এক সময় নিষিদ্ধ ঘোষিত চরমপন্থি দলগুলোর চাঁদাবাজি, অপহরণ ও খুনাখুনিতে ‘মৃত্যু উপত্যকায়’ পরিণত হয়েছিল খুলনা। তাদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে চরম আতঙ্কে থাকত মানুষ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযান ও ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দলগুলোর অধিকাংশ নেতা নিহত হন। তাদের বড় একটি অংশ নিষ্ক্রিয় হয়েছে এবং গা-ঢাকা দিয়েছে। অনেকে ভিড়ে গেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে এবং হয়েছেন জনপ্রতিনিধিও।
এই চরমপন্থিদের নিয়ে মানুষের মধ্যে আবারও দেখা দিয়েছে আতঙ্ক।
শিমুলের আপন ভাই শিপলু ভূঁইয়াও দীর্ঘদিন চরমপন্থি দলে সক্রিয় ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কাশেম হত্যাসহ এক ডজন মামলা ছিল। প্রায় ৯ বছর কারাভোগের পর ২০১৩ সালের শেষ দিকে জামিনে মুক্তি পান শিপলু। ২০১৪ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ২০১৬ সালে নৌকা প্রতীক নিয়ে দামোদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০২১ সালে ফের নির্বাচিত হয়ে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। শিমুল গ্রেপ্তারের পর শিপলু গা-ঢাকা দিলেও এখন এলাকায় আছেন। তাঁর স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন মুক্তা ২০২২ সালে বিনা প্রতিদ্বিন্দ্বায় খুলনা জেলা পরিষদের সদস্য হন। শিমুলের ভয়ে তাঁর বিরুদ্ধে কেউ প্রার্থী হননি। শিমুল গ্রেপ্তারের পর থেকে ফুলতলার বাড়িতে নেই তাঁর স্ত্রী।
পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি নেতা ও একাধিক মামলার আসামি খুরশিদ মোড়লের বাড়ি ফুলতলা উপজেলার দামোদর গ্রামে। এলাকার মানুষ তাঁকে নিয়ে এখনও আতঙ্কে থাকেন। বর্তমানে এলাকায় আছেন এবং আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে অংশ নেন।
সরকারের সাধারণ ক্ষমার আওতায় এক সময় আত্মসমর্পণ করেছিলেন বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি নেতা ফুলতলার পয়গ্রামের ফারুক মোল্লা। বর্তমানে তিনি ফুলতলা ইউপির সদস্য। কোনো পদ না থাকলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগে সক্রিয় তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে ফুলতলা সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোল্লা হেদায়েত হোসেন লিটুকে গুলি করে হত্যাচেষ্টাসহ নানা অভিযোগে মামলা রয়েছে।
এ ছাড়া সরকারের সাধারণ ক্ষমার আওতায় আত্মসমর্পণ করা বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ফুলতলার ১৮ জন এলাকাতেই রয়েছেন। তারা সবাই আওয়ামী লীগের মিছিল-সমাবেশে অংশ নেন। নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন ডুমুরিয়ার রফিক জোয়ার্দ্দার। তিনি এখন রুদাঘরা ইউপি সদস্য ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। একই দলের সদস্য শেখ শফিকুল ইসলাম লিটু এখন উপজেলা শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক। এই দলের এক সময়ের সদস্য ও বর্তমানে শোভনা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত কুমার বৈদ্য উপজেলা কৃষক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক।
বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির খুলনা অঞ্চলের প্রধান গাজী কামরুল ২০১১ সালে জামিনে কারাগার থেকে বের হন। বর্তমানে নগরীর দৌলতপুর থানার দেয়ানা এলাকার বাড়িতেই থাকেন। জামিনে বের হওয়ার পর থেকে তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ ওঠেনি। তবে আওয়ামী লীগের এক নেতার ছত্রছায়ায় থাকেন বলে পুলিশ জানিয়েছে।
পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (এম এল) শীর্ষ নেতা মাশিকুল ইসলাম চৌধুরী ওরফে জয়কে ২০১২ সালের ৭ ডিসেম্বর তেরখাদা থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যাসহ একডজন মামলা রয়েছে। জামিনে বেরিয়ে এলাকাতেই থাকেন। তিনি ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় থাকেন বলে জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন ডুমুরিয়া উপজেলার অজয় সরকার। ২০২১ সালের ৫ জানুয়ারি জেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা হলে তিনি তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক পদ পান। গত বছর এই পদ থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। বর্তমানে ঢাকায় ব্যবসায় যুক্ত।
এর আগে নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ও তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ছিলেন বটিয়াঘাটার জলমা এলাকার গফুর মোল্লা। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যাসহ অর্ধ ডজন মামলা ছিল। চরমপন্থি দল থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে তিনি জলমা ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। বর্তমানে আওয়ামী লীগে সক্রিয়।
পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ নেতা মো. নাসিমুল গণি ওরফে নাসিম দীর্ঘদিন পালিয়ে থাকার পর ২০২৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বগুড়া থেকে গ্রেপ্তার হন। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যাসহ ১০টি মামলা রয়েছে। তাঁর বাড়ি দিঘলিয়া উপজেলার ফরমাইশখানা গ্রামে। কিছুদিন আগে জামিনে কারাগার থেকে মুক্তি পান। জেলা ডিবি পুলিশের একটি সূত্র জানায়, গত মাসে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে তিনি আওয়ামী লীগের এক প্রার্থীর পক্ষে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন। এ অভিযোগে তাঁকে আটকের জন্য অভিযান চালানো হয়েছিল।
সংসদ সদস্য আজীম হত্যার ঘটনায় গত মাসে ভারতে গ্রেপ্তার জিহাদ হাওলাদারের বাড়ি দিঘলিয়া উপজেলার বারাকপুর গ্রামে। সংসদ সদস্যকে হত্যার পর জিহাদ লাশ টুকরো টুকরো করেছিল। জিহাদ ও তার ভাই জায়েদ হাওলাদার চরমপন্থি নেতা শিমুলের অনুসারী বলে পুলিশ জানায়। তার বিরুদ্ধে দিঘলিয়া থানায় অস্ত্রসহ তিনটি মামলা রয়েছে। তার ভাই জায়েদ গত বছর ২৪ মার্চ আওয়ামী লীগ নেতা শেখ আনসার উদ্দিন হত্যা মামলার আসমি এবং পলাতক।
সন্ত্রাসী-চরমপন্থিদের তৎপরতা নিয়ে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. মোজাম্মেল হক বলেন, নগরীতে সন্ত্রাসী দমনে তারা কঠোর অবস্থানে রয়েছেন। চরমপন্থি দলের যারা জামিনে রয়েছেন, তাদের কর্মকাণ্ড নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
samakal