কোন অনুভূতির দেশ গড়বে আওয়ামী লীগ?

কোন অনুভূতির দেশ গড়বে আওয়ামী লীগ?

ব্লগ |

আমার জন্ম মুক্তিযুদ্ধের আগে৷ তাই বাংলাদেশে অনেক আওয়ামী লীগারকে বিএনপি বা জাতীয় পার্টির হতে দেখেছি৷ আবার বিএনপি, জাতীয় পার্টি, বামদল, এমনকি জামায়াত থেকেও কারো কারো রাতারাতি আওয়ামী লীগার হওয়ার কথা জেনেছি৷

এমন দলবদল অকারণে হয় না৷ শুধু আদর্শ যে কারণ নয়, তা কে না জানে৷ আদর্শিক কারণে তো ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পরই আওয়ামী লীগ নেতাদের একটা অংশ হত্যাকারী আর হত্যার নেপথ্যের কুশীলবদের সঙ্গে হাত মেলাতে পারে না৷ একদিন-দু’ দিনে তো নতুন আদর্শের উদয় হয় না৷

তারা নিশ্চয়ই প্রাণ-মান বাঁচাতে বা ক্ষমতার অংশ হতেই উদগ্রীব ছিলেন৷ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস বা আদর্শের জোর তাদের ছিল না৷ তাই আপোষ করেছেন৷ আপোষ যারা করেননি, তাদের মধ্যে চার নেতাকে জেলের ভেতরেই হত্যা করা হয়েছে৷ ওই চার নেতার চেয়ে ছোট নেতাদের অনেকেও আপোষ করেননি৷ তোফায়েল আহমেদসহ অনেকে তাই দীর্ঘদিন জেলে ছিলেন৷

তাই বলে কি ‘৭৫-এর ৪৪ বছর পরও ক্ষমতাসীনদের দমন-পীড়ন-নির্যাতন থেকে বাঁচতে আপোষ করতে হবে? না করলে কখনো ছাত্রলীগ, কখনো পুলিশ, কখনো মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ হামলা চালাবে?

এভাবে যদি ক্ষমতায় টিকে থাকা যেতো তাহলে তো পঁচাত্তরে লাশ আর রক্তের ওপর দিয়ে যারা ক্ষমতায় এসেছিল, তারা বা তাদের অনুসারীরাই এখনো গদিতে থাকতো, শেখ হাসিনা হয়ত আর দেশে ফিরতে না পেরে, আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় ফেরানো অসম্ভব মেনে হতাশায়, গ্লানিতে মুষড়ে পড়তেন৷

বাস্তবে তো তা হয়নি৷ বাস্তবে চাটুকার, ষড়যন্ত্রকারী মোশতাক ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, মোশতাকের পর সেনাছাউনি থেকে ক্ষমতায় আসা প্রথম শাসক জিয়াউর রহমানের শাসনামলও শেষ হয়েছে অগণতান্ত্রিক উপায়ে৷

বঙ্গবন্ধুর মতো জিয়াউর রহমানকেও হত্যা করেছে কতিপয় সেনা সদস্য৷

আশীষ চক্রবর্ত্তী, ডয়চে ভেলে

তারপরও ক্ষমতায় ছিল বিচারপতি সাত্তারের নেতৃত্বাধীন বিএনপি৷ পর্দার আড়ালে সব ‘ম্যানেজ’ করে সেই সরকারকে সরিয়ে তারপর এরশাদ শুরু করেছেন স্বৈরাচারী শাসন৷

মোশতাক আর জিয়াউর রহমানের মতো এরশাদেরও বন্ধুর অভাব হয়নি৷ এখনকার বিএনপি নেতা মওদুদ আহমেদ তখন ৭১-এ ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর পাশে থাকার স্মৃতি ডায়েরিতেই রেখে এরশাদের তথ্যমন্ত্রী, উপ-প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন; আওয়ামী লীগ নেতা, সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত এরশাদ সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হয়েছেন৷ আরো কে কে তখন স্বৈরাচারী এরশাদের ‘বন্ধু’ ছিলেন, তা অনেকেরই এখনো মনে আছে৷

মনে আছে, এক বামনেতা এরশাদের মন্ত্রী হয়ে বলেছিলেন, ‘‘ হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ বললে আমি রাজপথ ঝাড়ু দিতেও রাজি৷” এ নিয়ে সাপ্তাহিক যায় যায় দিন-এ প্রচ্ছদ প্রতিবেদন হয়েছিল৷ প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘‘আমি তব রাজপথের হবো ঝাড়ুদার৷” প্রতিবেদনটি পড়ে খুব হতাশ হয়ে, খুব বিস্ময় নিয়ে ভেবেছিলাম— আদর্শ ছুড়ে ফেলে বামনেতাও এভাবে স্বৈরাচারী শাসকের ‘ভৃত্য ঝাড়ুদার’ হতে পারে!

ক্ষমতালোভী মানুষ ডান হলে পারে, বাম হলেও পারে৷ বঙ্গবন্ধুর আমলে পেরেছে, মোশতাকের আমলে পেরেছে, জিয়াউর রহমানের আমলে পেরেছে, খালেদা জিয়ার আমলে পেরেছে, এখন শেখ হাসিনার আমলেও পারছে৷

দল বদল করা, বিপরীত আদর্শের ঝান্ডা হাতে নেয়া সবাই যে ক্ষমতালোভী তা আমি বলছি না৷ দু’-একজন আছেন, যারা লড়াইয়ের বড় প্ল্যাটফর্ম পেতে বা অন্য কোনো রাজনৈতিক কারণে বাম থেকে আওয়ামী লীগ বা বিএনপির নেতা হয়েছেন৷ তারা সংখ্যায় খুব কম বলে তাদের ধর্তব্যে রাখছি না৷

তবে এমন দু’-একজন বাকিরা সুখের পায়রা ছিল, বেঁচে থাকতেই এরশাদ তা বুঝেছেন৷ ক্ষমতায় থাকতে যাদের সঙ্গে নিয়ে তিনি আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সব বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের দমন করেছেন, ভোটের নামে প্রহসন করেছেন; ‘৯১, ‘৯৬, ২০০১, ২০০৭-এর নির্বাচন শেষে একজন-দু’জন করে যেতে যেতে এক সময় অনেক  সহযোদ্ধাই হয়ে গেছেন প্রতিপক্ষ৷

ক্ষমতাচ্যূত এরশাদ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দলটাকে ধরে রাখার জন্য লড়েছেন৷

দমন-পীড়ন এড়াতে, কিংবা ক্ষমতার ভাগ নিতে একসময় এরশাদের স্ত্রী-র রওশন এরশাদও আওয়ামী লীগের সঙ্গে ‘আঁতাত’ করেছেন বলে জনশ্রুতি আছে৷

নিকটাত্মীয়ের বিরোধীপক্ষে যোগ দেয়াও নতুন কিছু নয়৷ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর কয়েক বছরের মধ্যে তার ভায়রার ছেলে শেখ শহীদুল ইসলাম এরশাদের মন্ত্রী হয়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপির বিরুদ্ধে অনেক হুঙ্কার দিয়েছেন৷ এখন জাতীয় পার্টির দাপট নেই, শেখ শহীদুল ইসলামের সেই হুঙ্কারও নেই৷
বাংলাদেশে দমন-পীড়ন, ভোট কারচুপি, রাজনৈতিক হত্যা, গুম, দুর্নীতি সব আগেও হয়েছে৷ সময়ের ফেরে, ক্ষমতার হাত বদলে হয়ত কৌশলটা শুধু বদলেছে৷ অনেক ক্ষেত্রে মাত্রাও বেড়েছে৷

তাই বলে কি এসব চলতেই থাকবে?

ক্ষমতায় গেলে বেশির ভাগ শাসক বা শাসক দল তা-ই চায়৷ গণতান্ত্রিক দেশে চাইলেও তা পারা যায় না৷
আপাত গণতান্ত্রিক বা একেবারে অগণতান্ত্রিক দেশে দমন-পীড়ন, ভোট কারচুপি, হত্যা, গুম চালিয়ে একাধিক মেয়াদ ক্ষমতায় থাকা গেলেও একসময় পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে পড়ে এবং গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে পরিবর্তন আসে৷তবে বাংলাদেশ তো আফ্রিকার কোনো দেশ নয়, পৃথিবীও সেই যুগে পড়ে নেই যে তিন দশকেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা রবার্ট মুগাবে বা তার মতো অন্য কারো দৃষ্টান্ত অনুসরণ করলেই কয়েক মেয়াদ টিকে থাকা যাবে৷

অনুভূতির দাম না দিয়ে দেশ চালাবে আওয়ামী লীগ?

রাষ্ট্রের দমন কৌশল
জনতার মিছিলে পুলিশের গুলি

আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা সৈয়দ আশরাফ বলেছিলেন, ‘‘আওয়ামী লীগ শুধু একটি রাজনৈতিক দল নয়-এটি একটি অনুভূতি৷” খুব প্রশংসিত হয়েছিল তার এই বক্তব্য৷সৎ এবং দৃঢ়চেতা রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত সৈয়দ আশরাফের কথায় যুক্তিও ছিল৷ কিন্তু এখন একই কথা বলতে গেলে তার কণ্ঠের সেই জোর থাকতো কিনা সন্দেহ৷

বেশ কিছু সূচকে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক এগিয়েছে৷ বিরোধীরা আদর্শ সমাজব্যবস্থা কল্পনায় নিয়ে সব নাকচ করতে চাইলেও ভুলে গেলে চলবে না যে, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ধারার প্রশংসা করেছেন৷

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগই যে করছে, তা-ও এখন কেউ অস্বীকার করতে পারবে না৷

বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির আগাম অভিযোগ, চোখ রাঙানি সব উড়িয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার দেশের টাকায় পদ্মা সেতুর কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে- এটাও সত্য৷

আরো কিছু সাফল্য আছে বর্তমান সরকারের৷ কিন্তু পাশাপাশি দুর্নীতি, কারচুপির নির্বাচন, বিরোধীদের দমন-পীড়ন ইত্যাদিও আছে৷

আরো আছে ছাত্র লীগ, যুব লীগ, শাহজাহান খানদের বাড়াবাড়ি৷

ক্যাসিনোতে অভিযান চালিয়ে, কয়েকজনকে আটক করে যুবলীগের উৎপাত আপাতত নিয়ন্ত্রণ করলেও ছাত্রলীগ এখনো বেপরোয়া৷ অবশ্য সরকারের ভালো কাজগুলো অন্য কিছু লোকের কারণেও প্রায় গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে৷ এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত রাজাকারের তালিকা প্রকাশ৷ তড়িঘড়ি করে বড় কিছু করে দেখানোর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর আরো সুনজরে আসার চেষ্টা বা মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধার অনুভূতির ঘাটতির কারণে যে তালিকাটি প্রকাশ করা হয়েছিল, তাতে রাজাকারের চেয়ে মুক্তিযোদ্ধাই ছিল বেশি৷

জানতে ইচ্ছে করে, মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি মন্ত্রীদের অনুভূতি নিয়েই যদি প্রশ্ন থাকে, তাহলে আওয়ামী লীগ এমন মন্ত্রীদের নিয়ে দুর্নীতি, দমন-পীড়ন বন্ধ না করে কোন অনুভূতির দেশ গড়তে চায়?