দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ শুধু আফগানিস্তানের ওপরে

কর্মক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারীরা পুরুষের তিন ভাগের এক ভাগ আইনি অধিকার ভোগ করেন। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর চেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পেছনে আছে শুধু আফগানিস্তান।

বিশ্বব্যাংকের ‘নারী, ব্যবসা ও আইন-২০২৪’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এই চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের আগে গত সোমবার ১৯০টি দেশ ও অঞ্চলের ওপর প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। নারী দিবস আগামীকাল ৮ মার্চ, শুক্রবার।

বিশ্বব্যাংক বলেছে, এই প্রতিবেদনে নারীরা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ ও উন্নতির ক্ষেত্রে যেসব বাধা পান, তার সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। বিশ্বে নারীরা গড়ে পুরুষের তুলনায় ৬৪ শতাংশ আইনি সুরক্ষা পান। আইনি সুরক্ষা কাগজপত্রে থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবে তা থাকে না।

‘নারী, ব্যবসা ও আইন’ শিরোনামে বিশ্বব্যাংক দশমবারের মতো প্রতিবেদন প্রকাশ করল। এবার এতে দুটি সূচক তুলে ধরা হয়েছে। একটি সূচকে কাগজপত্রে নারীরা কতটা আইনি অধিকার ভোগ করেন, তা বলা হয়েছে (সংস্করণ ১)। এখানে মাপকাঠি আটটি—অবাধ চলাচল, কর্মক্ষেত্র, মজুরি, বিয়ে, পিতৃত্ব-মাতৃত্ব, ব্যবসার উদ্যোগ, সম্পদ ও অবসরভাতা সুবিধা। প্রতিটি মাপকাঠির অধীনে সুনির্দিষ্ট বিভিন্ন প্রশ্ন ছিল।

দ্বিতীয় সূচকটি (সংস্করণ ২) এবারের প্রতিবেদনে প্রথমবারের মতো অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এটি করা হয়েছে আইনকানুন কতটা রয়েছে এবং তার বাস্তবায়ন কতটা হয়—দুটি মিলিয়ে। বাস্তবায়ন পরিস্থিতি বুঝতে বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া হয়েছে। এখানে দুটি নতুন মাপকাঠি যোগ করা হয়—নিরাপত্তা ও শিশুর পরিচর্যা।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশ প্রথম সূচকে নম্বর পেয়েছে ৪৯ দশমিক ৪। দ্বিতীয় সূচকে নম্বর পেয়েছে ৩২ দশমিক ৫। অর্থাৎ নারীরা পুরুষের চেয়ে তিন ভাগের এক ভাগ অধিকার ভোগ করতে পারেন।

প্রতিবেদন অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের আইনি কাঠামোয় নারীর অধিকার বাস্তব অধিকার পরিস্থিতির চেয়ে ভালো। অবশ্য দুই ক্ষেত্রেই পুরুষের চেয়ে নারীরা পিছিয়ে। বিশেষজ্ঞদের মতামতে বাংলাদেশ নম্বর আরও কম পেয়েছে, ২৬–এর কিছু বেশি।

সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে। আইনকানুনে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের অধিকার সমান। তবে বাস্তবে তা নারীরা ভোগ করতে পারেন না। তিনি বলেন, সবকিছুতেই তো নারীকে পুরুষের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়।

কৃষ্ণা দেবনাথ ধর্ষণের উদাহরণ দিয়ে বলেন, আইনে অপরাধীর কঠোর শাস্তির কথা বলা হয়েছে; কিন্তু বাস্তবে মামলার রায়ে সাজার হার কম।

উল্লেখ্য, ধর্ষণ ও হত্যার মতো গুরুতর ছয়টি অপরাধে ঢাকার পাঁচটি বিশেষ আদালতে ২০০২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত আসা মামলা নিয়ে ২০১৮ সালে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গিয়েছিল, সাজা হয় মাত্র ৩ শতাংশ মামলায়।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বিভিন্ন মাপকাঠির অধীনে ৪০টি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে। এসবের ভিত্তিতে নম্বর পেয়েছে দেশগুলো। প্রশ্নগুলো বিভিন্ন ধরনের অধিকার সম্পর্কিত। যেমন একটি প্রশ্ন ছিল নারীরা কি নিজেদের ইচ্ছামতো চলাচল করতে পারেন? এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নিয়ে উত্তর ছিল, ‘হ্যাঁ’।

আরেকটি প্রশ্ন ছিল, মেয়েরা কি সম্পত্তির উত্তরাধিকারের দিক দিয়ে সমান অধিকার ভোগ করেন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নিয়ে উত্তর ছিল, ‘না’। কর্মক্ষেত্রের বিষয়ে একটি প্রশ্ন ছিল, আইনে কর্মীদের নমনীয় কাজ দেওয়ার অনুরোধ করার সুযোগ দেওয়া আছে? বাংলাদেশ নিয়ে উত্তরটি ছিল, ‘না’।

নারীদের ১৪ সপ্তাহের মাতৃত্বকালীন ছুটির আইনি বিধান আছে কি না, এমন প্রশ্নে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ইতিবাচক উত্তর এসেছে। পুরুষের পিতৃত্বকালীন ছুটি আছে কি না, সে ক্ষেত্রে নেতিবাচক উত্তর এসেছে। সন্তানসম্ভবা নারীকে চাকরি থেকে বাদ দেওয়া আইনে নিষিদ্ধ কি না, সে প্রশ্নে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে উত্তর এসেছে, ‘না’।

বেলজিয়াম এগিয়ে

বিশ্বব্যাংক বলেছে, কোথাও নারীরা সমান অধিকার ভোগ করতে পারেন না। এমনকি সবচেয়ে ধনী দেশগুলোতেও নয়।

যেমন বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে কর্মক্ষেত্রে নারীর অধিকারে সবচেয়ে এগিয়ে রাখা হয়েছে বেলজিয়ামকে। আইনে সেখানে নারী ও পুরুষের অধিকার পুরোপুরি সমান (নম্বর ১০০)। তবে বাস্তবে নারীরা কিছুটা হলেও পিছিয়ে রয়েছেন (নম্বর ৯০)। তালিকায় কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স ও জার্মানি রয়েছে শীর্ষ পাঁচে। সবার পেছনে রয়েছে ফিলিস্তিন (প্রতিবেদনে পশ্চিম তীর ও গাজা উল্লেখ করা হয়েছে), ইয়েমেন, ইরান, আফগানিস্তান ও সুদান।

দক্ষিণ এশিয়ায় সবার ওপরে রয়েছে নেপাল। এরপর রয়েছে ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান।

বাংলাদেশ এগোয়নি

বিশ্বব্যাংকের গত বছরের (২০২৩) প্রতিবেদনে দেখা যায়, কাগজপত্রে আইনি অধিকার সূচকে বাংলাদেশের নম্বর ছিল ৪৯ দশমিক ৪। এবার এই সূচকে একই নম্বর পেয়েছে বাংলাদেশ। মানে হলো, বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে উন্নতি করতে পারেনি।

বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি ও পোশাক খাতের ব্যবসায়ী ফজলুল হকের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, কর্মক্ষেত্র ও ব্যবসার উদ্যোগের ক্ষেত্রে নারী কতটা বৈষম্যের শিকার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সামগ্রিকভাবে কর্মক্ষেত্রে নারীরা নিয়োগকারীর ইচ্ছাকৃত বৈষম্যের শিকার বলে তিনি মনে করেন না। তবে নিয়োগকারী ভেদে কিছু ব্যতিক্রম হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে নারীরা নিয়োগে অগ্রাধিকার পান বলেও তিনি উল্লেখ করেন। যেমন পোশাক খাত।

ব্যবসার উদ্যোগের ক্ষেত্রে নারীরা নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হন বলে মনে করেন ফজলুল হক। যেমন নারীরা সহজে ঋণ পান না। সার্বিক বিষয়ে তিনি বলেন, নারী কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার, সেটা অস্বীকার করা যাবে না। তবে বাংলাদেশ অতীতের চেয়ে অনেক অগ্রগতি অর্জন করেছে।

অবশ্য সার্বিকভাবে নারীর শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের হার কম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস, ২০২২ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রায় ৪১ শতাংশ তরুণ (১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী) নিষ্ক্রিয়। মানে হলো, তাঁরা পড়াশোনায় নেই, কর্মসংস্থানে নেই; এমনকি কোনো কাজের জন্য প্রশিক্ষণও নিচ্ছেন না।

মেয়েদের মধ্যে নিষ্ক্রিয়তার হার বেশি, ৬১ দশমিক ৭১ শতাংশ। ছেলেদের মধ্যে এ হার কম, ১৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ। শ্রমবাজার বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মেয়েদের বাল্যবিবাহ, কাজ পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব, উপযোগী কাজের পরিবেশের অভাবসহ নানা কারণে নারীরা শ্রমবাজারের বাইরে থাকেন।

বৈষম্য কমলে ‘জিডিপি বাড়বে’

নারী-পুরুষ সমানভাবে শ্রমবাজারে প্রবেশ করতে পারলে, ব্যবসার উদ্যোগ নিতে পারলে দেশের অর্থনীতি বড় হবে।

বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীর মুখ্য অর্থনীতিবিদ ইন্দরমিত গিল প্রতিবেদনটি নিয়ে এক বিবৃতিতে বলেন, এখনো বিশ্বব্যাপী বৈষম্যমূলক আইন ও রীতি নারীকে কাজে যোগ দেওয়া ও ব্যবসা শুরুর ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বৈষম্য দূর করা হলে এক দশকে বৈশ্বিক মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বাড়বে ২০ শতাংশ।

Prothom Alo