ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও সরকার পতনের পর মানুষের হাতে টাকা রাখার প্রবণতা বেড়েছিল। প্রচুর অর্থ চলে যায় ব্যাংকের বাইরে। এখন যেন আবার আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। অনেক ব্যাংকের ভল্টে টাকা রাখার জায়গা না থাকায় তা জমা হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১৮ দিনে শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিভিন্ন ব্যাংক নিট প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা জমা দিয়েছে। অবশ্য সব ব্যাংকের অবস্থা ভালো, তা নয়। টাকার অভাবে অনেক ব্যাংক চাহিদা মতো আমানত ফেরত দিতে পারছে না বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ‘নোটস ইন সার্কুলেশন’ বা প্রচলনে থাকা টাকার পরিমাণ কমে ৩ লাখ ১৪ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকায় নেমেছে। সরকার পতনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকার পরিমাণ বাড়তে বাড়তে গত ১৮ আগস্ট ৩ লাখ ২২ হাজার ২৭১ কোটি টাকায় উঠেছিল। এর মানে শেষ ১৮ দিনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ফিরেছে নিট ৭ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। এর আগে সরকার পতনের পরদিন গত ৬ আগস্ট কারেন্সি ইন সার্কুলেশন ছিল ৩ লাখ ১৫ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। সেখান থেকে ১২ দিনে বেড়েছিল ৬ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। এখন প্রতিদিন কমতে কমতে ৬ আগস্টের চেয়েও কমেছে।
জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, মানুষের আস্থা বাড়ার কারণে ব্যাংকে টাকা ফিরতে শুরু করেছে। এটি একটি ভালো লক্ষণ। আগামীতে এই আস্থা ধরে রাখতে হবে। তিনি বলেন, একটা সমস্যা হলো, কিছু ব্যাংকে আমানত সেভাবে বাড়ছে না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে আমানত বীমা তহবিল থেকে ১ লাখ টাকার পরিবর্তে ২ লাখ টাকা দেওয়ার কথা জানিয়েছে। গভর্নর জানিয়েছেন, এতে মোট আমানতকারীর প্রায় ৯৫ শতাংশ বীমার আওতায় এসেছে। কোনো ব্যাংক দেউলিয়া হবে না। এসব মানুষের আস্থা বাড়াতে সহায়তা করবে। সব ব্যাংকে আমানত বাড়বে বলে তিনি মনে করেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কয়েক বছর ধরেই ব্যাংক খাতের দুরবস্থার বিষয়টি আলোচনায় ছিল। বিভিন্নভাবে জোড়াতালি দিয়ে চলছিল ব্যাংক খাত। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে একের পর এক ব্যবস্থা নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরই মধ্যে ১০ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করা হয়েছে। বেনামি ঋণ চিহ্নিত করতে এসব ব্যাংক থেকে কে কত টাকা নিয়েছে, তা বের করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ঋণের বিপরীতে জামানত, সম্পদ বিক্রি করে আমানতকারীর অর্থ ফেরতের ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আর্থিক খাতের অনিয়ম তুলে ধরতে একটি শ্বেতপত্র প্রণয়নে কমিটি ও একাধিক টাস্কফোর্স গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগের কারণে ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরতে শুরু করতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে যে ১০ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে, এদের সবার অবস্থা খুব খারাপ তেমন নয়। এদের মধ্যে কারও কারও আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। আমানতকারীর চাহিদা মতো টাকা ফেরত দিতে না পারার তালিকায় রয়েছে– এত দিন এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, সোশ্যাল ইসলামী, ইউনিয়ন, গ্লোবাল ইসলামী ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। এস আলমের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়া ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ এরই মধ্যে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। খারাপ অবস্থা কাটাতে এক্সিম ব্যাংককে ১ হাজার কোটি টাকার বিশেষ ধার দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ছাড়া আইএফআইসি, ইউসিবি ও আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন হলেও এসব ব্যাংকের খুব নাজুক অবস্থার কথা শোনা যায়নি। অনেক আগ থেকে পদ্মা ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক নাজুক অবস্থায় রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিটি ব্যাংক শাখায় ভল্টের একটি নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারিত আছে। সীমার বেশি টাকা এলেই তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সোনালী ব্যাংকের চেস্ট শাখায় জমা করতে হয়। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হয়। এর পর ১৮ আগস্ট থেকে দৈনিক গড়ে ৫০০ কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে ফিরছে।
samakal