ক্রসফায়ার ক্রস-চেক/ লিংক রোডে হঠাৎ পুলিশের চিৎকার, এরপরই যুবকের পায়ে ঠাণ্ডা মাথার গুলি

ctgpratidin.com

কথিত বন্দুকযুদ্ধের আগে সোর্স এসে দিয়ে যায় সাদা ব্যাগ

‘বন্দুকযুদ্ধ’— এই শব্দবন্ধের সঙ্গে মোটামুটি সবাই পরিচিত। থানায় আটক বন্দিকে নিয়ে কথিত অস্ত্র উদ্ধার, গুলি-পাল্টা গুলির মাঝে পড়ে এই ‘বন্দুকযুদ্ধে’ শেষ পর্যন্ত প্রাণ হারান বন্দি। প্রাণ না হারালেও অনেকেই হারান অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। ‘বাধ্য হয়ে আত্মরক্ষার্থে’ এমন ঘটনা ঘটে— প্রতিবার এমনটিই দাবি করা হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে। এমনই এক ঘটনায় কথিত বন্দুকযুদ্ধে প্রাণে বাঁচলেও ঠান্ডা মাথার বুলেটে পা হারান সাইফুল নামের চট্টগ্রামের এক যুবক। পুলিশের পাঠানো প্রেসরিলিজের বরাত দিয়ে ‘দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীর সঙ্গে পুলিশের বন্দুকযুদ্ধ’ হিসেবে পত্রপত্রিকায় প্রচারিত হলেও ঘটনাটি যাচাই করতে গিয়ে জানা গেল চাঞ্চল্যকর কাহিনী।

সাইফুল ইসলাম চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রদলের সহ-সাধারণ সম্পাদক। তার বিরুদ্ধে আছে প্রায় দেড় ডজন মামলা। যদিও অপরাধজগতের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা আছে— এমন দাবি পুলিশ করলেও সাইফুলের অভিযোগ, বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকার কারণেই তাকে জড়ানো হয়েছে একের পর এক মামলায়। তার অভিযোগ, রাজনৈতিক কারণেই তিনি পুলিশের চক্ষুশূল হয়েছেন। আর এ কারণেই পুলিশের ঠান্ডা মাথার গুলিতে তাকে চিরতরে হারাতে হয়েছে একটি পা।

কথিত বন্দুকযুদ্ধের আগে সাইফুলকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে জামান হোটেল থেকে। পরে পুলিশ দাবি করে, তাকে লিংক রোড থেকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

২০২১ সালের ১৬ জুন জনসম্মুখ থেকে ধরে নিয়ে সাইফুলকে পায়ে গুলি করে ফেলে রাখা হয় চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ লিংক রোড এলাকায়। ঘটনার পরদিন পুলিশ জানায়, সাইফুল পুলিশের ওপর গুলি করে, আর পুলিশও পাল্টা গুলি করলে সেই গুলি লাগে তার হাঁটুতে। আর এতেই তার একটি পা হারাতে হয়। কিন্তু দেখা গেছে, সাইফুলের একটি পা নিয়েও শান্ত হয়নি বায়েজিদ থানার পুলিশ।

ক্রসফায়ারে পা হারানোর পর দ্বিতীয় দফায় সাইফুলকে চট্টগ্রামের কোর্ট বিল্ডিং এনেক্স-২ বিল্ডিংয়ের সামনে থেকে আটক করা হয়। পরে পুলিশ দাবি করে তাকে মুরাদপুর থেকে আটক করা হয়েছে।

পা হারানোর পর ৯ মাস জেল খেটে জামিনে বেরিয়ে সাইফুল ঘুমাতে পারছেন না পুলিশের হয়রানিতে। কিছুদিন পর পরই বায়েজিদ থানা পুলিশের টহল টিম গিয়ে হানা দেয় তার বাড়িতে। এমনকি মধ্যরাতে গিয়েও পুলিশ ভাঙচুর করেছে তার বাড়িতে।

হঠাৎ কয়েকজন পুলিশ ‘ডাকাত ডাকাত’ চিৎকার করে ফাঁকা গুলি ছুঁড়তে থাকে। এরপরই সাইফুলের বাম পায়ে গুলি। তারই নমুনা ওঠে আসে এক্সরে রিপোর্টে।

সাইফুলের সঙ্গে কী ঘটেছিল কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধের’ সেই রাতে, চট্টগ্রাম প্রতিদিন সেই ঘটনা জানতে মুখোমুখি হয়েছিল সাইফুলের।

জামান হোটেল থেকে ধরে নিয়ে গ্রেপ্তার লিংক রোডে

২০২১ সালের ১৬ জুন। রাত তখন ৮টা। নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার জন্য বের হলে সাইফুলকে ফোন দেন বায়েজিদ থানার সোর্স আকাশ। ফোনের ওপাশ থেকে সোর্স আকাশ জানান, একটি মামলার বিষয়ে জরুরি কথা আছে, দেখা করতে হবে এখনই। সাইফুলও দেরি না করে আকাশের দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী নগরীর অক্সিজেন মোড়ে গিয়ে পৌঁছান।

সোর্স আকাশের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তারা কথা বলার জন্য অক্সিজেনের জামান হোটেলে যান। খাবার অর্ডারের পর মামলার বিষয়ে কথা শুরু করেন। ১৬ জুন রাত পর্যন্ত সাইফুলের নামে ১৮টি মামলা ছিল। অর্ধেক খাওয়ার পর সাইফুল ও আকাশকে হঠাৎ সাদা পোশাকে এসে ঘিরে ধরেন বায়েজিদ থানার সদ্য বিদায়ী ওসি কামরুজ্জামান, এসআই মেহের অসীম দাশ, এসআই তানভীর, রবিউল, সাইফুলসহ আরও তিন পুলিশ সদস্য। তাদের সবাই মাস্ক পরা ছিলেন।

চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে সাইফুল বলেন, ‘এ সময় ওসি কামরুজ্জামান টেবিলের ওপরে থাকা আমার মোবাইল ও বাইকের চাবি নিয়ে পেটে পিস্তল ঠেকিয়ে বলেন—একদম চুপ, কোনও কথা বলবি না। এরপর একজন আমাকে মাস্ক পরিয়ে হোটেলের সামনে থাকা একটি সাদা রঙের প্রাইভেট কারের ভেতর ঢুকিয়ে চোখেমুখে গামছা দিয়ে এবং হাতে হাতকড়া পরিয়ে গাড়ির দরজা বন্ধ করে দেন তারা।’

তিনি বলেন, ‘গাড়ি ঘণ্টাখানেক চলার পর আমি গামছার নিচ দিয়ে দেখলাম গাড়িটি ব্লুসম গার্ডেন নামের কোনো এক রেস্টুরেন্টের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপর ওসি কামরুজ্জামান ফোন করে অপর প্রান্তে থাকা কাউকে নির্দেশ দিচ্ছিলেন, ‘তোমরা ড্রেস পরে জামানে যাও, তারপর রাত ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত হোটেলের সব সিসিটিভি ফুটেজ ডিলিট করে দাও। আর বলবা ওপরের নির্দেশ আছে।’

‘আমাকে প্রাইভেট কারের পেছনের সিটের মাঝখানে রেখে আরও দুজন দুই পাশে এবং ওসি নিজে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছিলেন। গাড়িতে থাকা কেউই কোনো কথা বলছে না। তখন আমি বলি, ‘স্যার, আমার পরিবার আছে, ছোট ভাই-ব্রাদার আছে, আমাকে আপনারা মামলা দিয়ে কোর্টে চালান করে দেন। অথবা টাকা-পয়সা লাগলে বলেন, আমি টাকা দেবো। কিন্তু তারা কোনো সাউন্ড করেননি’—যোগ করেন সাইফুল।

ওই রাতের ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া না গেলেও সেদিনের ঘটনার একটি ছবি নিজের মুঠোফোনে ধারণ করেন সাইফুলের এক পরিচিত লোক। ছবিতে সাদা পোশাকে মাস্ক পরা একাধিক পুলিশকে জামান হোটেলের ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।

তবে এর ১০ দিন পর সাইফুলকে আটকের বিষয়ে নগর পুলিশের তৎকালীন অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ্ আব্দুর রউফ গণমাধ্যমকে জানান, ২৬ জুন রাতে সাইফুলকে লিংক রোড এলাকার এশিয়ান ওম্যান ইউনিভার্সিটির গেটের সামনে থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

‘টাকা দে ৫ লাখ, না হয় শেষ করে দেবো, কালেমা পড়’

সাইফুল বলেন, ‘রাত ৯টার পর থেকে গাড়িতে করে আমাকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরার পর রাত সাড়ে ১২টা থেকে ১টার দিকে নিয়ে যাওয়া হয় বায়েজিদ লিংক রোডে। চোখ গামছা দিয়ে বন্ধ থাকলেও গামছার নিচ দিয়ে রাস্তাটি দেখে চিনে ফেলি। আমাকে একা রেখে গাড়ি থেকে সবাই নিচে নেমে যায়। এর কিছুক্ষণ পর আমার চোখের গামছা খুলে এসআই অসীম এসে বলে—সাইফুল, টাকা দে ৫ লাখ, ওপর থেকে অর্ডার আসছে, শেষ করে দেবো তোরে, কালেমা পড়।’ তখন আমি বলি, পসিবল না স্যার, আরেকটু কমাই-সমাই বলেন। তখন অসীম ‘যাহ্ ব্যাটা’ বলে গাড়ি থেকে নেমে যায়।

অবশ্য সাইফুলের এই বিবরণ ‘মিথ্যা’ দাবি করে বায়েজিদ থানার এসআই মেহের অসীম দাশ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি যেহেতু সাইফুলের মামলার আইও, তাই আমি মামলাগুলো তদন্ত করে রিপোর্ট জমা দিই। রিপোর্টগুলো ওর বিরুদ্ধে যাওয়াতে সে রাগ-ক্ষোভ থেকে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে।’

সোর্স এসে দিয়ে যায় সাদা ব্যাগ

চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে সাইফুল বলেন, ‘আমি গাড়িতে একা বসে বসে দোয়া-দরুদ পড়ছি। আমাকে নিয়ে যখন পুলিশ ঘুরছিল তখন গাড়িতে থাকা এসআই সাইফুল বলছে, ‘তুই নাকি কোরআনে হাফেজ? একটু কোরআন তেলওয়াত শোনা’।  আমি ওনাদের শুনিয়েছি। কিন্তু যখন ওরা আমাকে লিংক রোডে নিয়ে যায়, তখন আমি ওনাদের অনুরোধ করি—স্যার আমার হাতটা খুলে দেন, আমি একটু নামাজ পড়তে চাই। কিন্তু তারা খোলেনি। আমি কারের ভেতরেই হাত বাঁধা অবস্থায় বসে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়েছি।’

তিনি বলেন, ‘এরপর দেখলাম একটা টহল পুলিশের গাড়ি থেকে সাদা ব্যাগভর্তি কী যেন নিয়ে নামছে পুলিশের সেই সোর্স আকাশ। তারপর ব্যাগটা সাদা পোশাকে থাকা একজনের হাতে দেয় আকাশ। মনে হয় সেখানে আর্মসজাতীয় কিছু ছিল। ব্যাগ পাওয়ার পর পরই আমার হাতকড়া খুলে দিয়ে হাত দুটো পেছন দিকে নিয়ে গামছা দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিল। আর মুখেও শক্ত করে গামছা দিয়ে বেঁধে দিল। তারপর আমাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে মেইন রোডের পাশে মাটির রাস্তায় উপুড় করে শুইয়ে দিল। তখন আমি ভয়ে কামেলা তৈয়ব পড়তেছি, দোয়া পড়তেছি।’

হঠাৎ ‘ডাকাত ডাকাত’ চিৎকার, এরপরই ওসির গুলি

সেই রাতের ঘটনার বিবরণ দিয়ে সাইফুল বলেন, ‘এসআই সাইফুল-অসীমরা আমাকে শক্ত করে চেপে ধরেছে মাটির সঙ্গে। অকথ্য ভাষায় গালাগালও দিচ্ছিল তারা। গাড়িতে থাকা অবস্থায় যখন ঘটনার বিষয়টি বুঝতে পারছিলাম, তখন ওসিকে একাধিকবার অনুরোধ করে বলেছি, স্যার আমাকে মাফ করে দেন, আমি দরকার হলে রাজনীতি ছেড়ে দেব। এলাকা ছেড়ে চলে যাবো, ভালো হয়ে যাবো। দরকার হলে ৫ লাখ টাকাই দেবো, তাও ক্ষমা করে দেন।’

‘এরপর আমাকে যখন কার থেকে নামানো হলো তখন লিংক রোডের দু’পাশে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর কয়েকজন পুলিশ ‘ডাকাত ডাকাত’ চিৎকার করে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুঁড়তে থাকে। তখন ওসি কামরুজ্জামান আমার বাম পায়ে একটা শ্যুট করেছে। একদম হাঁটুতে, নিচে, শর্টগান দিয়ে। এর এক মিনিট পর অসীম দাশ দৌড়ে এসে ওসির হাত থেকে শর্টগান নিয়ে আরও একটা শ্যুট করেছে। এরপর আর কিছু জানি না আমি, অজ্ঞান হয়ে যাই। যখন জ্ঞান আসে তখন দেখি, আমি চট্টগ্রাম মেডিকেলের বেডে শুয়ে আছি। ডাক্তাররা আমাকে স্যালাইন দিচ্ছে’—যোগ করেন সাইফুল।

ঢাকার ডাক্তার বললেন, পা রাখা আর সম্ভব না

চট্টগ্রাম মেডিকেলে ভর্তির পরও পরিবারকে কোনো খবর জানায়নি পুলিশ। জ্ঞান ফেরার পর ডাক্তারের নম্বর থেকেই পরিবারকে ঘটনার বিষয়ে জানান সাইফুল। চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে সাইফুল বলেন, ‘ডাক্তারের নম্বর থেকে ফোন দিছি আমার গার্ডিয়ানকে। এরপর আমার গার্ডিয়ানরা মেডিকেলে এসে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে। ডাক্তার বলে, আমার পা বাঁচাতে চাইলে আমাকে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে দ্রুত। পরে আমার পরিবার আমাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলে ওসি বলে, ‘ওরে ঢাকা নেওয়া যাবে না। সে সন্ত্রাসী, তারে আমরা স্কট (পুলিশি পাহারা) দিতে পারবো না’। কিন্তু কিছুক্ষণ পর কী মনে করে ওসি আবার বলতেছে, ‘ঠিক আছে, নিয়ে যান, আমরা স্কট দিয়ে ওরে ঢাকায় পাঠাব।’

তিনি বলেন, ‘ঘটনার পরদিন ২৭ জুন বিকাল প্রায় সাড়ে ৪টার দিকে আমার পরিবার ১৮ হাজার টাকা দিয়ে একটা অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে। অ্যাম্বুলেন্সটি যাত্রা শুরুর পর সঙ্গে যাওয়া পুলিশ প্রথমে সিটি গেটে গিয়ে গাড়ি থামায় প্রস্রাবের জন্য। আবার কুমিল্লা গিয়ে দাঁড়ায় নাস্তার জন্য। আরেকটু যাওয়ার পর তাদের আবার প্রস্রাবের জন্য দাঁড়াতে হয়। এভাবে পুরো রাস্তায় অনেকবার গাড়ি থামিয়ে দেরি করে ৮-৯ ঘণ্টা লাগাইছে ঢাকা পৌঁছাইতে। এদিকে আমার রক্ত বের হতেই চলেছে, তখনও পা কাটেনি।’

সাইফুল বলেন, ‘সব থেকে কষ্টের বিষয় হলো, আমাকে যখন পঙ্গু হাসপাতালে নামানো হলো, তখন পুলিশগুলো আমার পরিবার থেকে চা নাস্তার খরচ নেয় ১ হাজার টাকা করে। পরে পঙ্গু হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তার বলেছে, দেরি হয়ে গেছে, এখন পা রাখা সম্ভব না। ওকে বাঁচাতে হলে পা ফেলে দিতে হবে। যদি আর্লি আসা যেতো তাহলে পা বাঁচানো যেতো। সেখানেই সেদিন অপারেশন করে আমার পা কেটে ফেলা হয়। ১৬ দিন ঢাকায় চিকিৎসার পর আমাকে চট্টগ্রামের জেলে ঢোকানো হয়।’

বড় বিপদের আভাস আগেই দিয়েছিল সোর্স

ঘটনার বেশ কয়েকদিন আগেই বড়সড় কোনো বিপদের কথা সাইফুলকে জানিয়েছিল বায়েজিদ থানা পুলিশের সোর্স আকাশ। ওই সোর্স ফোন করে সাইফুলকে সাবধান করে জানিয়েছিলেন, ‘একটু সাবধানে থাকিস, তোর ওপর পুলিশ গরম হইছে। এবার ধরতে পারলে হয়ত বড় কোনো অস্ত্র দিয়ে চালান দেবে। না হয় একটা উল্টা-পাল্টা কাজ করেই ফেলবে।’

সেই কথা টেনে সাইফুল চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আকাশ বায়েজিদ থানায় আমার নামে কোনো ওয়ারেন্ট আসলে বা মামলার খুঁটিনাঁটি বিষয়ে আমাকে বলতো। তাই ওকে বিশ্বাস করতাম আমি। সেই বিশ্বাস থেকে ঘটনার একদিন আগে আমি আমার ফেসবুক লাইভে এসে বলেছি, এবার আমাকে ধরতে পারলে নাকি সাইজ করবে। লাইভটা এখনও আছে ফেসবুকে।

‘পা যেটা আছে ওটাও খাই ফেলব’

জামিনে মুক্ত হওয়ার পরও প্রতিনিয়ত আতঙ্ক যেন সঙ্গী ছিল সাইফুলের। কয়েকদিন পর পর মধ্যরাতে তল্লাশির নামে তার বাসায় চালানো হতো ভাঙচুরও। পরিবারের সদস্যদেরও নির্যাতন করা হতো বলে জানান সাইফুল।

সাইফুল বলেন, ‘চলতি বছরের ৭ এপ্রিল জামিনে মুক্ত হই, কিন্তু এর চারদিন পর ১১ এপ্রিল রাতে ফোর্স নিয়ে আমার বাসায় আসে এসআই রবিউল। সে আমার পরিবারকে বলে, ‘পা হারানোর ঘটনায় যেন কোনো মামলা-টামলাতে না যাই। শান্তিতে আছে, শান্তিতে থাকতে বলো। না হয় পা যেটা আছে সেটাও খাই ফেলব।’

তিনি বলেন, ‘তারপরও কোনো ধরনের মামলায় যাইনি আমরা। কারণ পুলিশের সঙ্গে পেরে উঠবো না জানি। এ ঘটনার কিছুদিন পর কেন্দ্রীয় বিএনপির একটা অনুষ্ঠান ছিল এ বছরের ২৭ মে। সেটাতে আমি মিছিল নিয়ে টেকনিক্যাল মোড় থেকে রুবি গেট পর্যন্ত যাই। সেদিন রাত ২টায় আমার বাসায় আসে পাঁচলাইশ থানা পুলিশ। তারা এসে আমার বাসার সিসিটিভি ক্যামেরাসহ ঘরের জিনিস ভাঙচুর করে। ঘরের গেট ভাঙে এবং আমার ছোটবোনকে চুলের মুঠি ধরে টান মারে। আমার পরিবারকে বলে, ‘এবার মারি ফেলব, এখনো শান্ত হয় নাই? পা আরেকটা খাই ফেলব।’

কোর্টবিল্ডিং থেকে গ্রেপ্তারের পরও আদালতে মিথ্যা তথ্য

ঘটনাগুলোর পর পরিবারের চাপে রাজনীতি থেকে অনেকটা দূরে সরে আসেন সাইফুল। কিন্তু সেদিনের মিছিল করার পর থেকে পাঁচলাইশ থানার পুলিশ কেন যেন তার ওপর ‘গরম’ হয়। অন্য একটি মামলার হাজিরা দিতে গত ২৭ জুন কোর্ট বিল্ডিংয়ে গেলে বিকাল ৪টার দিকে এনেক্স ভবন-২ এর সামনে থেকে সাদা পোশাকের ৫-৬ জন লোক সাইফুলের বাইকের গতিরোধ করে চাবি নিয়ে ফেলে।

এ বিষয়ে সাইফুল বলেন, ‘তাদের পরিচয় জানতে চাইলে তারা বলে পাঁচলাইশ থানার। তখন আমাকে ও আমার বাইকের চালককে তারা একটি পুলিশের গাড়িতে করে থানায় নিয়ে যায়। সেদিন রাতেই আমাকে চোখবন্ধ অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয় নগরীর রহমাননগর ১ নম্বর রোডে। সেখানে কিছু কিরিচ ও ছুরি বের করে স্থানীয় এক দোকানদারকে বলে, ‘তুমি বলবা, এগুলো এখান থেকেই পাইছি।’ এরপর দোকানদারের কাছ থেকে সই নেয় একটা কাগজে।’

‘পরের দিন জানতে পারি, আমাকেসহ মোট পাঁচজনকে নাশকতার পরিকল্পনায় মিটিং করার জন্য নাকি রাত ১২টায় আটক করেছে। সেজন্য কিরিচ ও ছুরিসহ কোর্টে চালান করে দেয় এবং রিমান্ড চায়। কিন্তু আমার পরিবার আদালত ভবন থেকে আমাকে আটকের ভিডিও কোর্টে দেখায়। তখন জজ পুলিশের এসআইকে জিজ্ঞেস করে, আমাকে কোথা থেকে আটক করছে? পুলিশ বলে, রহমান নগর থেকে। তখন কোর্ট পুলিশের ওপর গরম হয়ে জজ বলেন, ‘মিথ্যা বলছেন কেন? ওকে যে কোর্ট থেকে ধরছেন তার তো প্রমাণ আছে আমার কাছে। তারপর কোর্ট রিমান্ড না দিয়ে জেলে পাঠায়’—বলেন সাইফুল।

যে কারণে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা

গত ৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম চিফ মেট্রোপলিটন আদালতে মামলা করেন মহানগর ছাত্রদলের সহ সম্পাদক মো. সাইফুল ইসলাম সাইফের মা ছেনোয়ারা বেগম (৫০)। সাইফুলকে গুলি করে অস্ত্র দিয়ে ফাঁসানোর অভিযোগে চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কামরুজ্জামানসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। বাকি আসামিরা হলেন— বায়েজিদ থানার উপ পুলিশ পরিদর্শক (এসআই) মেহের অসীম দাশ, মো. সাইফুল ইসলাম, এএসআই মো. রবিউল হোসেন, এসআই কেএম নজিবুল ইসলাম তানভীর, এসআই নুর নবী ও বায়েজিদের আমিন জুট মিল এলাকার বাসিন্দা মো. শাহজাহান ওরফে আকাশ।

পুলিশের বিরুদ্ধে এই মামলার বিষয়ে সাইফুল বলেন, ‘পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করতাম না। আমি ভালোও হয়ে গেছি, রাজনীতিও ছেড়ে দিছি। কিন্তু সেকেন্ডবার গ্রেপ্তার হওয়ার পর জামিনে যখন মুক্ত হই, তার ঠিক তিন দিন পর আবার বায়েজিদ ও পাঁচলাইশ থানা পুলিশ আমার ঘরে গিয়ে হুমকি-ধমকি দিয়ে আসে। পরিবারের সদস্যদের আজেবাজে কথা বলে আসে। এরপর আমার মা বাধ্য হয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। না হয় আমার পা গেছে যাক, আমি মামলা করতাম না। কিন্তু পা যাওয়ার পরও তো ওদের অত্যাচার বন্ধ হচ্ছে না।’

অভিযোগ আছে সাইফুলের বিরুদ্ধেও

পুলিশের ভাষ্যমতে, সাইফুল ওরফে বার্মা সাইফুল বায়েজিদ বোস্তামী থানার বার্মা কলোনি, হিলভিউ, মোহাম্মদনগর, আমিন জুট মিলস, আলীনগর, পাঁচলাইশ থানাধীন ফরেস্ট, রংপুর কলোনি ও হামজারবাগ এলাকায় ত্রাস হিসেবে পরিচিত। বার্মা কলোনির সরকারি জমি তিনি ও তার দুই ভাই সবুজ ও সামশু বিভিন্ন সময় মানুষের কাছে বিক্রিও করেছেন। এ ছাড়া সেখানে বসবাসকারীদের মাসে মাসে চাঁদা দিতে হয় তাদের। কেউ ভবন নির্মাণ করলেও তাদের চাঁদা দিতে হয়। নয়তো তাদের কাছ থেকে চড়া দামে ইট-বালুসহ নির্মাণসামগ্রী নিতে হয়।

পুলিশের অভিযোগ, গত দুই বছরে সাইফুল অন্তত ছয়বার গ্রেপ্তার হলেও বারবার জামিনে বেরিয়ে এসে আবারও অপরাধে জড়ান। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে ২৪টি মামলা আছে। এর মধ্যে ছয়টি মামলা হয়েছে গুলিতে পা হারানোর পর।

এখন ক্রসফায়ারই চাইছেন সাইফুল

চট্টগ্রাম প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপকালে পুলিশের অত্যাচার থেকে বাঁচতে তাকে জনসম্মুখে ক্রসফায়ার দেওয়ার অনুরোধ করেন সাইফুল। ক্রসফায়ারের অনুমতিপত্রে তার মা-বাবা স্বেচ্ছায় স্বাক্ষর দেবেন বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘পুলিশ যদি মনে করে আমার জন্য প্রশাসনের কোনো ক্ষতি হচ্ছে, তাহলে আমাকে জনসম্মুখে ক্রসফায়ার দিক। আমি পঙ্গু মানুষ, বাথরুমে যেতেও অন্যজনের সাহায্য লাগে। আমি এত অত্যাচার আর সহ্য করতে পারছি না।’

মামলা তুলে নিতে ওসির তদবির

ওসি কামরুজ্জামানসহ সবার বিরুদ্ধে মামলা করার দিনই মামলা তুলে নিতে অনুরোধ করে ফোন দেন ওসি কামরুজ্জামান। সাইফুলের রাজনৈতিক এক বড় ভাইকে ফোন করে এ তদবির করেন ওসি নিজেই।

সাইফুল বলেন, ‘সেদিন আমার বড় ভাইকে ওসি ফোন করে বলে, যা হওয়ার তা হই গেছে, ওপরের নির্দেশ ছিল, আমার তো কিছু করার ছিল না। এবার মামলাটা তুলে নিতে বলেন।’

তবে এ অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেছেন ওসি কামরুজ্জামান। তবে ক্রসফায়ারের অভিযোগের বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন বিধায় কোনো মন্তব্য করবেন না একাধিক গণমাধ্যমকে জানান তিনি।

হেফাজতে নির্যাতন শাস্তিযোগ্য অপরাধ