কেবল মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানো কঠিন

আবু আহমেদ : বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনশীল মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক যুগের বেশি সময় পরে এ ধরনের মুদ্রানীতি গ্রহণ করেছে। এর আগে যেসব মুদ্রানীতি নেওয়া হয়েছিল, সেগুলো সংকুলানমুখী মুদ্রানীতি ছিল। প্রয়োজনের ভিত্তিতে এসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এসব পদক্ষেপের পেছনে উদ্দেশ্য ছিল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এগিয়ে নেওয়া। এবারের মুদ্রানীতির উদ্দেশ্য– মূল্যস্ফীতি কমানো। এর আগেও বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষণা দিয়েছিল। বর্তমানে তাদের অর্থনৈতিক নীতির মূল উদ্দেশ্য মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা। এবারে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে এ উদ্যোগ নিয়েছে। এবার নীতি সুদহার দশমিক ২৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৮ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এতে বাজারে সুদের হার বেড়ে যাবে।

বাস্তবে গত দেড় বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার বাড়াচ্ছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি সে তুলনায় কমছে না, বরং বেড়েই যাচ্ছে। সার্বিক পরিস্থিতিতে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি থামানো সম্ভব কি?

অর্থনৈতিক নীতিতে এ ধরনের সংকট রেখে মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন করলে দেশের অর্থনীতি বদলাবে না। অর্থনীতি স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে গেলে তখনই মুদ্রানীতি ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনীতি সার্বিক চিত্র থেকে বলা যায়, এখানে মুদ্রানীতি প্রয়োগ করে খুব লাভ হবে না। তাই পূর্ণ নিয়োজিত অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি রোধ করতে মুদ্রানীতি প্রভাব রাখতে পারে। বাংলাদেশের মতো দেশে মৌসুমভিত্তিক সরবরাহ পণ্য ও আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে মুদ্রানীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

এখানে আরেকটা কথা বলা ভালো, সেটা অবশ্য  মুদ্রনীতিতে এসেছে; এক্সচেঞ্জ রেট তথা মুদ্রাবিনিময় হার। গত এক বছরে বাংলাদেশি টাকা প্রায় ৩০ শতাংশ মূল্য হারিয়েছে। অনেক অর্থনীতিবিদ সেটা বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেছেন। বাংলাদেশ ডলারের বিপরীতে অনেক দিন ধরে ভাসমান মুদ্রাবিনিময় হার অনুসরণ করে আসছে। মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে, যেসব মুদ্রা ব্যবহার করে আমাদের দেনাপাওনা মেটানো হয়, সেগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে কতটা ওঠানামা করছে, তা দেখা হবে। অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রার সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন হার থাকবে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে হস্তক্ষেপ করতে পারবে।

এটা অবশ্য খারাপ না। আমরা এক সময় বলতাম, মুদ্রাবিনিময়ের ক্ষেত্রে যাতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা আর আমাদের মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা দেখা হয়। একে রিয়েল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট বলে। এটি বাংলাদেশ ব্যাংক সফলভাবে ডলার কিংবা ইউরো মুদ্রার বিপরীতে করে আসছিল। কেবল গত এক-দেড় বছর ধরে এটি সম্ভব হয়নি। হঠাৎ আমাদের অর্থ পাচার বেড়ে যাওয়া, অর্থনীতির ওপর মানুষের আস্থা কমে যাওয়া এবং ব্যাংক থেকে মানুষের আমানত তুলে নেওয়া তথা এমন অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হওয়ায় হঠাৎ টাকা অতি দ্রুত মূল্য হারাতে শুরু করে। এটি আর আগের মতো রাখা যায়নি। এমনকি প্রবাসী আয়ে প্রণোদনা দেওয়ার পরও রেমিট্যান্সের হার কমে যায়। এর কারণ হচ্ছে কালোবাজারে বিদেশি মুদ্রাগুলো চলে যাচ্ছিল।

বাজারের মূল্যের ওপর বিনিময় হার ঠিক করলে হয়তো এর ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে। তবে, সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ। কারণ যতদিন অর্থ পাচার বন্ধ না হবে বা যতদিন অর্থ পাচারের প্রবণতা কমে না আসবে ততদিন চোরাই বাজার বা ইনফর্মাল মার্কেটে ডলার বা ইউরোর চাহিদা বেশিই থাকবে।

আমার মনে হয়, বাংলাদেশ দুটি বিষয়কে মোকাবিলা করতে চেয়েছে। একটি হলো, মুদ্রার প্রসারণ ও সংকোচন কতটা হবে। ফলে কম অর্থ প্রবাহিত হবে। এর ফলে সুদের হার বাড়বে। যার কারণে বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধির হার কমতে পারে। এ বছর ৬ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার নেওয়া হয়েছে। সেটাই হওয়ার কথা। আর ৭ দশমিক ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে চলমান অর্থবছরে। এ দুটি লক্ষ্য ঠিক আছে, যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। তারপরও মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৫-এর মধ্যে রাখা দুরূহ হবে। কারণ এমনিতেই অর্থনৈতিক সংকট চলমান। এর মধ্যে যদি অব্যাহতভাবে রিজার্ভ কমতে থাকে এবং বাইরে থেকে কোনো সংকট এসে যায় তবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে। আর বাংলাদেশ যদি বৈদেশিক ঋণ না পায় বা বিদেশি বিনিয়োগ না বাড়ে তবে রিজার্ভ ধরে রাখা দুরূহ হবে। তখন বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ যেমন কঠিন হবে, তেমনি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণও। তার মানে, একটা সংকটের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সে জন্য মূল্যস্ফীতির বিষয়টি অবশ্যই দেখতে হবে।

সরকারি ব্যয়েরও একটা সংকোচনশীল নীতি নেওয়া উচিত। সরকারি ব্যয় খাত যদি বাড়তে থাকে, তাতেও মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি দেখা দেবে। বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলেও মূল্যস্ফীতি কমাতে পারবে না। সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত সরকারকে পরামর্শ দেওয়া যাতে তারা ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করে। দেশের অর্থনীতিকে সংকটমুক্ত রাখতে চাইলে সরকারকে ব্যয় সংকোচন নীতি অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় বাংলাদেশ ব্যাংকের এই উদ্যোগ স্রেফ আরেকটি ব্যর্থ নীতির নজির হয়ে থাকবে। (অনুলিখন)

অধ্যাপক আবু আহমেদ: অর্থনীতিবিদ