চাপে পড়া জাপার ভবিষ্যৎ কী

চাপে পড়া জাপার ভবিষ্যৎ কী

প্রতিষ্ঠার ৩৯ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে জাতীয় পার্টি (জাপা)। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে রাষ্ট্রক্ষমতা হারালেও সংসদে প্রতিনিধিত্ব, সরকারের সঙ্গে সমঝোতা এবং বিদেশি বন্ধুত্বে টিকে ছিল দলটি। চরম বিতর্কিত নির্বাচনের সুযোগ নিয়ে গত তিন সংসদে প্রধান বিরোধী দল হলেও ভোটের মাঠে দিন দিন দুর্বল  হয়ে পড়া জাপা স্বৈরাচারের দোসর আখ্যা পেয়ে পড়েছে অস্তিত্ব সংকটে। ঘুরে দাঁড়ানোর কথা বললেও দলটির সক্ষমতায় প্রশ্ন রয়েছে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর আওয়ামী লীগের মিত্র জাপাকেও নিষিদ্ধের দাবি তুলেছেন ছাত্র নেতৃত্ব। বিএনপি এতে একমত না হলেও জাপার কর্মসূচির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সক্রিয় হতে পারে আশঙ্কায় অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা জি এম কাদেরের দলকে সুযোগ দিতে রাজি নন। জাপার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলার পর দলটির নেতাদের বিচারও চাইছেন তারা। ছাত্র নেতৃত্বের বিরোধিতায় সরকারের সংলাপে ডাক না পেয়ে অনেকটা একঘরে হয়ে পড়েছে স্বৈরশাসক এরশাদের দলটি।

জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সমকালকে বলেছেন, ‘চাপের কী আছে। রাজনীতি করলে, এমন হবেই। রাজপথে ও আইনিভাবে মোকাবিলা করব।’

তবে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী স্বীকার করেছেন, দলটি চাপে পড়েছে। তিনি বলেছেন, ‘একটা চাপে পড়েছে জাতীয় পার্টি। তবে এটাকে ইতিবাচকভাবে নিচ্ছি। কারণ, এর মাধ্যমে দল ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। বাংলাদেশে নিপীড়িত দল সহানুভূতি পায়।’

ভোটের মাঠে চোট নেই
ক্ষমতাচ্যুতির তিন মাসের মাথায় ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ১১ দশমিক ৯ শতাংশ ভোট পেয়ে ৩৫ আসন পেয়েছিল কারাবন্দি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাপা। এককভাবে নির্বাচন করেও ১৯৯৬ সালে ১৬ দশমিক ২ শতাংশ ভোট পেয়ে ৩২ আসন পায়। সেবার সরকার গঠনে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে মন্ত্রিসভায় স্থান পায় দলটি।

নব্বই দশকে বৃহত্তর রংপুর ছিল জাপার দুর্গ। ১৯৯১ সালে এ অঞ্চলের ২২ আসনের ১৮টিতে এবং পরের বার ২১টিতে জয় পায় দলটি। ২০০১ সালের নির্বাচনে জাপা ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ ভোট পায়। সেবার দলটির পাওয়া ১৪ আসনের ১৩টিই ছিল বৃহত্তর রংপুরে। এতে দলটি জাতীয় চরিত্র হারিয়ে কার্যত আঞ্চলিক শক্তিতে পরিণত হয়।

পরের বছরগুলোয় কয়েক দফা ভাঙন ধরে জাতীয় পার্টির। ১৯৯৯ সালে বিএনপির জোটে যোগ দিয়েও পরের বছর বেরিয়ে যান এরশাদ। ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের জোটে যান। ২০০৮ সালে ৭ শতাংশ ভোট পেলেও রংপুরের দুর্গে ফাটল ধরে। তবে জাপাকে আওয়ামী লীগ যে ২৯ আসন ছেড়েছিল, এর ২৭টি জেতে। বাকি যে ২০ আসন উন্মুক্ত ছিল, এর একটিও জিততে পারেনি। এর মধ্যে রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রামে বারবার জেতা আসনও হাতছাড়া হয়।

বিতর্কিত নির্বাচনে অস্তিত্ব রক্ষা
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিএনপিবিহীন নির্বাচন এরশাদ বর্জন করলেও রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জি এম কাদের বাদে দলটির বাকি সব জ্যেষ্ঠ নেতা অংশ নেন। সেবার জাপাকে ৪৬ আসন ছেড়েছিল আওয়ামী লীগ। এর ২২টিতে লাঙ্গলের প্রার্থীরা বিনা ভোটে জেতেন। নৌকার প্রার্থী ছিল না– এমন ১৩ আসনেও হারে জাপা। তবে ৩৪ আসন পেয়ে বিরোধী হয়েও মন্ত্রিসভায় থাকার নজিরবিহীন কাণ্ডে ‘গৃহপালিত’ তকমা পায় দলটি।

রাতের ভোট খ্যাত ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জাপাকে ২৬ আসন ছাড়ে আওয়ামী লীগ। এর ২২টিতে জয় পায় লাঙ্গল। আরও ১৪৯ আসনে প্রার্থী থাকলেও তাদের কারও জামানত বাঁচেনি। কিন্তু জেতা ২২ আসনের ১৭টিতে ৯০ শতাংশ ভোট পায় লাঙ্গল। অভিযোগ রয়েছে, রাতে এই ভোট দেওয়া হয়। শামীম হায়দার পাটোয়ারী সমকালকে বলেছেন, ‘স্বীকার করব স্বাভাবিক নির্বাচন হয়নি।’

২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির ভোটে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ২৬ আসন ছাড় পেয়ে ১১টিতে জেতে জাপা। রংপুরের ৩৩ আসনের ৩০টিতে লাঙ্গলের প্রার্থী ছিলেন। সাতটিতে নৌকার প্রার্থী ছিলেন না। এর দুটি জেতে জাপা। ছাড় পেয়েও জামানত বাজেয়াপ্ত হয় তিনটিতে। ছাড়ের বাইরে রংপুরে ২৩ আসনের মাত্র একটিতে জামানত রক্ষা হয়। রাজশাহী বিভাগের ৩৯ আসনের ৩৭টিতে লাঙ্গলের প্রার্থীরা ভোট পান ১ দশমিক ৮২ শতাংশ। অন্য কোনো বিভাগেই ২ শতাংশ ভোট পাননি।

সংসদের বিরোধী দল হলেও গত এপ্রিল এবং মে মাসে অনুষ্ঠিত ৪৬০ উপজেলা পরিষদের মাত্র চারটিতে দলটির মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়। এর আগের মাসে অনুষ্ঠিত পৌরসভাগুলোর উপনির্বাচনেও প্রার্থী দিতে পারেনি জাপা। এমনকি যে এলাকায় জাপার এমপি ছিলেন, সেখানেও প্রার্থী পাননি।

স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে রংপুর সিটি করপোরেশন ছাড়া কোথাও জিততে পারেনি জাপা। গত বছর বরিশাল, রাজশাহী, গাজীপুর ও খুলনায় ইসলামী আন্দোলনের চেয়েও কম ভোট পেয়েছে দলটি। ২০২১ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে লাঙ্গলের প্রাপ্ত ভোট ছিল এক দশমিক ৪৯ শতাংশ।

দূতাবাসে দৌড়ঝাঁপ 
এরশাদের মৃত্যুর পর ২০১৯ সালে দলের দায়িত্ব নিয়ে সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়েছিলেন জি এম কাদের। গত বছর তাঁকে বেশি সক্রিয় থাকতে দেখা যায় কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, গত বছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত কূটনীতিকদের সঙ্গে অন্তত ১৮ বার প্রকাশ্যে বৈঠক করেন তিনি।

আগে সরকারের সমালোচক হলেও গত বছরের আগস্টে ভারত থেকে ফিরে নীরব হয়ে যান জি এম কাদের। যদিও বারবার দাবি করছিলেন, গ্রহণযোগ্য না হলে নির্বাচনে যাবেন না। দলটির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের যৌথ সভায় একই অভিমত এসেছিল। তবে সূত্রের খবর অনুযায়ী, গত বছরের ৩১ অক্টোবর যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনারের সঙ্গে বৈঠকেই শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণের  কথা জানায় জাপা।
তবে আওয়ামী লীগের পতনের পর জি এম কাদের দাবি করেছেন, ‘ব্ল্যাকমেইল’ করে সরকার তাদের ২০১৪ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনে নিয়েছিল। কিন্তু ২০২৩ সালে সংসদে বক্তৃতায় মুজিবুল হক চুন্নু

বলেছিলেন, এরশাদের সিদ্ধান্ত অমান্য করে ‘গণতন্ত্র রক্ষায়’ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল জাপা।
বিএনপি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তে অনড় থাকায়  দলছুট  নেতাদের নিয়ে গঠিত ‘কিংস পার্টির’ মাধ্যমে ভোটে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল আওয়ামী লীগ। শোনা যাচ্ছিল, পরের সংসদে ‘কিংস পার্টিগুলো’ হবে বিরোধী দল। জাপা সূত্রগুলো সমকালকে নিশ্চিত করেছিল, এ প্রচেষ্টায় ব্যর্থতা এবং প্রতিবেশী দেশের মধ্যস্থতায় বিরোধী দল হওয়ার নিশ্চিয়তা পেয়ে ২৩ নভেম্বর নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দেয় জাপা।

পট পরিবর্তনের পর জি এম কাদের বারবার দাবি করছেন, নির্বাচনে না গেলে রওশন এরশাদের মাধ্যমে দল ভেঙে জাপাকে ভোটে নেওয়া হতো। যদিও সেই সময়কার ঘটনাপ্রবাহ অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিনেই নিশ্চিত হয় রওশন ও  তাঁর অনুসারীরা নির্বাচন থেকে ছিটকে গেছেন। আইন অনুযায়ী, জাপার সামনে সুযোগ ছিল ১৭ ডিসেম্বরের  মধ্যে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবার। তা না করে প্রতিবেশী দেশের মাধ্যমে আসন ভাগ-বাটোয়ারার চেষ্টা চালিয়ে যায়।  ১৬ ডিসেম্বর রাতেও সেই দেশের দূতাবাসে যান জাপা নেতারা।

তবে জি এম কাদের দাবি করেছেন, তিনি যাতে নির্বাচন বর্জন করতে না পারেন, সে জন্য ১৭ ডিসেম্বর তাঁকে ঘিরে রেখেছিলেন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। তবে সমকালের খবর অনুযায়ী, সেদিন তাঁর স্ত্রী শেরিফা কাদেরের ঢাকা-১৮ আসনের ছাড়ের বার্তার মুহূর্তেই নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দেয় জাপা।

এসব কর্মকাণ্ডের জন্য জাপার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নেই বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ। এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক সমকালকে বলেছেন, জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সব অপকর্মের সহযোগী। ভোটাধিকার থেকে মানুষকে বঞ্চিত করে সংসদে গিয়ে সব সুযোগ সুবিধা নিয়েছে।

জাপার ওপর হামলার কারণে দলটির প্রতি সহানুভূতি তৈরি করবে কিনা– প্রশ্নে মাহবুব উল্লাহ বলেছেন, ৫ আগস্টের পর মানুষ আগের মতো নেই। আবার জাপার ভোটও নেই। তবে তারা যদি অতীতের জবাবদিহিতায় মানুষের সামনে বয়ান তৈরি করতে পারে, তবে সম্ভাবনা রয়েছে।

কী বলছে জাপা
২০১২ সালে ফেনী অভিমুখে লংমার্চের পর একযুগে রাজপথে নেই জাপা। শেখ হাসিনার পতনের পর অভ্যুত্থানের সময়কার মামলার প্রতিবাদে দলটি রাজপথে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সূত্রের খবর, গত বৃহস্পতিবার এ বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে জাপার কার্যালয়ে হামলা করা হয়। নইলে দলটি সমাবেশের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ফেরার সুযোগ পেত।
বছর বছর ভোট কমে যাওয়ার বিষয়ে মুজিবুল হক চুন্নু সমকালকে বলেছেন, ‘আপনারাই তো বলেন নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। সুষ্ঠু নির্বাচন হোক, তখন দেখা যাবে, জাপার ভোট কমেছে কী না।’ গত তিন নির্বাচনে জাপার ভূমিকা এবং স্বৈরাচারের দোসর তকমা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ নিয়ে বহু উত্তর দিয়েছি।’

গত তিন নির্বাচনকে অস্বাভাবিক বলে মানেন শামীম হায়দার। তিনি সমকালকে বলেছেন, ‘এর মাধ্যমে জাপার ভোটের অবস্থা বোঝার বৈজ্ঞানিক উপায় নেই।’ অস্বাভাবিক নির্বাচনের দায় জাপা নেবে কিনা– জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচন করে তো জোর করে সরকার গঠন করিনি। জাপার আসন কমেছে, তাহলে কীভাবে দোসর হলাম? জাপার দু-একটি আসনেও অনিয়ম হতে পারে। দায় কী হবে, তা জনগণ ঠিক করবে।’

আওয়ামী লীগের দোসর আখ্যা পাওয়ায় আগামীতে কারও সঙ্গে জাপার জোট করা কঠিন হবে বলে স্বীকার করলেন ব্যারিস্টার শামীম। তিনি বলেছেন, ‘রাজনীতি দোলাচলের খেলা। দেখা যাক, কী হয়।’

samakal

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here