৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে বহুল প্রতীক্ষিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার দেশটির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনবে—অনেকেই এমন প্রত্যাশাই করছেন। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে কি তেমনটা ঘটবে? পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদমাধ্যম ডন-এ প্রকাশিত একাধিক লেখায় এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও পাকিস্তানের এবারের নির্বাচনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) অনুসারী স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই সবচেয়ে বেশি আসন পেয়েছেন। আসনসংখ্যার দিক থেকে পাকিস্তান মুসলিম লিগ (পিএমএল-এন) ও পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। এই দল দুটি কোয়ালিশন বা জোট সরকার গঠনের ব্যাপারে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
‘রেসপেক্ট দ্য ম্যান্ডেট’ শিরোনামে ডন-এর সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ইমরান খানের অনুসারী প্রার্থীরা এককভাবে সবচেয়ে বেশি আসন জয়ী হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের বর্তমান বাস্তবতায় তাঁদের ক্ষমতার বাইরে থাকতে হবে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। তাই জনগণের ম্যান্ডেটের চেয়ে রাজনৈতিক কৌশলই হবে নতুন সরকার গঠনের ভিত্তি। এই কৌশল বাস্তবায়নের জন্য পাকিস্তানের রাজনীতিতে একসময়ের প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ (পিএমএল-এন) ও পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) এক কাতারে এসেছে। এ ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে, এমন কথাও আলোচনায় আছে। যেকোনোভাবে ইমরানকে ঠেকানোই এখন এদের সবার উদ্দেশ্য।
নির্বাচনের বেশ অনেক দিন আগে থেকেই ইমরান ও তাঁর দলকে বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়েছে। এর অংশ হিসেবে ইমরানকে কারাবন্দী করা হয়। তাঁর দলের প্রতীক কেড়ে নিয়ে দলীয়ভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধা দেওয়া হয়। আইন-আদালতের দোহাই দেওয়া হলেও এসব ঘটনার পেছনে ইমরানের সঙ্গে সেনাবাহিনীর বৈরিতা ছিল প্রধান কারণ। এরপরও ইমরান খানের অনুসারী প্রার্থীরা এ নির্বাচনে চমক দেখান। এটাকে অনেক বিশ্লেষক ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর সবচেয়ে বড় ‘আপসেট’ বলে বর্ণনা করেছেন। এই চমক আসলে কী বার্তা দেয়?
‘উইদার রিলিজিয়াস পার্টিজ?’ শিরোনামে ডন-এর এক লেখায় বলা হয়েছে, নির্বাচনের ফলাফল থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট, পাকিস্তানের জনগণ গণতন্ত্র চায়। একই সঙ্গে তারা রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে। তাই ইমরানের পক্ষে এই ভোটকে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও বলা যেতে পারে।
কিন্তু পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আরও একবার জনগণের মনের কথা বুঝতে অপারগতা প্রকাশ করেছে। এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে সেনাবাহিনী জনগণের দেওয়া বার্তা আমলেই নিতে চায় না। এর ফলে সেনাবাহিনীর সঙ্গে জনগণের দূরত্ব আরও বাড়বে।
দশকের পর দশক ধরে পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনী ভূমিকা রেখে চলছে। কখনো সরাসরি ক্ষমতা দখল করেছে, কখনো পছন্দমতো দল বা ব্যক্তিকে ক্ষমতায় বসিয়েছে আবার কখনো অপছন্দের দল বা ব্যক্তিকে ক্ষমতায় আসতে বাধা দিয়েছে। সেনাবাহিনী কেন এ রকমটা করতে পেরেছে?
বিশিষ্ট সমাজতাত্ত্বিক হামজা আলাভির মতে, পাকিস্তানের জন্মের সময় দেশটির একমাত্র সংগঠিত প্রতিষ্ঠান ছিল সেনাবাহিনী। এ কারণে পার্লামেন্ট, রাজনৈতিক দল, বিচার বিভাগসহ সব প্রতিষ্ঠানের ওপর এর প্রভাব ছিল এবং এখনো আছে। দেশটিতে কখনো এমন কোনো রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হয়নি, যাতে এই প্রভাব হ্রাস পায়। পরিহাসের ব্যাপার হলো, যে দুটি দল এখন ইমরানকে ঠেকাতে এখন সেনাবাহিনীর সমর্থন পাচ্ছে, তারাও একসময় সেনাবাহিনীর দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত ও নিগৃহীত হয়েছে। এমনকি এসব দলের কোনো কোনো নেতার হত্যাকাণ্ডের পেছনেও সেনাবাহিনীর হাত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এখন সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আছেন পাকিস্তান মুসলিম লিগের (পিএমএল-এন) নেতা নওয়াজ শরিফ ও তাঁর ভাই শাহবাজ শরিফ। মজার ব্যাপার হলো, এর আগেও নওয়াজ তিনবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু কোনোবারই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। তিনবারই ক্ষমতা থেকে তাঁর বিদায়ের জন্য প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষভাবে সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল। চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পেলে তিনি মেয়াদ পূর্ণ করতে পারবেন কি না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। কোয়ালিশন বা জোট সরকার গঠনের বিকল্প না থাকায় ভবিষ্যতে এই প্রশ্ন এবার আরও বড় হয়ে দেখা দেবে।
পাকিস্তানে নতুন সরকার গঠিত হলেই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে, অতি আশাবাদীরাও এমনটা দাবি করতে পারছেন না। কারণ, বেসামরিক শাসনামলেও পাকিস্তানে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে সেনাবাহিনী। এ রকম ‘দ্বৈত’ শাসনের কোনো দেশে আদৌ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকা সম্ভব কি না, সেই প্রশ্নটা সবার আগে বিবেচনায় নেওয়া দরকার।
‘স্পিল্ট ম্যান্ডেট স্পার্কস ইকোনমিক স্ট্যাবিলিটি কনসার্ন’ শিরোনামে ডন-এর এক কলামে বলা হয়েছে, কোয়ালিশন বা জোট সরকারের পক্ষে পাকিস্তানে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের সম্ভাবনা নিয়েও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ছয় মাসের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করেছে, পরবর্তী সরকার তা বজায় রাখতে পারবে কি না, তা নিয়ে দেশটির নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সংশয় রয়েছে। জোট সরকারের ‘বিভক্ত সমর্থন’ আগামী কয়েক মাসের মধ্যে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে, এমন আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ভোটে জয় পেলে প্রতি মাসে ৩০০ ইউনিট পর্যন্ত বিনা মূল্যে বিদ্যুৎ দেওয়া হবে—এ রকম একটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)। পাকিস্তান মুসলিম লিগের (পিএমএল-এন) পক্ষ থেকেও প্রায় একই রকম অর্থাৎ ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিনা মূল্যে বিদ্যুৎ এবং ২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত দাম কমানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। ইমরান খানের অনুসারী স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও বিভিন্ন উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রতিশ্রুতি দেন।নির্বাচনের সময় রাজনৈতিকভাবে জনপ্রিয় এই ধরনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করা বাস্তবিকভাবে প্রায় অসম্ভব। এখন প্রশ্ন হলো, এই দলগুলো অর্থনৈতিকভাবে কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত নেবে কি না।
অর্থনৈতিক নীতি ও সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে স্পেশাল ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলিটেশন কাউন্সিল (এসআইএফসি) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রতিটি প্রাদেশিক সরকারের প্রধান এবং সেনাপ্রধান এই কাউন্সিলের সদস্য। তাই শুধু পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ অর্থমন্ত্রী নয়, গুরুত্বপূর্ণ যেকোনো অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে এই কাউন্সিল সদস্যরাও প্রভাব বিস্তার করবেন।
ভোটের আগে জনগণকে দেওয়া বিভিন্ন দল ও প্রার্থীর প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্য কিছু মিল থাকলেও অর্থনৈতিক নীতিগুলোর ক্ষেত্রে এ দলগুলোর বড় ধরনের মতপার্থক্য রয়েছে। এ রকম অবস্থায় বিভিন্ন দল ও রাজনৈতিক এলিটদের স্বার্থ উপেক্ষা করা কি সম্ভব হবে? দৃশ্যমান ও অদৃশ্য নানা চাপ মোকাবিলা করে নতুন সরকারের পক্ষে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখা সত্যিই একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ।
‘পোস্ট-ইলেকশন চ্যালেঞ্জ’ নামে ডন–এর এক লেখায় বলা হয়েছে, নতুন সরকার গঠনের পরও পাকিস্তানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসার ক্ষেত্রে অনেকগুলো বড় বাধা থাকবে। দেশটির ক্ষমতাবান বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে বিরোধের মীমাংসা হয়নি। এর চেয়ে বড় কথা, নির্বাচন হয়ে গেলেও দেশের একটি বড় অংশের মানুষের মধ্যে হতাশা ও অসন্তোষ রয়েছে। এর ফলে শিগগিরই পাকিস্তান নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর হবে না।
prothom alo