হেফাজতের ঢাকার সমাবেশ স্থগিতের নেপথ্যে ৪ কারণ

পিছু হটেছে হেফাজতে ইসলাম। ২৯ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েও তা হঠাৎ স্থগিত করেছে দলটি। এ নিয়ে দলের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। হেফাজতের সরকারবিরোধী অংশ তীব্র নাখোশ হয়েছে এমন সিদ্ধান্তে। তারা মনে করছে, এতে হেফাজতের সাংগঠনিক শক্তি আরও দুর্বল হবে। হেফাজতের ওপর সরকার আরও চেপে বসবে।

এদিকে হেফাজতের অপর দুটি অংশের নেতারা মনে করছেন, এই মুহূর্তে কর্মসূচি স্থগিত করায় কৌশলগত কারণে এখান থেকে ভবিষ্যতে সুবিধা পাবে তারা। নেতাকর্মীর জামিন ও মামলা প্রত্যাহারের প্রধান দুই দাবির ব্যাপারে সরকারকে এখন আরও জোরালোভাবে দাবি জানাতে পারবে তারা। কর্মসূচি স্থগিত করায় নতুন করে সংঘাতে জড়াতে হলো না। বিএনপি-জামায়াতও ঘুঁটি হিসেবে আর ব্যবহার করতে পারল না তাদের। এই ইস্যু সামনে রেখে পাঠ্যপুস্তক সংশোধনসহ অন্য দাবি আদায়েও সরকারের সঙ্গে জোরালোভাবে কথা বলা যাবে।

ভোটের আগে এমন কর্মসূচি পালন না করতে সরকারের পক্ষ থেকে হেফাজতকে অনুরোধ করা হয়েছিল। কারণ, নির্বাচন ঠেকাতে একই সময়ে জামায়াত এবং বিএনপিও ঢাকাকেন্দ্রিক যুগপৎ আন্দোলনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এ সময়ে অঘটন ঘটলে তার দায় বর্তাবে হেফাজতের ওপর– সরকারের পক্ষ থেকে এমন বার্তাও দেওয়া হয়েছে। হেফাজতের সরকারঘনিষ্ঠ অংশের মাধ্যমে এই বার্তা দেওয়া হয়। এই ইস্যুতে হেফাজতের মধ্যে সক্রিয় ছিল তিনটি ধারা।

হেফাজতের সরকারবিরোধী অংশ চেয়েছে, যে কোনো মূল্যে ঢাকায় কর্মসূচিটি পালন করতে। তারা চেয়েছে ভোটের মাঠে উত্তাপ বাড়াতে। মামুনুল হকসহ কারাবন্দি নেতাদের মুক্তি এবং মামলা প্রত্যাহারের এটাই মোক্ষম সময় বলে মনে করছে তারা। এই অংশটি ভোটের আগে টানা কর্মসূচিরও পক্ষে ছিল। তবে সরকারঘনিষ্ঠ অংশের নেতারা এই মুহূর্তে এমন কর্মসূচির বিপক্ষে ছিলেন। এ দুই ধারার বাইরে হেফাজতে আছে মধ্যপন্থি আরেকটি ধারা।

নেতাকর্মীর মুক্তির দাবিতে একমত হলেও তারা চায়নি এই ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে এমন সময়ে নতুন করে বিরোধে জড়াতে। নরমে গরমে দাবি আদায় করে নেওয়ার পক্ষে ছিল তারা। শেষ পর্যন্ত জয় হয়েছে এই অংশেরই।

কর্মসূচি স্থগিত করা প্রসঙ্গে হেফাজতের মহাসচিব সাজিদুর রহমান বলেন, ৮ ডিসেম্বর বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে আমরা সমাবেশ করেছি।
মামুনুল হকসহ কারাবন্দি নেতাকর্মীর মুক্তি, ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত হেফাজত নেতাকর্মীর নামে করা সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং জাতীয় শিক্ষা কারিকুলাম থেকে ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক সব বিষয় বাতিলের দাবিতে ২৯ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু হেফাজতের নীতিনির্ধারণী ফোরামের মুরব্বিরা দেশের চলমান সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে এ সময় আপাতত সমাবেশ না করার সিদ্ধান্ত দেন। এখানে অন্য কোনো কৌশল নেই।

তবে হেফাজতের নায়েবে আমির মুহিউদ্দীন রাব্বানী বলেন, আমরা সরকারের অনুরোধে সাড়া দিয়েছি। এখন বল সরকারের কোর্টে। আমাদের ন্যায্য দাবি আশা করি মেনে নেবে তারা।
সরকারের কাছে এতটা আশা করেন না আরেক যুগ্ম সচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী। তিনি বলেন, মুরব্বিরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন; তাই কর্মসূচি স্থগিত হয়েছে। তবে আমি মনে করি, এতে লাভ হবে না। সরকারকে নমনীয় বার্তা অনেকবার দিয়েছি। কিন্তু কাজ হয়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক যুগ্ম মহাসচিব বলেন, হেফাজতের সবাই চায় মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার হোক। আটক নেতাকর্মীরা মুক্তি পাক। সরকারেরও একটি অংশ এতে একমত। নতুন করে বিরোধে জড়ালে লাভের চেয়ে ক্ষতি হতো বেশি। সরকারের সঙ্গে এখন আরও জোরালোভাবে কথা বলতে পারব আমরা।

ভোটের আগে ঢাকায় এবারে নতুন কর্মসূচি দিতে তৎপর ছিলেন হেফাজতের সরকারবিরোধী অংশের নেতারা। তাদের মধ্যে আছেন– মাওলানা মাহফুজুল হক, জুনায়েদ আল হাবীব, মুহিউদ্দীন রাব্বানী, ফজলুল করীম কাসেমী, মাওলানা আজিজুল হক, মীর ইদরিস প্রমুখ। ঢাকার বিক্ষোভ সমাবেশে তাদের অনেকে বক্তব্যও দেন।
২০১৩ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলার সময় এই আন্দোলনের পুরোধাদের ‘নাস্তিক’ আখ্যা দিয়ে ৫ মে রাজধানী অবরোধ করে হেফাজত। গত এক দশকে সমীকরণ পাল্টেছে অনেকটাই। এর মধ্যে কওমি মাদ্রাসাকে স্বীকৃতি দেয় সরকার। হেফাজতের মধ্যে তাই সক্রিয় হয় সরকার পক্ষের একটি ধারা। এই পক্ষ সংঘাতে না গিয়ে আলোচনার মাধ্যমে দাবি আদায় করতে চাচ্ছে।

সমকাল