একীভূতকরণের আলোচনায় আরও এক ডজন ব্যাংক

একীভূতকরণের আলোচনায় আরও এক ডজন ব্যাংক

বেসরকারি খাতের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল পদ্মা ব্যাংকের একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত প্রকাশ্যে এসেছে অতি সম্প্রতি। তবে আরও কয়েকটি দুর্বল ব্যাংক অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণের আলোচনায় রয়েছে। সব মিলিয়ে পদ্মাসহ ডজনখানেক ব্যাংক একীভূত হতে পারে। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের সাতটি, সরকারি তিনটি এবং বিদেশি মালিকানার একটি ব্যাংকের নাম শোনা গেছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকের সংখ্যা ৫০টির মধ্যে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে ব্যাংক রয়েছে ৬১টি। সব আমানতকারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এ পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত সূত্র জানায়, সম্প্রতি আর্থিক খাতের নীতিনির্ধারকদের এক বৈঠকে ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে আলোচনা হয়। কোন ব্যাংক কার সঙ্গে একীভূত করা যায়, তা নিয়ে সেখানে অনানুষ্ঠানিক কথাবার্তার একটি খবরের পর আলোচনা ব্যাপক মাত্রা পেয়েছে।

এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে ব্যাংকগুলোকে একীভূত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কেউ একীভূত না হলে আগামী মার্চ থেকে বাধ্যতামূলকভাবে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংককে মিলিয়ে দেওয়া হবে।

তবে যেসব দুর্বল ব্যাংকের নাম শোনা যাচ্ছে; আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সেগুলোর আর্থিক অবস্থার উন্নতি সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা। এ রকম বাস্তবতায় ভালো কয়েকটি ব্যাংক তুলনামূলক দুর্বল কোন ব্যাংক নিলে নিজের জন্য ভালো হবে, তা নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এ প্রসঙ্গে সমকালকে বলেন, দেশের অর্থনীতির আকারের তুলনায় ব্যাংকের সংখ্যা বেশি। কয়েকটি ব্যাংকের আর চলার মতো অবস্থাই নেই। এসব ব্যাংক একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। এটা করা হলে ব্যাংকে আমানত রেখে ফেরত না পাওয়ার অনিশ্চয়তা কেটে যাবে। প্রতিটি ব্যাংকের মধ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠার তাগিদ তৈরি হবে। তবে শুধু একীভূতকরণের মাধ্যমে দায়িত্ব শেষ করলে চলবে না। যার সঙ্গে একীভূত হচ্ছে, সেই ব্যাংক যেন খারাপ না হয়, সে বিষয়ে জোর তদারকি করতে হবে।
তিনি বলেন, যে ব্যাংককে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা হচ্ছে, তাদের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় দেখতে হবে। আমানতের সুরক্ষা নিশ্চিত করা; কর্মকর্তা-কর্মচারী যেন ছাঁটাই না হয় এবং যাদের জন্য ব্যাংকটি খারাপ হলো, তারা যেন আর কোনো ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে না পারেন। একই সঙ্গে এসব ব্যাংকের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

জানা গেছে, প্রাতিষ্ঠানিকসহ সব আমানতকারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যাংক একীভূতকরণের মাধ্যমে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংকের দায় ও সম্পদ মিলিয়ে দেওয়া হবে। তবে খারাপ ব্যাংক একীভূতকরণের ফলে ভালো ব্যাংক যেন চাপে না পড়ে, সেজন্য একই সঙ্গে বিভিন্ন নীতি সহায়তা দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ক্ষেত্রে খারাপ ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতির ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নগদ জমা সংরক্ষণ (সিআরআর) এবং বিধিবদ্ধ তারল্য সংরক্ষণে (এসএলআর) ছাড় দেওয়া হবে। আবার খেলাপি ঋণের বিপরীতে সাধারণভাবে যে হারে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণ করতে হয়, এ ক্ষেত্রে রাখতে হবে কম। এ ছাড়া ভালো ব্যাংকে এসেই সব গ্রাহকের যেন আমানত ফেরত নেওয়ার চাপ তৈরি না হয়, সেজন্যও একটি ব্যবস্থা রাখা হবে।

আলোচনায় যেসব ব্যাংক
একীভূতকরণের আলোচনায় থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে দুর্বল অবস্থার সরকারি মালিকানার বেসিক, বিডিবিএল ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে অন্য রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণের আলোচনা রয়েছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ২০৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এর প্রভিশন ঘাটতি ৫ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। মূলধন ঘাটতি ৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও শিল্প ঋণ সংস্থা একীভূত করে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক-বিডিবিএল গঠন করা হয়েছিল। তবে ব্যাংকটির আর্থিক সূচকের উন্নতি হয়নি। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এর মোট ঋণের ৯৮২ কোটি টাকা বা ৪২ দশমিক ৪৬ শতাংশ খেলাপি। এ ঋণের বিপরীতে কোনো আয় না পেলেও পুরো আমানতের বিপরীতে সুদ গুনতে হয়। এ কারণে ব্যাংকটি বছরের পর বছর নিট লোকসানে চলছে। বেসিক এবং বিডিবিএলকে রাষ্ট্রীয় মালিকানার সোনালী ও অগ্রণীর সঙ্গে একীভূত করার আলোচনা রয়েছে।

অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুরশেদুল কবীর সমকালকে বলেন, বিভিন্ন রকম আলোচনার কথা শুনলেও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রস্তাব সম্পর্কে তাঁর জানা নেই। ব্যাংক খাতে একীভূতকরণের উদ্যোগ ইতিবাচক বলে তিনি মনে করেন।

একীভূতকরণের আলোচনায় থাকা সরকারি রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ১ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা বা ২১ দশমিক ৩৭ শতাংশ ঋণখেলাপি। ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি ২ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। এটিকে একই রকম খারাপ অবস্থায় থাকা বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার আলোচনা রয়েছে।
বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে পদ্মার পাশাপাশি ন্যাশনাল, এবি, ইউনিয়ন, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স, আইসিবি ইসলামিক এবং বিদেশি ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের নাম একীভূতকরণের আলোচনা রয়েছে।

দেশের প্রথম প্রজন্মের ন্যাশনাল ও এবি ব্যাংক অন্য দুটি ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা হবে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এবি ব্যাংকের ৫ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা বা ১৬ দশমিক ৭২ শতাংশ ঋণখেলাপি। আর ন্যাশনাল ব্যাংকের ১২ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা বা ২৮ দশমিক ৯২ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। যদিও ব্যাংক দুটি একীভূতকরণের ব্যাপারে কিছু জানে না বলে সমকালকে জানিয়েছে।
ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তৌহিদুল আলম খান সমকালকে বলেন, তাদের পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। এখন সবাই মিলে ব্যাংকটিকে কীভাবে ভালো অবস্থানে নেওয়া যায়, সে চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, বিভিন্ন পর্যায় থেকে একীভূতকরণের বিভিন্ন কথা শোনা গেলেও আনুষ্ঠানিক কিছু শোনেননি। এবি ব্যাংকের তারিক আফজাল বলেন, এ বিষয়ে তাঁর কোনো ধারণা নেই।

বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক একটি শরিয়াহ ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে পারে– এমন আলোচনা রয়েছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির ২ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে খেলাপি হয়েছে ৫১ দশমিক ৬৫ শতাংশ। আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭৯০ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে খেলাপি ৬৮৭ কোটি টাকা বা প্রায় ৮৭ শতাংশ। আর মূলধন ঘাটতি রয়েছে ১ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা। মূলত প্রতিবছর আদায় করা ঋণে পরিচালন ব্যয় মেটানোর কারণে মোট ঋণের চেয়ে মূলধন ঘাটতি বেশি। বিদেশি ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের ১ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি ১ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা বা ৯৮ দশমিক ২২ শতাংশ। মূলত ব্যবস্থাপনায় অনিয়মের কারণে ব্যাংকটির এ অবস্থা হয়েছে। কয়েক বছর আগে বিদেশি মালিকপক্ষ বড় অঙ্কের মূলধন জোগান দেয়। এর পরও গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি ছিল ৪৪ কোটি টাকা।

কেন একীভূতকরণের উদ্যোগ
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, কয়েকটি দুর্বল ব্যাংকের কারণে সামগ্রিক খাতের সূচকের খারাপ অবস্থা তৈরি হয়েছে। ব্যাংক খাতের উচ্চ খেলাপি ঋণ, মূলধন ঘাটতি, ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, তারল্য সংকট– এসব সূচকে খারাপ অবস্থার পেছনে কয়েকটি ব্যাংকের নাম আসছে ঘুরেফিরে। বড় সব জাল-জালিয়াতিও ঘটেছে এসব ব্যাংকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা উপায়ে চেষ্টা করেও এসব ব্যাংকের প্রতি আস্থা ফেরাতে পারছে না। উচ্চ সুদে আমানত নিয়ে দৈনন্দিন খরচ মেটাতে গিয়ে এসব ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই। ব্যাংকগুলোর উদ্যোক্তারা নতুন করে আর মূলধন জোগান দিচ্ছেন না। তাই আমানতের একটি অংশ আর ফেরত দেওয়া যাচ্ছে না। ফলে আমানত ভেঙে চলছে খারাপ অবস্থার ব্যাংকগুলো। এতে আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ, মূলধন ঘাটতিসহ বিভিন্ন ছাড় দিলেও বছরের পর বছর কোনো উন্নতি হচ্ছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, বিদেশে এলাকা বা পণ্যভেদে ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে বাংলাদেশে সব ব্যাংক সব এলাকায় একই ধরনের পণ্য ও সেবা নিয়ে কাজ করছে। কোনো ধরনের উদ্ভাবন ছাড়াই এভাবে কাজ করে একই গ্রাহকের পেছনে একাধিক ব্যাংক দৌড়াচ্ছে। আবার বড় আমানতের জন্য একই প্রতিষ্ঠানের পেছনে সবাই ছুটছে। এতে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সুদ কিংবা অনেক ক্ষেত্রে অনৈতিক লেনদেন হচ্ছে, যা সুশৃঙ্খল আর্থিক ব্যবস্থার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। এসব বিবেচনায় নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যাংকের সংখ্যা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ব্যাংক এশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরফান আলী সমকালকে বলেন, একীভূতকরণ বা অধিগ্রহণ সারাবিশ্বের একটি সাধারণ অনুশীলন। তবে শুধু দুটি ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন এক করে দিলেই হবে না। একীভূতকরণের আগে আমানত সুরক্ষার পাশাপাশি কয়েকটি বিষয় খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। প্রথমত, একীভূতকরণের ফলে ভালো ব্যাংকটির মূলধন পর্যাপ্ততায় যেন ঘাটতি না হয়। এ ছাড়া ব্যাংকটির তারল্য কী অবস্থায় আছে, তা দেখতে হবে। তিনি বলেন, দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারের অংশ এমনিতেই বিলীন হয়ে গেছে। তবে আমানত ফেরতের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। না হলে আমানত ফেরতের ক্ষেত্রে কোনো শর্ত দিলে তা ভালো হবে না।

কর্মকর্তা-কমচারীদের কী হবে
ব্যাংক একীভূতকরণে বেশ কিছু শর্ত থাকবে। এর মধ্যে আমানতকারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং আগামী তিন বছরের মধ্যে কাউকে চাকরি থেকে অপসারণ বা পদত্যাগে বাধ্য না করা। যদিও একীভূতকরণের আলোচনায় থাকা ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক রয়েছে। সরকারি ব্যাংকের চেয়ে বেসরকারি ব্যাংকের কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক বেশি।

জানা গেছে, ব্যাংক একীভূতকরণের আগে বিস্তারিত অডিট করাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ নিয়ে খারাপ অবস্থায় থাকা ব্যাংকের পরিচালক বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কেউ কেউ আতঙ্কে আছেন। বিশেষ করে যারা বিভিন্ন দুর্নীতি-অনিয়মে জড়িয়েছেন, তাদের ভেতরের খবর বেরিয়ে গেলে শাস্তির মুখে পড়তে হতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও জানিয়েছে, যাদের কারণে ব্যাংক দুর্বল হয়েছে, তারা আগামী পাঁচ বছর অন্য কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে পারবেন না। এ ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।

samakal