কত রসাতলে যাবে বাংলাদেশ

মাহমুদুর রহমান

বাংলাদেশের সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্র সাম্প্রতিক দুটো খবর থেকে ধারনা করা যেতে পারে। প্রথমটি একজন কথিত ডাক্তারকে নিয়ে।

সিরাজগঞ্জে একজন ডাক্তার নামধারী শিক্ষক, যে ছাত্রজীবনে সরকারী দলের পান্ডা ছিল, লাইসেন্সবিহীন পিস্তল দিয়ে তারই এক ছাত্রকে দিনেদুপুরে, শ্রেণিকক্ষে অন্যান্য ছাত্রদের সামনে অনেকটা শখের বশে গুলি করেছে। উরুতে গুলি লাগাতে আহত ছাত্রটি প্রাণে বেঁচে গেছে। পিস্তলধারী শিক্ষক রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ছাত্রাবস্থায় ছাত্রলীগের সহ সভাপতি ছিল। আগ্নেয়াস্ত্রসহ নানান কিসিমের অস্ত্র রাখা তার নাকি বিশেষ হবি। দুটি পিস্তল, শ’খানেক গুলি এবং ছুরি, চাপাতিসহ সরকারী দলের পান্ডার অস্ত্রের কালেকশন দেখার মত। হাসিনার বাংলাদেশে ছাত্রলীগের পান্ডাদের কাছে বেআইনী অস্ত্র থাকবে, সেটা অবশ্য আমাদের কাছে প্রত্যাশিত। গুলিতে আহত ছাত্রের সহপাঠীদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে পুলিশ সেই পিস্তলধারী শিক্ষককে গ্রেফতারের পর এখন তাকে মানসিক রোগে আক্রান্ত বলা হচ্ছে। একজন মানসিক রোগাক্রান্ত কেমন করে ডাক্তার হলো এবং তার শিক্ষক হিসেবে চাকরিও মিলে গেল এসব প্রশ্ন, ন্যায়নীতি বিবর্জিত দেশে করে কোন লাভ নাই। দেশের সব মেডিকেল কলেজে এই কিসিমের শিক্ষক এবং তাদের তৈরী করা ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে চিকিৎসা নিতে হবে ভাবলেই তো হার্ট এটাক হওয়ার কথা। আসলে পুরো বাংলাদেশটাই পাগলা গারদে পরিণত হয়েছে।

দ্বিতীয় খবরটি বৃষ্টি খাতুন অথবা অভিশ্রুতি শাস্ত্রীকে নিয়ে। কুষ্টিয়ার নিম্নবিত্ত, মুসলমান পরিবারের এক তরুণী ঢাকার ইডেন কলেজে পড়তে এসে শুধু তার নাম বদলে বেশ ভারভারিক্কি হিন্দু নাম গ্রহণই করে নাই, সে নাকি ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে নিয়মিত পূজাঅর্চণাও শুরু করে দিয়েছিল। সম্প্রতি বেইলী রোডের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে খাতুন অথবা শাস্ত্রী নামের মেয়েটি নিহত হলে তার গোপন কাজকারবার জনগণের গোচরে এসেছে। মেয়েটি আবার এক অনলাইন মিডিয়ায় কাজ করতো। বাংলাদেশে মিডিয়ার বর্তমান হালচাল অভিশ্রুতি শাস্ত্রীকে দিয়েই বেশ বোঝা যাচ্ছে। কিছুদিন পরপর ইডেন কলেজের কেচ্ছাকাহিনীতেও জনগণ চমকে উঠছে।

যে কেউ মুসলমান ধর্ম ত্যাগ করে হিন্দু হয়ে যেতেই পারে। তাতে আমার আপনার কিছু যায়-আসে না। আমি তো বরং মনে করি, বাংলাদেশের সব কথিত মুসলমানদের হাসিনা-জাফর-আনিসুল-আরাফাত জাতীয় আরবী নামের ঢাল ব্যবহার করে সর্বক্ষণ ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানোর বদলে তাদের প্রকাশ্যে হিন্দু হয়ে যাওয়াটাই উত্তম। আসল হিন্দু এবং বৃষ্টি খাতুনের মত নব্য হিন্দুরা মিলে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগুরুতে পরিণত হলেও আমি অবাক হব না। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তেত্রিশ কোটি দেবতার সাথে শেখ মুজিবকেও ইশ্বরের অবতার জ্ঞানে পূজাঅর্চণা করা মানুষের সংখ্যা বাংলাদেশে নি:সন্দেহে কয়েক কোটি হবে। গত পনেরো বছরে শেখ মুজিবের মূর্তি দিয়ে সারা দেশ তো ছয়লাপ করে ফেলাই হয়েছে। এখন ওগুলোকে মন্দির ঘোষণা করলেই ষোল কলা পূর্ণ হয়। অনেক দিন ধরে ভারতের মিডিয়াতে নরেন্দ্র মোদিকে এ যুগের হিন্দু অবতার বলা হচ্ছে। ঢাকায় মোদি এবং মুজিবের মূর্তি পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে এক নতুন মন্দির নির্মিত হলে ভারতে শেখ হাসিনার আরো জয়জয়কার হয়ে যাবে। শেখ হাসিনা আমার প্রস্তাবটি বিবেচনা করতে পারেন।

প্রসঙ্গক্রমে সাবেক সচিব, সঙ্গীতশিল্পী ও বুদ্ধিজীবী জনাব আসাফদ্দৌলাহ’র এক পুরোনো টকশোর কথা মনে পড়লো। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের নামে বাংলাদেশে হিন্দু সংস্কৃতি লালনকারী মুসলমানদের পৌত্তলিকতাপ্রীতিতে ভীষণ রকম বিরক্ত হয়ে তিনি চ্যানেল আই এর “আজকের সংবাদপত্র” অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, “বাঙ্গালী মুসলমানের হিন্দুপ্রীতি দেখে আমার ইচ্ছা হয় বাসার এক অংশে সাইনবোর্ড লাগাতে যে ওখানে মুসলমানদের হিন্দু ধর্মে দীক্ষা দেওয়া হয়”। ঢাকায় এরকম হিন্দু বানানো একটা অফিস খোলা হলে হাসিনার জমানায় হিন্দু হওয়ার জন্য হয়ত লাইন পড়ে যেত। গত পনেরো বছর ধরে বাংলাদেশে সরকারী এবং বেসরকারী চাকরী ও ব্যবসায় হিন্দু ধর্মালম্বীদেরই তো একচেটিয়া আধিপত্য চলছে। দেশের মালিক তো এখন ওরাই। সেই বৃটিশ আমলের মত আজকের কথিত স্বাধীন বাংলাদেশে দাদাদের সামনে মুসলমানরা কড়জোরে দাঁড়িয়ে অনুকম্পা ভিক্ষা করে। শুনতে পাই দেশের পুলিশ থানাগুলোতে নাকি হিন্দু কনস্টেবলের মন জুগিয়ে মুসলমান ওসিকে চলতে হয়।

যাকগে, আমার খটকা অন্য যায়গায়। ইডেনের মেয়েটি নাকি সবাইকে বলতো যে, সে শুধু পারিবারিকভাবে হিন্দুই নয়, তার জন্মও নাকি ভারতের বেনারসে! তার নেয়া নতুন নামটিতেও অভিনবত্ব রয়েছে। বালাদেশের হিন্দুদের মধ্যে শাস্ত্রী পদবী তেমন একটা দেখা যায় না। ষাটের দশকে ভারতের এক প্রধানমন্ত্রীর পদবী শাস্ত্রী ছিল (লাল বাহাদুর শাস্ত্রী)। অভিশ্রুতি নিজেকে সেই শাস্ত্রীর পরিবারের কেউ দাবী করতো কিনা তা অবশ্য এখনও জানা যায় নাই। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পূজারীর বর্ণনা অনুযায়ী বৃষ্টি খাতুন হিন্দি ভাষাতেও কথা বলতো। অথচ মেয়েটির ঢাকায় কর্মরত, শ্রমজীবী পিতা, কুষ্টিয়ার গ্রামে থাকা মা ও বোন, এবং এলাকার প্রতিবেশিরা কথিত অভিশ্রুতিকে বৃষ্টি খাতুন বলেই শনাক্ত করছেন। এখন ডিএনএ টেস্ট করে তবেই সিদ্ধান্ত হবে যে পোড়া লাশ কবরে যাবে নাকি আরো একবার পোড়ানো হবে। শেষ পর্যন্ত অভিশ্রুতির জানাজার সিদ্ধান্ত হলে, যে মাওলানাকে নামাজ পড়ানোর দায়িত্ব দেয়া হবে তার বিড়ম্বনা বেশ বুঝতে পারছি।

বাংলাদেশের তরুণ সমাজে বৃষ্টি খাতুনদের সৃষ্টি একদিনে হয় নাই। শাহবাগ আন্দোলনের সময় মধ্যবিত্ত সমাজের তরুণতরুণীদের উন্মাদনা দেখে আমাদের বোঝা উচিৎ ছিল যে, নব্বই শতাংশ কথিত মুসলমানের দেশে হিন্দুকরণ প্রক্রিয়া অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আমার দেশ পত্রিকা সেই সময় দেশবাসীকে সচেতন করবার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল। তাতে পত্রিকা বন্ধ হওয়া এবং আমার জেলে যাওয়া ছাড়া তেমন কোন ফল মেলে নাই। এক দশকের ব্যবধানে আজ ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এতটাই বিস্তৃত হয়েছে যে, মুসলমান পরিবারের মেয়েরা ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে পূজাঅর্চণা করছে। শাহবাগে ইন্ধন দেয়া প্রথম আলো জাতীয় ইসলামবিদ্বেষী ও ভারতের দালাল মিডিয়ার বাংলাদেশকে হিন্দুকরণ প্রজেক্ট বেশ সফল হয়েছে বলে মানতেই হবে। ভারতে বসে বিজেপির মিডিয়া সেলের তসলিমা নাসরিন (জন্মসূত্রে মুসলমান এবং বাংলাদেশী) নিশ্চয়ই আনন্দে নাচছে। তসলিমার মত নারীবাদীদের আদর্শে অনুপ্রাণিত তরুনীর সংখ্যা এই দেশে উল্লেখযোগ্যই হবে।

আরো একটি রহস্যের কিনারা এখন পর্যন্ত হয় নাই। বৃষ্টি খাতুনের সঙ্গে বেইলী রোডের রেস্টুরেন্টে আর যারা দূর্ঘটনার দিনে খেতে গিয়েছিল তাদের পরিচয় কি? তারা কি জন্মসূত্রে হিন্দু, নাকি নব্য হিন্দু? একজন সম্ভবত: বৃষ্টি খাতুনের হিন্দু প্রেমিক ছিল। কিন্তু, বাকী দুই-তিনজনের পরিচয় কি? বছর খানেক আগে “খুফিয়া” নামে এক অতি নিম্ন মানের ভারতীয় সিনেমা দেখেছিলাম। সিনেমাটিতে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ ছিল এবং বাংলাদেশেরই এক অভিনেত্রী ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা “র”য়ের এদেশীয় এজেন্টের চরিত্রে অভিনয় করেছিল। সেই চরিত্রে দেখানো হয়েছিল যে, বাংলাদেশের এক মুসলমান সমকামি তরুণী ভারতীয় দূতাবাসে যায় এবং “র”য়ের স্টেশন চীফের সাথে দেখা করে স্বেচ্ছায় তাদের এজেন্ট হয়। “র”য়ের কাছ থেকে টাকা রোজগারের পাশাপাশি সিনেমার সেই তরুণীর বাংলাদেশের সব ইসলামপন্থীদের হত্যা করার মিশন ছিল। সিনেমাটি দেখে আমি বিষয়টি বাংলাদেশবিরোধী প্রপাগান্ডার অংশ হিসেবে ধরে নিয়েছিলাম। বৃষ্টি খাতুনের গল্প জানার পর মনে হচ্ছে ভারতীয় সিনেমার কাহিনীতে সত্যতা থাকতেও পারে। ভারতীয় গোয়েন্দারা বাংলাদেশের সকল সরকারী প্রতিষ্ঠান কব্জা করার পর এখন মফস্বলের পরিবারের ভিতরেও ঢুকে পড়েছে। বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা হয়ত সত্যিই সব স্বেচ্ছায় “র”য়ে নাম লেখাচ্ছে।

বৃষ্টি খাতুন আর রাজশাহীর খুনী ডাক্তার আমাদের সমাজের ভয়াবহ রোগের উপসর্গ মাত্র। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরেই ভারতের ইন্ধনে তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানে “বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ” নামক হিন্দুত্ববাদের যে বিষবৃক্ষ রোপণ করা হয়েছিল সেটি ফুলেফলে বিস্তৃত হয়ে কালক্রমে বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ও ঐতিহ্যকে কলুষিত করেছে। ভারতের প্রত্যক্ষ সহযোগীতায় বাংলাদেশের জন্ম হলে দেশে ইসলামের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার সমাজে গ্রহণযোগ্য হয়ে পড়তে থাকে। শাসনতান্ত্রিকভাবে বাংলাদেশ অবশ্যই কোন ইসলামী রাষ্ট্র নয়। কিন্তু দেশটি যে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ সেই সত্যটিও ১৯৭১ পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ এবং ভারতের অন্যান্য তথাকথিত “সেক্যুলার” সেবাদাসরা মুছে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। বিশেষ করে গত পনেরো বছরের ফ্যাসিস্ট শাসনকালে সরকারী ইন্ধনে প্রায় সকল মিডিয়া ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইসলাম ধর্ম বিদ্বেষকে উৎসাহিত করার ফলে সমাজজীবন থেকে ইসলামের সাথে সকল মূল্যবোধও অপসৃত হয়েছে। অন্যদিকে ভারতীয় সব চ্যানেলের বদৌলতে অপসংস্কৃতি অন্দরমহলে প্রবেশ করেছে। ভারতীয় সকল সিরিয়ালের পূজাঅর্চণার জাঁকজমক আমাদের তরুণ সমাজকে বিমোহিত করে ফেলেছে। বৃষ্টি খাতুন এবং ছাত্র গুলি করা ডাক্তার বাংলাদেশের সেই নষ্ট সমাজেরই প্রতিচ্ছবি।

একেশ্বরবাদী ইসলাম ধর্মে কোন কুসংস্কার এবং জাঁকজমকপূর্ণ আচারের জায়গা নাই। সকল ভেদাভেদ অতিক্রম করে আল্লাহ প্রদত্ত মানুষের অধিকার এবং সমাজে  সাম্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠাই এই ধর্মের মূল বৈশিষ্ট। দূর্ভাগ্যবশত: আমাদের আলেম ওলামারা সচরাচর তাদের বক্তব্যে ইসলামের মহান ও গভীর মর্মবাণী প্রচারের পরিবর্তে নানারকম সস্তা বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করেন। ফলে তরুন সমাজের সামনে হিন্দুত্ববাদের বিজাতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমরা মহত্তর কোন ইসলামী বয়ান তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছি। আমাদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে, তরুণরা পথভ্রষ্ট হওয়ার কারণেই ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের এ দেশীয় এজেন্টরা এত দীর্ঘ সময় ধরে এক দুর্নীতিপরায়ণ, ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম রাখতে সমর্থ হচ্ছে। বিশ্বাসের ও সাংস্কৃতিক লড়াই ব্যতিরেকে দিল্লির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক লড়াইয়ে জয়লাভ করা সম্ভব নয় বলেই আমি মনে করি।

সম্পাদক, আমার দেশ