নরওয়ের দক্ষিণে ফ্রায়ার ফিয়র্ড নামে সাগরের সঙ্গে যুক্ত দীর্ঘ ও গভীর জলপথ দিয়ে এগিয়ে চলা ইয়ারা বার্কল্যান্ড নামের কন্টেইনারবাহী জাহাজটিকে বাইরে থেকে দেখে অস্বাভাবিক কিছুই মনে হবে না। কিন্তু এই জাহাজটিকে নিয়ে এখন এমন পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে যা ভবিষ্যতে বাণিজ্যিক জাহাজে করে পণ্য পরিবহনের চরিত্র বদলে দিতে পারে।
এ বছরের শেষ নাগাদ ইয়ারা বার্কল্যান্ডে মাত্র দুইজন ক্রু থাকবে। সবকিছু যদি পরিকল্পনামত এগোয় তাহলে দুই বছরের মধ্যে জাহাজটি চলবে কোনো ক্রু ছাড়াই। তখন জাহাজের ব্রিজটি, যেখান থেকে ক্রুরা জাহাজটি নিয়ন্ত্রণ করে এবং যেখানে তাদের থাকা খাওয়ার জায়গা ভেঙ্গে সরিয়ে ফেলা হবে।
কিন্তু ততদিন পর্যন্ত জাহাজের ক্যাপ্টেন সোয়েন ওডেগার্ড ৮০ মিটার লম্বা এই জাহাজের দায়িত্বে থাকবেন। তিনি বলেন, ‘আমরা জাহাজটি স্বচালিত করতে কাজ শুরু করেছি। মূল জাহাজে যেসব প্রযুক্তি ছিল তার সঙ্গে আমরা বাড়তি অনেক প্রযুক্তি জুড়ে দিচ্ছি।’
আশা করা হচ্ছে দুই বছরের মধ্যে ইয়ারা বার্কল্যান্ড নামে মাঝারি আকৃতির এই কন্টেইনারবাহী জাহাজটি চলবে সেন্সর, রেডার ও ক্যামেরার সাহায্যে। এগুলো থেকে পাওয়া ডেটা থেকে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) পানিতে চলার পথে নানা বাধাবিপত্তি শনাক্ত করবে এবং সে মতো তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেবে।
ক্যাপ্টেন বলেন, ‘জাহাজের দুই দিকে এবং সামনে ও পেছনে ক্যামেরা লাগানো। ফলে চারদিকে কী হচ্ছে তা জানা যাবে। সামনে কোনা বাধা দেখা দিলেই জাহাজটি সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে বিকল্প পথ নিতে হবে কিনা।’
কল্প সফল হলে ক্যাপ্টেন ওডেগার্ডের কাজ তখন জাহাজের বদলে হবে ডাঙ্গায়, প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষে। ঐ কক্ষ থেকে একসঙ্গে অনেকগুলো জাহাজের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। সেখানে বসেই প্রয়োজনে জাহাজের গতি ও পথ বদল করা সম্ভব হবে।
ইয়ারা বার্কল্যান্ড জাহাজের মালিক নরওয়ের সার উৎপাদন প্রতিষ্ঠান ইয়ারা। জাহাজটি প্রতিষ্ঠানের কারখানা থেকে ব্রেভিক বন্দরে সপ্তাহে দুইবার একশোর মতো সারভর্তি কন্টেইনার নিয়ে চলাচল করে। এ সময় সেটি ১৩ কিলোমিটার রুটের সমস্ত ডেটা বা তথ্য সংগ্রহ করে তা জমা করে রাখে।
জাহাজ কোম্পানি ও জাহাজ পরিবহণ সম্পর্কিত বিশেষজ্ঞদের যৌথ একটি সমিতির সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে কাজ করা সিনিকা হার্টোনেন বলেন, ‘যেসব জাহাজ অল্প দূরত্বের কোনো রুটে নিয়মিত চলাচল করে, সেগুলোকে চালক বিহীন করে ফেলা অপেক্ষাকৃত সহজ।
এই সমিতি স্বচালিত জাহাজ প্রবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করছে। এই প্রকল্পের জন্য প্রযুক্তি সরবরাহ করছে কোঞ্জবার্গ নামে একটি কোম্পানি। তারা অসলোর কাছে একটি ফিয়র্ডে চালকবিহীন বার্জ চালু করা নিয়ে কাজ করছে। এছাড়া, আলেসুন্ডে শহরের কাছে স্বচালিত ছোট আকৃতির কন্টেইনার জাহাজ চালুর প্রকল্পেও তারা প্রযুক্তি যোগাচ্ছে।
কোঞ্জবার্গ ম্যারিটাইমের নেক্সট জেনারেশন শিপিং বিভাগের পরিচালক অ্যান-ম্যাগরিট রিস্ত বলেন, ‘কতগুলো প্রযুক্তি বেশ কয়েক বছর ধরেই বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। আমরা সেগুলোকে সমন্বয় করে কাজে লাগাচ্ছি।’
তিনি জানান, বাণিজ্যিক জাহাজ খাতের পাশাপাশি ফিশিং, যাত্রী ফেরি ও সামরিক খাতও স্ব-চালিত নৌযানের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠছে। কোঞ্জবার্গ ইতোমধ্যেই ছোট আকৃতির স্বচালিত ডুবো যান (এইউভি) তৈরি করছে যেগুলো সাধারণত সাগরে জ্বালানি সন্ধানে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এছাড়া, সমুদ্র গবেষণা ও প্রতিরক্ষার কাজেও এসব ছোট আকৃতির স্বচালিত ডুবো-যান ব্যবহার করা হচ্ছে। সম্প্রতি এই কোম্পানি সাগরে মাছের ঝাঁকের অবস্থান শনাক্ত করার উপযোগী আট মিটার লম্বা একটি স্বচালিত নৌযান বিক্রি করেছে যেটিতে সোনার প্রযুক্তি, এআই, রেডার, ক্যামেরা ও জিপিএস প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে।
কোঞ্জবার্গের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট বিয়ন জালভিং বলেন, ‘এসব প্রযুক্তি ঠিকমত কাজ করছে কিনা তা এখনও মানুষই দেখছে যাতে প্রয়োজনে তারা হস্তক্ষেপ করতে পারে। কিন্তু জলযানটি একবারেই স্ব-চালিত।’
কোঞ্জবার্গ এখন বড় আকৃতির জলযানে একই প্রযুক্তির প্রয়োগ নিয়ে কাজ করছে। জালভিং বলেন, ‘প্রযুক্তি কোনো বাধা হবেনা। মূল যে বিষয়টি সামনে আসবে তা হলো সমুদ্র পরিবহণের নিরাপত্তা সম্পর্কিত যেসব বিধি-নিষেধ বর্তমানে রয়েছে তার সঙ্গে এই প্রযুক্তির সমন্বয়। তাছাড়া ব্যবসায়ীরা কতটা আগ্রহ দেখাবে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।’
অবশ্যই জাহাজে ক্রু না রাখতে পারলে যে পয়সা বাঁচবে তা জাহাজ ব্যবসায়ীদের উৎসাহী করতেই পারে। ডাঙ্গায় বসে কয়েকজনের একটি দল একসঙ্গে কয়েকটি জাহাজ পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে বলে জানান জালভিং। এছাড়া, জাহাজের বদলে ডাঙ্গায় বসে কাজ করা ক্রুদের জন্য অনেক নিরাপদও বটে।
শুধু কোঞ্জবার্গ নয়, অন্য আরও কিছু কোম্পানিও স্বচালিত জাহাজ চালু করা নিয়ে কাজ করছে। গত বছর জাপানে ২২২ মিটার লম্বা একটি গাড়িবাহী ফেরি মানুষ ছাড়াই চালানো হয়েছে। জাহাজ নির্মাতা মিৎসুবিসি ঐ ফেরিতে প্রযুক্তি সরবরাহ করেছে।
এছাড়া, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস থেকে একটি মালবাহী জাহাজ ২০ হাজার কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ কোরিয়ায় যাবার সময় অর্ধেক পথই স্ব-চালিত ছিল। ক্যাপ্টেন বা ক্রুরা সেসময় কিছুই করেনি। জাহাজটি নিজ থেকেই সবচেয়ে সহজ রুটটি বেছে নিয়েছে। ফলে, জাহাজে তেলের খরচ কম হয়েছে বলে জানিয়েছে এভিকাস যারা ঐ জাহাজটিতে প্রযুক্তি সরবরাহ করেছে।
ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ইস্টার্ন নরওয়ের অ্যাপ্লায়েড অটোনমির অধ্যাপক মারিয়াস তানাম বলেন, ‘স্ব-চালিত জাহাজ নিশ্চিত করতে পারলে অনেক কাজ এড়ানো যাবে যেগুলো বিপজ্জনক ও ক্লান্তিকর। ইয়ারা বার্কল্যান্ড প্রকল্প ও আসকো বার্জ প্রকল্প এই প্রযুক্তিকে ব্যবহারিক পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। এটি এখন আর গবেষণাগারে আটকে নেই।’
অধ্যাপক তানাম জানান, ক্যাপ্টেন চালিত একটি জাহাজের মতো না হলেও, স্ব-চালিত জাহাজের নিরাপত্তা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। তিনি স্বীকার করেন সেই নিরাপত্তা কখনই শুধু প্রযুক্তি দিয়ে শতভাগ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না এবং মানুষকেই জাহাজের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং প্রয়োজনে দূর থেকেই হস্তক্ষেপ করতে হবে।
তানাম বলেন, ‘যেহেতু এই প্রযুক্তি নতুন এবং এখনো বাস্তবে এর প্রয়োগ খুব বেশি হয়নি, ফলে অন্তর্বর্তীকালীন এই সময়ে জাহাজে ক্রু রাখতে হবে। তারপর আস্তে আস্তে আমরা স্বচালিত প্রযুক্তির ওপর ভরসা বাড়াতে পারি।’
তিনি জানান, স্ব-চালিত প্রযুক্তির ফলে জাহাজের নকশা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হতে পারে। জাহাজে ক্রু না থাকলে অতিরিক্ত মাল বহন করা যাবে, কারণ ক্রুদের থাকার কেবিন তৈরি করতে হবেনা, তাদের হাঁটা চলার জায়গা বা হিটিং এবং শীতাতপ ব্যবস্থাসহ অনেক কিছুরই প্রয়োজন হবেনা।
তবে অদূর ভবিষ্যতে বড় বড় মালবাহী জাহাজ মানুষ ছাড়াই মহাসাগর পাড়ি দিতে পারবে তা নিয়ে এখনো যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। প্রথমেই আইনি বিষয়গুলোর সুরাহা হতে হবে। জাহাজের জ্বালানি ব্যবস্থা এবং অন্য যন্ত্রপাতি এমন হতে হবে যাতে এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন কম হয় বলে জানান অধ্যাপক তানাম।
তবে অন্যতম বড় বাধা হচ্ছে সমুদ্রপথে পরিবহণের চলতি বিধিনিষেধ। বর্তমান যেসব আইনকানুন তা তৈরিই হয়েছিল এমন বিবেচনায় যে জাহাজের যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম মানুষই চালাবে বলে জানান সিনিকা হারটোনেন। তবে আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচল সংস্থা আইএমও আইনের নতুন একটি কাঠামো নিয়ে কাজ করছে।
নরওয়ের নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষ এবং রাজনীতিকদের কাছে বিষয়টি একবারেই নতুন বলে জানান ইয়ারা প্রকল্পের ম্যানেজার জন স্লেটেন। তাই তারা কিছুটা হলেও বিভ্রান্তিতে কারণ তাদের সিদ্ধান্তের প্রভাব পুরো বিশ্বের ওপরই পড়তে পারে।
তবে অধ্যাপক তানাম মনে করেন স্ব-চালিত কার বা ট্রাকের চেয়ে স্ব-চালিত জাহাজ নিয়ে অগ্রগতি হবে অপেক্ষাকৃত দ্রুত। কারণ, তার মতে, ব্যস্ত রাস্তায় দ্রুতগতির স্বচালিত গাড়ির চেয়ে সাগরে স্ব-চালিত জাহাজের নিরাপদ যাত্রা নিশ্চিত করা অপেক্ষাকৃত সহজ।