নির্বাচনের পরও নিশ্চিত নয়, কারা হবে আগামী সংসদের প্রধান বিরোধী দল। বিএনপি বর্জন করায় আওয়ামী লীগের জয় ভোটের আগেই নিশ্চিত ছিল। প্রধান জিজ্ঞাসা ছিল বিরোধী দল কারা হতে যাচ্ছে। এমপির সংখ্যায় দুইবারের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিকে (জাপা) স্বতন্ত্ররা বিপুল সংখ্যায় ছাপিয়ে যাওয়ায় এ প্রশ্নের জবাব নির্বাচনের পরেও স্পষ্ট নয়।
বিরোধী দলের নেতা এবং উপনেতা (পারিতোষিক ও বিশেষাধিকার) আইন অনুযায়ী, ‘বিরোধী দলের নেতা অর্থ স্পিকারের বিবেচনামতে যে সংসদ-সদস্য সংসদে সরকারি দলের বিরোধিতাকারী সর্বোচ্চ সংখ্যক সদস্য লইয়া গঠিত ক্ষেত্রমত দল বা অধিসংঘের নেতা’।
সংসদের কার্যক্রম নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেছেন, সরকারি দলের বিরোধিতাকারী সর্বোচ্চ সংখ্যক সদস্যের দল বা অধিসংঘ কোনটি, তা স্পিকার নির্ধারণ করবেন।
নির্বাচনের আগে সরকারের সমালোচনায় মুখর ছিলেন জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের। তাঁকে বিরোধীদলীয় নেতা এবং সম্মানজনক সংখ্যক আসন নিয়ে ফের প্রধান বিরোধী দল বানানোর শর্ত পূরণের আশ্বাসে নির্বাচনে অংশ নেয় জাপা। একটি বন্ধুপ্রতিম দেশের এতে সংশ্লিষ্টতা ছিল। এ কারণে নির্বাচন থেকে ছিটকে পড়েন বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ।
স্বতন্ত্রদের চেয়ে অনেক কম আসন পাওয়ায় জাপা বিরোধী দল হতে পারবে কিনা, তা স্পষ্ট নয়।
সংসদে বিরোধী দল কে হবে– প্রশ্নে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘সংসদ নেতা অর্থাৎ যিনি নতুন প্রধানমন্ত্রী হবেন, তিনিই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।’
চলতি সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাপার ২৩ জন সরাসরি নির্বাচিত এমপি রয়েছেন। গত রোববারের ভোটে লাঙ্গল মাত্র ১১ আসনে জয়ী হয়েছে। ২৯৮ আসনের ফলাফল অনুযায়ী, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৬২ আসনে জয়ী হয়েছেন। একটি করে আসন পেয়েছে ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ এবং কল্যাণ পার্টি। বাকি ২২২ আসনে জয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগ। এবারই বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থী এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। আগের রেকর্ড ছিল ১৯৮৬ সালে ৩২ জন।
স্বতন্ত্র এমপিদের তুলনায় নগণ্য আসন পেলেও জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর দাবি, তারাই বসবেন বিরোধী দলে। তিনি সমকালকে বলেছেন, ‘সরকারি দলে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। বিরোধী দলে থাকব।’ মাত্র ১১ আসন নিয়ে প্রধান বিরোধী দল হওয়া সম্ভব কিনা– প্রশ্নে চুন্নু বলেছেন, ‘সংসদীয় দলের সভা ডেকে ঠিক করব, এ দাবি জানাব কিনা।’
জয় নিশ্চিতে আসন সমঝোতার সময় জাপা চেয়েছিল, তাদের ছেড়ে দেওয়া আসন থেকে শুধু নৌকা নয়, আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরও সরাতে হবে। বিএনপিবিহীন নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে আওয়ামী লীগ এতে রাজি হয়নি। তাই নির্বাচনের আগেই ধারণা করা হচ্ছিল, জাপা স্বতন্ত্রদের চেয়ে কম আসন পাবে। দলটির একজন নেতা সমকালকে বলেছেন, সুবিধা নিয়েও সরকারের সমালোচনা করা এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টির শিক্ষা ভোটের ফলাফলে পেয়েছে জাপা। জি এম কাদেরের ওপর আওয়ামী লীগ ক্ষুব্ধ, এতে মনে হচ্ছে আগামী সংসদে জাপাকে প্রধান বিরোধী দল বানানো হবে না।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে অভাবনীয় ফল করে বিএনপির চারগুণ আসন পেয়ে বিরোধী দল হয়েছিল জাপা। বিএনপিবিহীন দশম সংসদ নির্বাচনে ৩৪ আসন পেয়ে প্রথমবারের মতো প্রধান বিরোধী দল হয়েছিল। নবম সংসদ নির্বাচনে ৩০ আসন পেয়ে বিরোধী দলের আসনে বসে বিএনপি। অষ্টম সংসদের বিরোধী দল আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৬২ আসন। পঞ্চম সংসদে আওয়ামী লীগ এবং সপ্তম সংসদে বিএনপি ছিল বিরোধী দলে। মাত্র চার কার্যদিবস চলা ষষ্ঠ সংসদে বিরোধী দল ছিল না।
১৯৮৮ সালের চতুর্থ সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামীসহ সব প্রধান দল। ওই নির্বাচনে জাসদের (রব) নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত বিরোধী দল ১৯ আসন পেয়েছিল। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হন ২৫ আসনে। কিন্তু স্পিকার সম্মিলিত বিরোধী দলকে সরকারের বিরোধিতাকারী বৃহত্তম অধিসংঘের মর্যাদা দেন। জাসদ (সিরাজ), ফ্রিডম পার্টি এবং স্বতন্ত্র ৯ এমপি আ স ম আবদুর রবকে অধিসংঘের নেতা মেনে আবেদন করেন। আ স ম আবদুর রবকে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেন স্পিকার।
১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৯৩ আসনে জয়ী হয়। জাসদ ও জাতীয় লীগ ১টি করে আসন পায়। স্বতন্ত্র এমপিরা জয়ী হন ৫টি আসনে। স্পিকার এই ৭ এমপির জন্য সংসদে কক্ষ বরাদ্দ দিলেও তাদের সংসদীয় দল বা অধিসংঘের স্বীকৃতি দেননি। জাতীয় লীগের আতাউর রহমান খানকে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আবেদন জানান ৭ এমপি।
১৯৭৩ সালের ১২ এপ্রিল সংসদে বিতর্কে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘পাঁচ-সাতজন সদস্য নিয়ে গঠিত কোনো গ্রুপ নেতাকে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যায় না। ২৫ জনের কম সদস্য নিয়ে কোনো দল গঠিত হলে এবং ওই দলে কমপক্ষে ১০ জন সদস্য থাকলে, ওই দলকে সংসদীয় অধিসংঘ বা পার্লামেন্টরি গ্রুপ বলা যেতে পারে, কিন্তু সংসদীয় দল বলা যাবে না।’ তাই প্রথম সংসদে স্বীকৃত বিরোধী দল ছিল না।
এই বিতর্কই বিরোধী দল এবং বিরোধী দলের নেতা নির্বাচনের একমাত্র দিকনির্দেশনা। ২৫ জনের কম সদস্য থাকায় তাই আগামী সংসদে জাতীয় পার্টির সংসদীয় দল হিসেবে গণ্য হবার কথা নয়। সংসদীয় অধিসংঘ বলা হতে পারে।
দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী ১৬ স্বতন্ত্র এমপির ১০ জন পরবর্তী সময়ে বিএনপিতে যোগ দেন। তৃতীয় সংসদের ৩২ স্বতন্ত্র এমপির অধিকাংশ ক্ষমতাসীন জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম সংসদেও এ ধারা অব্যাহত ছিল। কিন্তু ২০০৮ সালে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের পর স্বতন্ত্র এমপিদের রাজনৈতিক দলের সংসদীয় দলে যোগ দেওয়ার নজির নেই।
নবম সংসদে নড়াইল-১ আসনের এমপি কবিরুল হক মুক্তি ও নোয়াখালী-৬ এর এমপি আনোয়ারুল আজিম পুরো মেয়াদে স্বতন্ত্র এমপি হিসেবে গণ্য হন। তাঁরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পদে থাকলেও দল দুটির সংসদীয় দলের অংশ ছিলেন না।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জয়ী ১৬ স্বতন্ত্র এমপি হাজী মোহম্মদ সেলিমের নেতৃত্বে অধিসংঘ গঠন করেছিলেন। তারা আওয়ামী লীগের পদে থাকলেও দলটির
সংসদীয় দলে যোগ দিতে পারেননি। পৃথক সংসদীয় গ্রুপ হিসেবে ভাগে তিনটি সংরক্ষিত মহিলা আসনও পান তারা। একাদশ সংসদেও ফরিদপুর-৪ আসনের এমপি মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন স্বতন্ত্র হিসেবেই গণ্য হয়েছেন। আওয়ামী লীগের পদে থাকলেও দলটির সংসদীয় দলের অংশ নন তিনি।
স্বতন্ত্র এমপিরা যে কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে পারবেন জানিয়ে অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেছেন, কিন্তু তারা সংসদীয় দলে যোগ দিতে পারবেন কিনা, এর ব্যাখ্যা প্রয়োজন। দশম সংসদের নজির অনুযায়ী স্বতন্ত্র এমপিরা চাইলে অধিসংঘ গঠন করতে পারবেন। স্পিকারের কাছে দাবি জানালে, তারা প্রধান বিরোধী দল হতে পারবেন। বিরোধী দলের নেতা, উপনেতা হতে পারবেন স্বতন্ত্র এমপিরা।
স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে বরিশাল-৪ আসনের নবনির্বাচিত এমপি পঙ্কজ নাথ সমকালকে বলেছেন, ‘এবারের স্বতন্ত্ররা ভিন্ন। আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছি, জয়ী হয়েছি। দল, সরকার ও সংসদ পরিচালনার প্রয়োজনে প্রধান শেখ হাসিনা যেখানে রাখবেন, সেখানেই থাকব। তিনি সরকারে রাখলে সরকারে থাকব। বিরোধী দলে বসতে বলতে, সেখানে বসব।’ বিরোধী দলে বসলে বিরোধীদলীয় নেতা কে হবেন– প্রশ্নে পঙ্কজ নাথ বলেছেন, ‘এ নিয়ে ভাবছি না। এমন প্রশ্ন এলে, প্রধানমন্ত্রী তা ঠিক করবেন।’
ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে নৌকার মনোনয়নবঞ্চিত নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে উৎসাহ দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। জাপাকে ছেড়ে দেওয়া ২৬ আসনের ১১টিতে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। ১৪ দলের শরিকদের ছেড়ে দেওয়া ৬টি আসনের ৪টিতে জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। ৪৭ আসনে আওয়ামী লীগকে হারিয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
সমকাল