কৃতজ্ঞতা দেখাতে মোদিকে আমন্ত্রণ : আসিফ নজরুল
- নয়া দিগন্ত অনলাইন ০৭ মার্চ ২০২০
আসছে ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। দিবসটিকে ঘিরে সরকার ও আওয়ামীলীগ বছরব্যাপী কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। শুক্রবার জার্মানভিত্তিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলে’র সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর আয়োজন নিয়ে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল।
আয়োজনটি কীভাবে আরো সুন্দর করা যায়, তা নিয়ে পরামর্শও দিয়েছেন তিনি। ডয়চে ভেলেকে আসিফ নজরুল বলেণ, বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির সবার, বাংলাদেশের প্রতিটা মানুষের। আমাদের স্বাধীনতার পেছনে সবচেয়ে বড় আত্মত্যাগ বা সবচেয়ে বড় অবদান বঙ্গবন্ধুর। এটা একমাত্র চরম মিথ্যাবাদী বা চরম অজ্ঞ লোক ছাড়া সবাই স্বীকার করবে। কিন্তু সমস্যা হলো, আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুকে এমনভাবে ব্র্যান্ডিং করে, এমনভাবে ব্যবহার করে যে, মনে হয় বঙ্গবন্ধু তাদের সম্পত্তি।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আয়োজনে যাদের রাখা হয়েছে তারা নিম্ন শ্রেণির স্তাবক। তাদের অনেকে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানেই না। এমনকি আমার থেকেও অনেক কম জানে। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তারা কিছু পড়েছেন বা জানেন কিনা, সেটা নিয়েই আমার সন্দেহ আছে। আওয়ামী লীগ দলটাই এখন এমন হয়ে গেছে। বাংলাদেশের সব মানুষ বঙ্গবন্ধুকে সম্মান করেন। আমি নিজেও ওনাকে অত্যন্ত সম্মান করি। শুধু তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতে নয়, আমি বিশ্বাস করি তাঁর জন্ম না হলে হয়তো বাংলাদেশ হত না। আওয়ামী লীগকে ছাপিয়ে বঙ্গবন্ধু যে গণমানুষের নেতা সেটা বর্তমান ক্ষমতাসীন দল প্রতিষ্ঠা করতে চায় না বা পারে নাই।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর আয়োজন নিয়ে নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি হচ্ছে। এগুলো নিয়ে নানা মহলে অনেক সমালোচনাও হচ্ছে। এসব ত্রুটি আপনার চোখে কীভাবে ধরা পড়ছে এবং এসব ত্রুটি বাদ দিয়ে কীভাবে একটি সুন্দর আয়োজন করা যায়? ডয়চে ভেলে’র এমন প্রশ্নের জবাবে আফিস নজরুল বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলেছেন। যেটা আমার খুব ভালো লেগেছে। উনি বঙ্গবন্ধুর জন্য তোরণ, ব্যানার, ফেস্টুন বা ম্যুরাল, এগুলো না করে ওই টাকাটা গরিব মানুষের উপকারে ব্যয় করতে বলেছেন। এছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে মুজিববর্ষ উপলক্ষে বাংলাদেশে যারা অবসরভাতা পান তাদের জন্য ঘরে বসে টাকা পাওয়ার ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। সরকারের উচিত এই ধরনের কাজ করা। আমি জানি অবসরভাতা পেতে বাংলাদেশে কী দুর্ভোগ পোহাতে হয়। তারা যদি এখন বাসায় বসে পেনশন পান সেটা মুজিববর্ষের উপহার হবে। কেউ এর সমালোচনা করবে না। প্রত্যেকে এই ধরনের উদ্যোগের বাহবা দেবে। কেউ এর সমালোচনা করবে না।
তাহলে আওয়ামী লীগ তো ভালো ভালো কাজ করছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুসরণ করছে। এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণই করে না। বঙ্গবন্ধুর জীবনকে আমি দুইভাগে দেখি। একটা ১৯৪৮ থেকে ১৯৭২ সাল। এই পুরো সময়ে তিনি অসামান্য আত্মত্যাগ করেছেন। আর ৭২ থেকে ওনার নির্মম হত্যাকাণ্ডের আগ পর্যন্ত রাজনৈতিকভাবে তিনি কিছু ভুল করেছেন। আওয়ামী লীগ ওই ভুলগুলোকেই ধারণ করে। কিন্তু মহান নেতা হিসেবে মেহনতি মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধু যে আত্মত্যাগ করেছেন, আন্দোলন করে কারগারে গেছেন, সেই বঙ্গবন্ধুকে আওয়ামী লীগ ধারণ করে না। আওয়ামী লীগ এস. আলম গ্রুপের মতো বড় বড় গ্রুপের হাজার কোটি টাকার ঋণ মাফ করে দিতে পারে, কিন্তু কৃষকের সামান্য ঋণ মাফ করে না৷ কৃষকের ধানের ন্যায্য মূল্য দিতে পারে না৷ পাটকল শ্রমিকদের বেতন দিতে পারে না৷ এটা কি বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ?
পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর দীর্ঘ ২১ বছর বাংলাদেশে তাঁকে নিয়ে আলোচনা করা যেত না, বা বলা চলে আলোচনা নিষিদ্ধ ছিল। অতগুলো বছর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোনো কথা বলতে দেওয়া হয়নি বিধায় কি এখন সুযোগ পেয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করা হচ্ছে?
বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর চার-পাঁচ বছর ওনাকে নিয়ে কথা বলা যায় নাই। তারপর অবশ্যই বলা গেছে। এরশাদের আমল থেকে তো সব সময়ই বলা গেছে। হয়তো একটা বা দুইটা জেনারেশন বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানে নাই, তাতে কী হয়েছে? তাদের কী জানাবে? পোস্টারে লেখে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করি, কিন্তু ব্যাংক খেলাপি, ঋণ খেলাপি, দুর্নীতিবাজদের মাফ করে দেয়। কৃষক-শ্রমিকদের ন্যায্য পাওয়া দেয় না৷ আদর্শের কথা বলে রাতের বেলা ভোট দিয়ে দেয়, তারা কোন বঙ্গবন্ধুকে চেনাচ্ছে? তাদের তো পোস্টারে লিখে দেওয়া উচিত তারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে না৷ উঠতে বসতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা বলবে আর গুম, খুন, শেয়ার বাজার লুট করবে। এভাবে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুকে কোথায় নামিয়ে আনছে!
ডয়চে ভেলে’কে দেয়া আরেক প্রশ্নের জাবাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ শিক্ষক বলেন, আমরা সব সময় ভালো জিনিস দেখতে চাই। এই যে অবসরভাতা বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, এটা অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। আমি বার বার সেটা বলছি। সরকার যদি মুজিববর্ষ উপলক্ষে কৃষকদের মুক্তির জন্য শ্রমিকদের জন্য নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে এবং বলে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে, এটা আমাদের পক্ষ থেকে মুজিবর্ষের উপহার, তখন আমরা দারুণভাবে তার প্রশংসা করবো। আমি বার বার বলছি, ভালো কাজ করুন, যাকে আদর্শ মানেন, যাকে অনুসরণ করেন উনি কত বড় মানুষ ছিলেন সেটা বোঝাতে ভালো কাজ করুন৷
মুজিব শতবর্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আমন্ত্রণ জানানো নিয়ে নানা সমালোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে দিল্লিতে দাঙ্গার পর। এ ধরণের প্রশ্নের জবাতে আফিস নজরুল বলেন, আমি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতাটা বুঝতে পারছি। তাদের পক্ষে ভারতকে অস্বীকার করা কঠিন। কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রথম থেকেই বোঝা উচিত ছিল বঙ্গবন্ধু কোন মাপের নেতা, আর নরেন্দ্র মোদি কোন মাপের নেতা। বঙ্গবন্ধু কী রাজনীতি করতেন, আর মোদি কী রাজনীতি করছেন। তাদের শুরু থেকেই এই দূরদৃষ্টি থাকা উচিত ছিল। তাদের এটা আগেই বোঝা উচিত ছিল। তারা তো বহু আগে থেকেই জন্মশতবার্ষিকী নিয়ে আলোচনা করছেন। ভারত থেকে অবশ্যই কাউকে আমন্ত্রণ জানাতে হবে। তিনি হতে পারতেন মুক্তিযুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা কোনো ভারতীয় জেনারেল বা সামরিক কর্মকর্তা বা রাজনৈতিক নেতা। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তাঁকে সংযুক্ত করা যেত। এটা করেই মোদিকে বাদ দেওয়া যেত। মোদি তো একাত্তরে কিছুই ছিলেন না। আর আমি হলে বলতাম, নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীকে আনতে।
মোদিকে আনার ক্ষেত্রে সরকারের যুক্তি ভারত মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের পাশে ছিল। আরো অনেক বিষয়ে বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়েছে। সেই কৃতজ্ঞতা বা বন্ধুত্বের প্রকাশ থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানো। এখানে মোদি নয় বরং ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে তারা আমন্ত্রণ জানিয়েছেন ডয়চে ভেলে’র এ কথার জবাতে তিনি বলেন, এরকম হলে তারা ভারতের রাষ্ট্রপতিকে আনতে পারতেন। তিনি তো অত বিতর্কিত মানুষ নন। মোদী যে অত্যন্ত সাম্প্রদায়িক লোক, তা তো সবাই জানে; এটা নতুন নয়। ওই দূরদৃষ্টি দিয়ে ভাবলে ভারতের রাষ্ট্রপতিকে আনা যেত। তিনি দলিত শ্রেণি থেকে এসেছেন। তাহলেই আর এসব নিয়ে বিতর্ক হত না। আর রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রধান, পদমর্যাদায় তিনি মোদীর উপরে। আমার তো মনে হয় ক্ষমতায় থাকার জন্য আওয়ামী লীগের মোদিকে প্রয়োজন। সেই কৃতজ্ঞতা দেখাতে যেয়ে তারা মোদীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এভাবে তারা বঙ্গবন্ধুকে ছোট করেছে বলে আমি মনে করি। মোদিকে ইতিহাস কী হিসাবে মনে রাখবে? হিটলার, মুসোলিনি, গাদ্দাফি বা সাদ্দামের মতো পরিণতি হবে তাঁর। মোদি ইতিহাসের আস্তাকুঁড়েতে নিক্ষিপ্ত হবেন। ভারতের মানুষই তাকে ঘৃণা করবে।