বেড়ে হয় প্রতি ঘনমিটারে ৩ টাকা ১৬ পয়সা, সারে ২ টাকা ৭১ পয়সা, চা শিল্পে ৭ টাকা ৪২ পয়সা, অন্যান্য শিল্পে ৭ টাকা ৭৬ পয়সা, ক্যাপটিভে ৯ টাকা ৬২ পয়সা এবং বাণিজ্যিকে ১৭ টাকা ০৪ পয়সা। এর দুই বছর এক মাস পর ২০১৯ সালের জুলাইয়ে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হয়। তবে সেবার শিল্প খাতকে তিনটি ক্যাটেগরিতে ভাগ করা হয়Ñবৃহৎ, মাঝারি এবং ক্ষুদ্র ও কুটির। যদিও ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে প্রণোদনার পরিবর্তে অস্বাভাবিক হারে দাম বাড়ানো হয়।
২০১৯ সালের জুলাইয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহƒত গ্যাসের দাম বেড়ে হয় প্রতি ঘনমিটারে ৪ টাকা ৪৫ পয়সা, সারেও ৪ টাকা ৪৫ পয়সা, চা শিল্পে ১০ টাকা ৭০ পয়সা, অন্যান্য শিল্পের মাঝে বৃহৎ ও মাঝারিতে ১০ টাকা ৭০ পয়সা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ১৭ টাকা চার পয়সা, ক্যাপটিভে ১৩ টাকা ৮৫ পয়সা এবং বাণিজ্যিকে ২৩ টাকা। এর ৩৫ মাসের মাথায় আবারও গ্যাসের দাম বাড়ে। তবে সে সময় শিল্প খাতে গ্যাসের দামের সø্যাবকে সমন্বয় করা হয়। এতে বৃহৎ ও মাঝারি শিল্পে দাম বাড়ানো হলেও, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে কমিয়ে আনা হয়।
এতে ২০২২ সালের জুনে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহƒত গ্যাসের দাম বেড়ে হয় প্রতি ঘনমিটারে ৫ টাকা দুই পয়সা, চা শিল্পে ১১ টাকা ৯৩ পয়সা, বৃহৎ শিল্পে ১১ টাকা ৯৮ পয়সা, মাঝারি শিল্পে ১১ টাকা ৭৮ পয়সা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ১০ টাকা ৭৮ পয়সা, ক্যাপটিভে ১৬ টাকা এবং বাণিজ্যিকে ২৬ টাকা ৬৪ পয়সা। তবে ওইবার সার উৎপাদনে ব্যবহƒত গ্যাসের দাম এক লাফে বাড়িয়ে ১৬ টাকা করা হয়।
যদিও সর্বশেষ ঘোষিত মূল্যহারে শিল্প খাতে গ্যাসের সব ধরনের সø্যাব তুলে দেয়া হয়। এতে ২০১৭ সাল বা আগের সময়ের মতো বৃহৎ, মাঝারি এবং ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে গ্যাসের অভিন্ন মূল্যহার করা হয়েছে। সে সময় বিদ্যুৎ খাতে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম বেড়ে হয় ১৪ টাকা, শিল্পে (সব ধরনের) ৩০ টাকা, ক্যাপটিভে ৩০ টাকা এবং বাণিজ্যিকে ৩০ টাকা ৫০ পয়সা। তবে ওইবার আবাসিকের মতো সার উৎপাদন ও চা শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়নি।
এ হিসাবে বর্তমান সরকারের মেয়াদকালে আবাসিকের এক চুলায় গ্যাসের বিল বেড়েছে ১৮২ দশমিক ৮৬ শতাংশ, দুই চুলায় ১৭০, মিটারযুক্ত চুলায় ২৯১ দশমিক ৩০, বিদ্যুতে ৪৩৬ দশমিক ৪০, সারে ৬১৪ দশমিক ২৯, চা শিল্পে ১২৮ দশমিক ১১, অন্যান্য শিল্পে ৪৭৩ দশমিক ৬১, ক্যাপটিভে ৭০৪ দশমিক ২৯ এবং বাণিজ্যিকে ২৭০ দশমিক ৬০ শতাংশ।
প্রসঙ্গত, গ্যাসের ঘাটতি মেটাতে ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে সরকার এলএনজি আমদানি শুরু করে। একসময় দিনে ৮৫ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ হতো আমদানি করা এলএনজি থেকে। কাতার ও ওমান থেকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে এবং স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কিনত সরকার। করোনার সময় এ দাম দু-তিন ডলারে নেমে আসে। তবে করোনা-পরবর্তী চাহিদা বৃদ্ধি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম হুহু করে বাড়তে থাকে। দাম বাড়তে থাকায় স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ করে দেয় সরকার। একটা সময় এ দাম ৫৪ ডলার ছাড়িয়ে যায় স্পট মার্কেটে।
যদিও পরে এলএনজির দাম আবারও কমে আসে। তবে ডলার সংকটের কারণে কম দামের এ সুযোগ নিতে পারছে না সরকার। এতে ২০২২ সালে এলএনজি আমদানি প্রায় ৯৪ শতাংশ কমে যায়। এর প্রভাব পড়ে সব খাতে। আবাসিকের পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও শিল্পে গ্যাসের ঘাটতি চরমে পৌঁছায়। সংকট মোকাবিলায় সরকার ঘোষণা দিয়ে বিদ্যুতে লোডশেডিং শুরু করে। শিল্প মালিকরা গ্যাসের জন্য হাহাকার শুরু করেন। তারা বাড়তি দাম দিয়ে হলেও গ্যাস সরবরাহের নিশ্চয়তা চান। এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক হয়। তবে এখনও কোনো খাতেই নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করতে পারছে না সরকার।
এদিকে গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে আবারও গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো। যদিও জাতীয় নির্বাচনের আগে এ ধরনের অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে রাজি হয়নি সরকার। তবে আইএমএফের শর্ত মেনে গ্যাসে ভর্তুকি তুলে দিলে দ্রুতই গ্যাসের দাম আরেক দফা বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শেয়ার বিজ