bonikbarta.net
রাশেদ এইচ চৌধুরী, চট্টগ্রাম ব্যুরো
মার্চ ২৩, ২০২৩
বাণিজ্যিক জাহাজের আসা-যাওয়া কমায় ফাঁকা চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী
চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে গত বছরের তুলনায় ফেব্রুয়ারিতে কনটেইনার হ্যান্ডলিং কমেছে ২৬ শতাংশের বেশি। বন্দরের বর্তমান অবকাঠামোয় বছরে প্রায় ৪০ লাখ টিইইউ (টোয়েন্টি ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট) কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা রয়েছে। প্রতি মাসে প্রায় ৩ লাখ ৩৩ হাজার টিইইউ সক্ষমতা থাকলেও ফেব্রুয়ারিতে বন্দর দিয়ে হ্যান্ডলিং হয়েছে ১ লাখ ৮৯ হাজার ৬৪০ টিইইউ। সে হিসাবে ১ লাখ ৪৩ হাজার টিইইউ কোনো কাজে লাগেনি, অর্থাৎ কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে অলস বসে থাকে সক্ষমতার প্রায় ৪৩ শতাংশ। পাশাপাশি বন্দরে জাহাজ হ্যান্ডলিং কমেছে ১৫ শতাংশ এবং একই পরিমাণে কমেছে কার্গো হ্যান্ডলিংও। বন্দর কর্তৃপক্ষের দাবি, চার মাসের মধ্যেই আমদানি-রফতানি পরিস্থিতি ভালো হলে তিন খাতেই হ্যান্ডলিং কার্যক্রম আবারো গতিশীল হবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের পরিবহন বিভাগের দেয়া তথ্যমতে, বৈদেশিক বাণিজ্যের গতি মন্থর থাকায় কমেছে পণ্যবাহী জাহাজ আসার সংখ্যাও। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বন্দরটিতে জাহাজ হ্যান্ডলিং হয়েছে ৩১২টি। ২০২২ সালের একই সময়ে বিভিন্ন দেশ থেকে বন্দরে আসা-যাওয়া করা জাহাজের এ সংখ্যা ছিল ৩৭০। সে হিসাবে জাহাজ হ্যান্ডলিং কমেছে ১৫ শতাংশ। তবে হ্যান্ডলিং কমার এ হার দৃশ্যমান হতে থাকে বছরের শুরুতেই। জানুয়ারিতে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ হ্যান্ডলিং হয় ৩৪২টি, যেখানে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে হ্যান্ডলিং হয়েছিল ৩৫৮টি জাহাজ।
মূলত খোলা পণ্যবাহী বাল্ক কার্গো ও কনটেইনারবাহী জাহাজে আসা পণ্য ওঠা-নামার ভিত্তিতে বন্দরের প্রবৃদ্ধি নির্ধারণ করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের ক্ষেত্রে পণ্য হ্যান্ডলিং গড়ে ১৫ শতাংশ বা এর কাছাকাছি হলে সেটিকে আদর্শ হিসেবে ধরা হয়।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে কার্গো হ্যান্ডলিং (খোলা পণ্য) পরিবহন এতদিন স্বাভাবিক থাকলেও হালনাগাদ তথ্যে পার্থক্যটা বেশ বড় হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে বন্দর দিয়ে কার্গো হ্যান্ডলিং (ওঠা-নামা) হয়েছে ৮৮ লাখ ৬২ হাজার ৭৭৯ টন। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে এর পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৫ লাখ টন। এ হিসাবে এটি ১৫ শতাংশ কমেছে।
দেশের আমদানি-রফতানি পণ্যবাহী কনটেইনারের ৯৮ শতাংশই আনা-নেয়া হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। কনটেইনারে থাকা সিংহভাগই শিল্পের কাঁচামাল ও প্রস্তুত শিল্পপণ্য। ফলে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমার অর্থ হলো শিল্পের উৎপাদন কমা এবং সেই সঙ্গে রফতানি আয় কমে যাওয়ারও ইঙ্গিত।
গত ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রাম বন্দরে মোট হ্যান্ডলিং হয়েছে ১ লাখ ৮৯ হাজার ৬৪০ টিইইউ কনটেইনার, ২০২২ সালের একই সময়ে যা ২ লাখ ৫৮ হাজার ১৩১ টিইইউ ছিল। অর্থাৎ হ্যান্ডলিং কমেছে ২৬ শতাংশের বেশি। অবশ্য চলতি বছরের জানুয়ারিতে বন্দর দিয়ে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয় ২ লাখ ২১ হাজার ৮৫৬ টিইইউ। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে এ সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৯১ হাজার ৮৯৩ টিইইউ।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা দেশের অর্থনৈতিক গতি লক্ষ্য রেখে সম্প্রসারণ ও অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজনে কাজ করে গেছি। যেহেতু বন্দরের হ্যান্ডলিং কার্যক্রম আমদানি-রফতানি বাড়া ও কমার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। এক্ষেত্রে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণেই বাণিজ্যের গতি কমে আসার ছাপ বন্দরের পরিচালন কার্যক্রমেও দৃশ্যমান হয়েছে। সম্প্রতি জাহাজ হ্যান্ডলিং বেশ কমে এসেছে। আমরা এখন ৩৬ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই জাহাজ বিদায় করে দিতে পারছি। যেটা একটা সময়ে ভাবাও যেত না।’
তিনি আরো বলেন, ‘বন্দরে কার্গো ও কনটেইনার দুই খাতেই হ্যান্ডলিং সম্প্রতি বেশ কমেছে। তবে আশা করছি, চার মাসের মধ্যে আমদানি-রফতানি পরিস্থিতি ভালো হয়ে তিন খাতেই হ্যান্ডলিং কার্যক্রম আবারো গতিশীল হবে।’
বন্দরের বেশির ভাগ কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয় নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ও চট্টগ্রাম কনটেইনার টার্মিনালে (সিসিটি)। এখানে হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্বে আছে দেশের শীর্ষ টার্মিনাল অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড।
প্রতিষ্ঠানটির চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) ক্যাপ্টেন তানভির হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বন্দর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে নতুন নতুন ইকুইপমেন্ট যুক্ত করার ফলে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক দ্রুত কনটেইনার লোড-আনলোড করতে পারছি। যদিও আমদানি কমে যাওয়ার বিষয়টি বেশ ভালোভাবেই টের পাওয়া যাচ্ছে পরিচালন কার্যক্রমে।’
চট্টগ্রাম চেম্বারের সিনিয়র সহসভাপতি প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ এম তানভীর এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ছোট ও মাঝারি কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম হোঁচট খেলেও এখন রফতানিতে সম্পৃক্ত অনেক বড় কারখানাও বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কায় রয়েছে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ কিন্তু থমকে আছে। এ পরিস্থিতিতে বিশেষ করে দেশের রফতানি খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে সরকার টাস্কফোর্স গঠন করে একটি টেকসই সমাধানে পৌঁছতে পারে।’
চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারকারী ফোরাম ও চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের লকডাউন উঠে যাওয়ার পর দেশে আমদানিতে গতি ফিরতে শুরু করেছিল। পরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এটাকে বড় ধাক্কা দিয়েছে। বৈদেশিক বাণিজ্যের গতি কমে যাওয়ায় এখন চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালন কার্যক্রমের মাধ্যমে এর প্রভাব ভালোভাবেই টের পাওয়া যাচ্ছে। সংকটের সময় গুরুত্বপূর্ণ নয় এমন পণ্য আমদানি কমে গেলে সেটি বরং পজিটিভলি দেখতে হবে। কিন্তু আমদানি দায় মেটানোর সক্ষমতা কমে এলেও খাদ্যপণ্যসহ শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে সবসময় অগ্রাধিকার দিতে হবে।’