এক উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানামুখী সংকটে পড়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। প্রথমত দলীয় নির্দেশনা মানছেন না মন্ত্রী ও এমপিরা। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় পর্যায়ের নেতৃত্বে ভেঙে পড়েছে দলের চেইন অব কমান্ড। তৃতীয়ত, উপজেলা নির্বাচনকে সামনে রেখে দ্বিধা-বিভক্তির রাজনীতি শুরু হয়েছে। নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে উত্তাপ, উৎকণ্ঠা আর সংঘাতের শঙ্কা। এরইমধ্যে রাজপথে আবারও কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছে দেশের প্রধান রাজনৈতিক বিরোধী বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকা শরিক দলগুলোর দূরত্বও বেড়েছে বহুগুণ। রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে তাদের সঙ্গে আপাতত আওয়ামী লীগের যোগাযোগ নেই বললেই চলে। এসব বিষয়কে এখন থেকেই গুরুত্ব দিতে চায় আওয়ামী লীগ। দলটির নেতাদের মতে, সামনে রাজনীতিতে হয়তো কঠিন পথ অপেক্ষা করছে।
তাই নিজেরা ঐক্যবদ্ধ থাকার জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে। রাজনীতির মাঠ আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ যেন না হয়- সেদিকে গভীরভাবে নজর দেয়া হবে। এসব সার্বিক বিষয় দিয়ে গণভবন থেকে বিশেষ নির্দেশনা আসছে। দলটির নেতা-কর্মীরা এখন চেয়ে রয়েছেন সেদিকেই। ৩০শে এপ্রিল সন্ধ্যা সাতটায় আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক হবে। গণভবনে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে এই সভা অনুষ্ঠিত হবে। এবারের বৈঠকে এক ডজনের বেশি এজেন্ডা রাখা হয়েছে। উপজেলা নির্বাচনে এমপি-মন্ত্রীদের পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজনদের প্রার্থী হতে নিষেধ করেছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।
দলের সভানেত্রীর এই নির্দেশনা অমান্য করে প্রথম ধাপে কমপক্ষে ১৪ জন এমপি-প্রতিমন্ত্রী ও সাবেক মন্ত্রীর পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন প্রার্থী রয়েছেন। পরবর্তী ধাপের নির্বাচনগুলোয়ও মাঠে আছেন আরও অনেক এমপি-মন্ত্রীর স্বজন। নিজেদের বাঁচাতে এমপি ও তাদের স্বজনরা নানা অজুহাত সামনে আনছেন। এতে বিব্রত ও ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। নির্দেশনা অমান্য করা এমপি-মন্ত্রী এবং তাদের স্বজনদের তালিকা তৈরি করছেন তারা। উপজেলা নির্বাচনে দলীয় সভানেত্রীর নির্দেশনা অমান্য করে যেসব এমপি-মন্ত্রী পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনদের প্রার্থী করেছেন তাদের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত আসে তা জানতে দৃষ্টি সবার গণভবনে। দলটির বেশ কয়েক কেন্দ্রীয় নেতা মানবজমিনকে বলেন, দলের সাংগঠনিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে। দলীয় প্রধানের আনুকূল্য নিয়েই তারা দলের এমপি-মন্ত্রী বা কেন্দ্রীয় নেতা হয়েছেন। তারা সভানেত্রীর নির্দেশনা মানবেন না- এটা হতে পারে না। সে কারণে আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরামের বৈঠকে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
তারা জানান, দলের নির্দেশনা অমান্য করে যেসব এমপি-মন্ত্রীর স্বজন উপজেলা নির্বাচন করছেন, তাদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এগুলো তারা ৩০শে এপ্রিল দলীয় সভানেত্রীর সামনে উপস্থাপন করবেন। দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে যে নির্দেশনা দেবেন, সেই মোতাবেক তারা তাদের পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক জানান, নানা বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ এখনই মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যাবে না। কোনো মন্ত্রী-এমপিকে এ ধরনের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনের জন্য বহিষ্কার করা হবে না। তারা বলছেন, বিষয়টি আওয়ামী লীগ সভাপতি মনে রাখবেন, ভবিষ্যতে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তারা জানান, ঢালাও বহিষ্কার বা একটি সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করলেই তাকে তাৎক্ষণিকভাবে দল থেকে বের করে দেয়ার নীতিতে আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে না। আওয়ামী লীগ এক্ষেত্রে সংযত ও গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমুন্নত রাখার নীতি অনুসরণ করে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন মানবজমিনকে বলেন, কার্যনির্বাহী সংসদের সভার এজেন্ডায় অন্তর্ভুক্ত সমসাময়িক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি, সাংগঠনিক ও বিবিধ শিরোনামে প্রায় সকল সমসাময়িক বিষয় ও সাংগঠনিক বিষয়ে আলোচনা হয়।
সাম্প্রতিক ইস্যু উপজেলা নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত করতে সহায়তা করা এবং মাননীয় মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যগণের নিকটাত্মীয়দের প্রার্থিতা বিষয়ে আলোচনা হবে বলে আমি মনে করি। আশা করছি, আলোচনার প্রেক্ষিতে মাননীয় সভানেত্রী তার প্রাজ্ঞ সিদ্ধান্ত প্রদান করবেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, ৩০শে এপ্রিলের বৈঠকে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকরা তাদের বিভাগ অনুযায়ী প্রতিবেদন দেবেন। কোন কোন বিভাগে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। এবং কোন প্রেক্ষাপটে তারা প্রার্থী হয়েছেন সে বিষয়টিও সাংগঠনিক সম্পাদকদের রিপোর্টে উপস্থাপিত হবে। এরপর যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে ‘কারণ দর্শানো নোটিশ’ জারি করা হতে পারে বলে আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে। এরপর ‘কারণ দর্শানোর নোটিশ’-এর জবাবের প্রেক্ষাপটে তাদেরকে সতর্ক করা বা স্বজনদেরকে পদ-পদবি থেকে সরিয়ে দেয়ার মতো পদক্ষেপগুলো নেয়া হবে। এর বাইরে সম্প্রতি বিএনপি রাজপথে তাদের কর্মসূচি ঘোষণা করে। দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ দলীয় নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে নয়াপল্টন বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ওই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তীব্র দাবদাহের কারণে তারা কর্মসূচি স্থগিত করেন। আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করছেন, রাজনীতি আবারও রাজপথে গড়াবে। এক্ষেত্রে আমাদের ভূমিকা কী হবে তার নির্দেশনা দেবেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। আবার ১৪ দলীয় জোটের সঙ্গে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক জোট কেমনভাবে এগোবে তা নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হতে পারে বলে জানান দলটির নেতারা। তারা মনে করছেন, দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও দলীয় পরিস্থিতি নিয়ে গণভবনের বৈঠক থেকে বিশেষ দিক-নির্দেশনা দেবেন শেখ হাসিনা।
manabzamin