ইরানে আমেরিকার হামলা পাল্টা আঘাত ইসরাইলে

logo

নয়া দিগন্ত ডেস্ক
মুদ্রিত সংস্করণ
ইরানের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ইসরাইলের একটি ভবন
ইরানের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ইসরাইলের একটি ভবন |সংগৃহীত

– যুক্তরাষ্ট্রের হামলা কূটনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতা, বলল ইরান

– ফোরদো ধ্বংসের দাবি ট্রাম্পের গুরুতর ক্ষয়ক্ষতি অস্বীকার ইরানের

– ইসরাইলজুড়ে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত বন্ধ বেন-গুরিয়ন বিমানবন্দর, সব ফ্লাইট স্থগিত

– সংবিধানের চরম লঙ্ঘন : সিনেটর স্যান্ডার্স

– হামলার তীব্র নিন্দা চীনের আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন মন্তব্য রাশিয়ার

– অনেক দেশই ইরানকে পরমাণু অস্ত্র দিতে চায় : মেদভেদেভ

যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় ‘অত্যন্ত সফল হামলা’ চালিয়েছে বলে জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর জবাবে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি অভিযোগ করে বলেছেন, তার দেশের বিরুদ্ধে ইসরাইলের বিমান অভিযানে যোগ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কূটনীতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।

গত শনিবার নিজের ট্রুথ সোশ্যাাল পোস্টে ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেন যে, ফোরদো, নাতানজ এবং ইস্পাহানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলা ‘অত্যন্ত সফল’ ছিল এবং যেকোনো পাল্টা প্রতিশোধের বিরুদ্ধে সতর্ক করে তিনি বলেন, ‘মনে রাখবেন, এখনো অনেক লক্ষ্যবস্তু বাকি আছে।’ আলজাজিরা, বিবিসি ও রয়টার্স।

অন্য দিকে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারে বলেছিলেন যে তিনি মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জড়ানো বন্ধ করবেন। কিন্তু কূটনীতিতে আমাদের আস্থাকে কাজে লাগিয়ে তিনি শুধু ইরানকেই নয়, নিজের ভোটারদেরও প্রতারিত করেছেন। তিনি একজন অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীর এজেন্ডা মেনে নিয়েছেন, যিনি ইসরাইলি রাষ্ট্রের লক্ষ্য এগিয়ে নিতে আমেরিকান নাগরিকদের জীবন ও সম্পদ নিংড়ে নিতে অভ্যস্ত।’ তিনি আরো বলেন, এই হামলা আন্তর্জাতিক আইন, জাতিসঙ্ঘ সনদ এবং পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির গুরুতর লঙ্ঘন। সেই সাথে তিনি সতর্ক করে বলেন, এই হামলার ‘চিরস্থায়ী পরিণতি’ ভোগ করতে হবে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প জানান, ফোরদোতে ছয়টি ‘বানকার-বাস্টার’ বোমা ফেলা হয়েছে এবং অন্য স্থাপনায় ৩০টি টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে।

একজন মার্কিন কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, হামলায় বি-২ বোমারু বিমান ব্যবহৃত হয়েছে। এসব বিমানে বড় ধ্বংসক্ষম বোমা বহনের ক্ষমতা রয়েছে, যা মাটির নিচে থাকা ফোরদোর মতো ঘাঁটি ধ্বংসে কার্যকর।

তবে ইরানের তাসনিম বার্তা সংস্থা জানিয়েছে, দেশটির একজন কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন, ‘শত্রুর বিমান হামলায়’ ফোরদোর আংশিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অন্য দিকে পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ইরান ইসরাইলের অন্তত ১০টি এলাকায় দফায় দফায় ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। ইসরাইলি গণমাধ্যমগুলোর খবর অনুযায়ী, সর্বশেষ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় প্রাথমিকভাবে আনুমানিক ৩০টি রকেট ছোড়া হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সর্বশেষ এ হামলায় ইসরাইলে কমপক্ষে ৮৬ জন আহত হয়েছে এবং তাদের চিকিৎসা চলছে বলে জানিয়েছে ইসরাইল।

ফোরদোতে ‘গুরুতর ক্ষয়ক্ষতি হয়নি’ : ইরানের কোম এলাকার এমপি মানান রাইসি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ফোরদোর ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক কেন্দ্রে যে হামলা চালিয়েছে, তা কেবল উপরিভাগের ক্ষতি করেছে, গভীরে পৌঁছাতে পারেনি। রাইসিকে উদ্ধৃত করে বার্তা সংস্থা তাসনিম লিখেছে, “মিথ্যাবাদী মার্কিন প্রেসিডেন্টের দাবির বিপরীতে আমি সঠিক তথ্য দিচ্ছি।

ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনা গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। বেশির ভাগ ক্ষতি হয়েছে কেবল উপরের দিকে, যা মেরামত করা সম্ভব।” তিনি বলেন, মার্কিন হামলার পর তেজস্ক্রিয় বিকিরণের কোনো প্রমাণ পারমাণবিক কেন্দ্রের আশপাশে মেলেনি।

তেজস্ক্রিয় দূষণ ঘটেনি : মার্কিন হামলার পর ইরানের ফোরদো, ইস্পাহান ও নাতাঞ্জ পারমাণবিক স্থাপনার আশপাশে বিকিরণ পর্যবেক্ষণ ও মাঠ পর্যায়ের জরিপে কোনো তেজস্ক্রিয় দূষণ বা বাসিন্দাদের জন্য ঝুঁকির প্রমাণ মেলেনি বলে জানিয়েছে দেশটির পারমাণবিক শক্তি সংস্থা, খবর আলজাজিরার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে সংস্থাটি বলেছে, “ফোরদো, নাতাঞ্জ ও ইস্পাহানে অবৈধ মার্কিন হামলার পর মাঠ পর্যায়ের জরিপ ও বিকিরণ পর্যবেক্ষণ উপাত্তে কোনো ধরনের দূষণের রেকর্ড পাওয়া যায়নি।”

“এসব স্থাপনার আশপাশের বাসিন্দাদের জন্য কোনো বিপদের আশঙ্কা নেই। পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে।” সৌদি আরবের পারমাণবিক ও বিকিরণ নিয়ন্ত্রক কমিশনও বলেছে, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে মার্কিন হামলার পর প্রতিবেশী উপসাগরীয় দেশগুলোতে কোনো তেজস্ক্রিয়া শনাক্ত হয়নি।

সংবিধানের চরম লঙ্ঘন : বার্নি স্যান্ডার্স

ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার ঘটনাকে সংবিধানের চরম লঙ্ঘন বলেছেন মার্কিন সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স। তিনি বলেন, ‘আমি একমত। আমি আপনাদের একটা কথা বলতে চাই, এই মাত্র যে খবরটা শুনলাম, যেটা আপনারাও শুনলেন, সেটা শুধু উদ্বেগজনকই নয়; বরং চরমভাবে সংবিধানবিরোধী।’ স্যান্ডার্স আরো বলেন, ‘আপনারা সবাই জানেন, এ দেশকে যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা কেবল মার্কিন কংগ্রেসের আছে, প্রেসিডেন্টের সেই অধিকার নেই।’

ইসরাইলের ১০ এলাকায় আঘাত : ইরানের প্রধান তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন বাহিনী বড় ধরনের হামলা চালানোর পর ইসরাইলে প্রায় ৩০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে ইরান। ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রগুলো তেল আবিব, হাইফাসহ ইসরাইলের অন্তত ১০টি এলাকায় আঘাত হেনেছে আর এতে ৮৬ জন আহত হয়েছেন। ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, গতকাল সকালে ইসরাইলের মধ্যাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চল লক্ষ্য করে ইরান থেকে ছোড়া প্রায় ২০টি ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করেছে তারা।

ইসরাইলি গণমাধ্যম জেরুসালেম পোস্ট জানিয়েছে, এ সময় ইসরাইলজুড়ে ভারী বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। দেশটির জরুরি পরিষেবা মেগান ডেভিড আদম (এমডিএ) জানিয়েছে, ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে এমন অন্তত ১০টি এলাকার দিকে যাচ্ছে তাদের টিমগুলো। হামলার এসব ঘটনায় ৮৬ জন আহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে একজন ইসরাইলের মধ্যদক্ষিণাঞ্চলীয় শফেলা এলাকায় আহত হয়েছেন।

বন্দরনগরী হাইফাসহ ইসরাইলের উত্তরাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে বলে প্রাথমিক প্রতিবেদনগুলোতে জানিয়েছে ইসরাইলি গণমাধ্যম। এসব ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে বহু ভবন ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাইফায় ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানার আগে সেখানে কোনো সতর্কতামূলক সাইরেন বাজেনি বলে টাইমস অব ইসরাইল জানিয়েছে।

আইডিএফ জানিয়েছে, প্রাথমিক সাইরেন বাজার পর মধ্যাঞ্চলে হামলা হয়, এরপর উত্তরাঞ্চলের দিকে আরেক পশলা ক্ষেপণাস্ত্র উড়ে যাওয়ার সময় সেখানকার এলাকাগুলোতে সাইরেন বেজে ওঠে। ইসরাইলের দমকল বাহিনী জানিয়েছে, উপকূলীয় এলাকা, মধ্যাঞ্চল ও তেল আবিব মেট্রোপলিটন এলাকাগুলো থেকে ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানার খবর এসেছে। এসব এলাকার ভবন ও গাড়িগুলোতে ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি আঘাত হেনেছে আর তাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দমকল বাহিনীর টিমগুলো ঘটনাস্থলে গিয়ে কাজ শুরু করেছে।

ইসরাইলের মধ্যাঞ্চলের এক ঘটনাস্থল থেকে এমডিএর জরুরি চিকিৎসা কর্মী মোতি নিশান বলেছেন, “এটি একটি বড় ধ্বংসের দৃশ্য। বেশ কয়েকটি দোতলা আবাসিক ভবন ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আর কিছু ধসে পড়েছে। আমরা ঘটনাস্থলে এসেই দমকল বাহিনী ও হোম ফ্রন্ট কমান্ডের সদস্যদের সাথে মিলে তাৎক্ষণিভাবে তল্লাশি ও উদ্ধার অভিযান শুরু করেছি।”

বুশেহর ও ইয়াজদ প্রদেশে বিস্ফোরণ : ইরানের মধ্যাঞ্চলে ইয়াজদ প্রদেশে বিস্ফোরণের আওয়াজ শোনা গেছে। দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় বুশেহর প্রদেশেও বিকট বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া গেছে। ইরানের স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে আলজাজিরা জানায়, ইয়াজদ প্রদেশে বিস্ফোরণ ঘটেছে। সেখানে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় করা হয়েছে। এ ছাড়া দেশটির বুশেহর প্রদেশে ‘জোরালো বিস্ফোরণের’ শব্দ শোনা গেছে বলে পৃথকভাবে জানানো হয়েছে।

রাশিয়া যাচ্ছেন আরাকচি : ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি জানিয়েছেন, তিনি রাশিয়া যাচ্ছেন। মস্কোয় আজ সোমবার তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সাথে বৈঠক করবেন। সেখানে ‘গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা’ হবে। আলজাজিরার খবরে বলা হয়, তুরস্কের ইস্তাম্বুলে এক সংবাদ সম্মেলনে আরাকচি বলেন, ‘রাশিয়া ইরানের বন্ধু। আমরা একটা কৌশলগত অংশীদারত্ব উপভোগ করছি। সব সময় আমরা পরস্পরের সাথে পরামর্শ করি এবং সমন্বয় করি।’

তিনি বলেন, ‘আমি আগামীকাল রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের সাথে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করব এবং আমাদের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।’ রাশিয়া ও ইরান গত জানুয়ারিতে একটি ‘বিস্তৃত অংশীদারত্ব চুক্তি’ স্বাক্ষর করে, যা তাদের ঘনিষ্ঠ কৌশলগত মৈত্রীকে আরো মজবুত করে। তবে এই চুক্তিতে কেউ হামলার শিকার হলে পারস্পরিক সামরিক প্রতিরক্ষার কোনো বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি।

ইরানে হামলার ‘তীব্র নিন্দা’ চীনের : ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার ‘তীব্র নিন্দা’ জানিয়েছে চীন। পাশাপাশি সঙ্ঘাতের সব পক্ষকে, বিশেষ করে ইসরাইলকে দ্রুত যুদ্ধবিরতিতে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে বেইজিং। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গতকাল রোববার এক বিবৃতিতে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা আরো বাড়াচ্ছে।

আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন : রাশিয়া

ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলাকে ‘আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন’ বলে মন্তব্য করেছে রাশিয়া। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রোববার এক বিবৃতিতে এ মন্তব্য করেছে । বিবৃতিতে বলা হয়, ‘একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা হামলা চালানোর এই দায়িত্বজ্ঞানহীন সিদ্ধান্ত। যে যুক্তিই দেয়া হোক না কেন, আন্তর্জাতিক আইন, জাতিসঙ্ঘ সনদ এবং জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবগুলোর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এই হামলা।’ বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ‘আমরা আগ্রাসন বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছি। চলমান পরিস্থিতিকে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পথে ফিরিয়ে নেয়ার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতে প্রচেষ্টা বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছি।’

আলোচনা নস্যাৎ করেছে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল : ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি গতকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি বিবৃতি দিয়েছেন। তাতে তিনি ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর তার দেশকে আলোচনায় ‘ফিরতে’ ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের আহ্বানের জবাব দিয়েছেন।

আব্বাস আরাকচি লিখেছেন, ‘গত সপ্তাহে, আমরা যখন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক আলোচনা এগিয়ে নিচ্ছিলাম, তখন ইসরাইল তা ভেস্তে দেয়ার পথ বেছে নেয়। এরপর এ সপ্তাহে এসে, আমরা ইইউর (ইউরোপীয় ইউনিয়ন) সাথে বসেছিলাম। তখন যুক্তরাষ্ট্র সেই কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ভেস্তে দেয়ার পথ বেছে নেয়।’

ওই পোস্টে আরাকচি আরো লেখেন, কাজেই আপনি কী উপসংহার টানবেন? ব্রিটেন এবং ইইউর উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধির কাছে, ইরানকে আলোচনার টেবিলে ‘ফিরে আসতে হবে’ বলা হচ্ছে; কিন্তু ইরান কিভাবে এমন কিছুতে ফিরে যেতে পারে, যা কখনো ছেড়ে আসেনি, কিংবা ভেস্তে দেয়নি?’

আইএইএ-এর তদন্ত চায় ইরান : পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার ঘটনায় আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থাকে (আইএইএ) তদন্ত করতে বলেছে ইরান। দেশটির এসএনএন নিউজ নেটওয়ার্কের বরাতে এ খবর জানিয়েছে আলজাজিরা। এসএনএন নিউজ নেটওয়ার্ক জানিয়েছে, আইএইএর প্রধান রাফায়েল গ্রোসিকে চিঠি লিখেছেন ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির প্রধান মোহাম্মদ এসলামি। চিঠিতে তিনি শনিবার রাতে মার্কিন হামলার তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।

মোহাম্মদ এসলামি মার্কিন পদক্ষেপের নিন্দা জানাতে এবং কার্যকর ব্যবস্থা নিতে আইএইএর প্রধানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। সেই সাথে তিনি রাফায়েল গ্রোসির ‘নিষ্ক্রিয়তা এবং দুষ্কর্মে সহায়তার’ জন্য সমালোচনা করেন। বলেন, ইরানের পক্ষ থেকে ‘যথাযথ আইনি ব্যবস্থা’ নেয়া হবে। এর আগে রাফায়েল গ্রোসি গতকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেয়া এক পোস্টে জানান, ইরানের জরুরি পরিস্থিতি বিবেচনায় আজ সোমবার আইএইএ-এর বোর্ড অব গভর্নররা জরুরি বৈঠকে বসবেন।

বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরে হামলা : ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন জানিয়েছে, রোববার ইসরাইলের বেশ কয়েকটি স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে। এর মধ্যে ইসরাইলের বেন গুরিয়ন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও রয়েছে। বিবিসির খবর অনুসারে, এ ছাড়া অন্যান্য লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে রয়েছে সাহায্যকারী ঘাঁটি, কমান্ড ও কন্ট্রোল সেন্টার এবং একটি জৈব গবেষণা কেন্দ্র। ইরানের অভিজাত সামরিক বাহিনী ইসলামিক বিপ্লবী গার্ড কোরের (আইআরজিসি) বরাতে দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশন জানায়, দীর্ঘপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে এসব হামলা চালানো হয়েছে।

হামলার জেরে ইসরাইলের গুরুত্বপূর্ণ বিমানবন্দর বেন-গুরিয়ন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পাশাপাশি ইসরাইলের সবচেয়ে বড় তিনটি বিমানসংস্থা : এল আল, ইসরাইল এয়ারলাইনস, আরকিয়া ও ইসরায়ার ঘোষণা করেছে যে, তারা দেশের ভেতরে ফেরত আসার ফ্লাইটগুলো আপাতত স্থগিত করছে এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এ স্থগিতাদেশ বহাল থাকবে। এল আল জানিয়েছে, তারা ২৭ জুন পর্যন্ত পূর্বনির্ধারিত সব ফ্লাইট বাতিলের সিদ্ধান্তও বাড়িয়েছে।

জঙ্গিবিমান, লঞ্চার ও ইস্পাহান বিমানবন্দরে হামলা : পশ্চিম ইরানে সম্প্রতি চালানো হামলার বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেছে ইসরাইলের সামরিক বাহিনী। তারা জানিয়েছে, হামলায় খুজেস্তান প্রদেশের দেজফুল বিমানবন্দরে দু’টি ইরানি এফ-ফাইভ জঙ্গিবিমান নিশানা করে তা ধ্বংস করেছে। গতকাল সকালের হামলায় ইরানের আটটি ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণস্থল ধ্বংস করা হয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি লঞ্চার ‘ইসরাইলের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার জন্য প্রস্তুত’ ছিল বলে ইসরাইলের ভাষ্য।

এর আগে রাতে ২০টি ইসরাইলি জঙ্গিবিমান ইরানের কেন্দ্রস্থলের বহু স্থাপনায় আক্রমণ চালায়। এসব লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে ছিল- অস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্র, অস্ত্রের গুদাম এবং ইস্পাহান বিমানবন্দর।

হরমুজ প্রণালী বন্ধের হুঁশিয়ারি : ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির প্রভাবশালী একজন উপদেষ্টা মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ও হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এ প্রণালী বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেল পরিবহনের প্রধান রুটগুলোর একটি। সিএনএনের খবর অনুসারে, ইরানের কায়হান পত্রিকার প্রধান সম্পাদক হোসেইন শরিয়তমাদারি সতর্ক করে বলেছেন, ‘ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর, এখন আমাদের পালা।’

হোসেইন শরিয়তমাদারি ইরানের রক্ষণশীল কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিত। অতীতে তিনি নিজেকে আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির প্রতিনিধি বলে দাবি করেছেন। সামাজিকমাধ্যম টেলিগ্রামে কায়হানের এক বার্তায় শরিয়তমাদারিকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ‘কোনো সংশয় বা বিলম্ব না করে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আমরা অবশ্যই বাহরাইনে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবহরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাব এবং একযোগে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানি ও ফ্রান্সের জাহাজ চলাচলের জন্য হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয়া হবে।’

নেতানিয়াহুর ‘অভিনন্দন’, ট্রাম্পের ‘ধন্যবাদ’ : ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক ভিডিও বার্তায় ইরানে হামলার সিদ্ধান্তের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়েছেন তিনি বলেছেন, “অভিনন্দন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায়সঙ্গত ও অসাধারণ শক্তি দিয়ে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকে নিশানা করার যে সাহসী সিদ্ধান্ত আপনি নিয়েছেন, তা ইতিহাস বদলে দেবে।”

নেতানিয়াহু বলেন, “অপারেশন রাইজিং লায়নে ইসরাইল সত্যিই অসাধারণ কিছু করেছে। কিন্তু আজ রাতে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র যা করেছে, তা অতুলনীয়। এমন কিছু করেছে, যা পৃথিবীর আর কোনো দেশ করতে পারত না। ইতিহাসে লেখা থাকবে, বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক শাসনব্যবস্থাকে সবচেয়ে বিপজ্জনক অস্ত্র থেকে বঞ্চিত করতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।”

ইরানকে পরমাণু অস্ত্র দিতে প্রস্তুত বিভিন্ন দেশ : মেদভেদেভ

ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলার পর কয়েকটি দেশ তেহরানকে সরাসরি পরমাণু অস্ত্র সরবরাহে প্রস্তুত রয়েছে বলে দাবি করেছেন রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং নিরাপত্তা কাউন্সিলের উপপ্রধান দিমিত্রি মেদভেদেভ। রোববার এক্সে (সাবেক টুইটার) দেয়া পোস্টে তিনি এ মন্তব্য করেন।

মেদভেদেভ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ইসফাহান, নাটানজ ও ফোরদোতে যেসব স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে, তাতে যে লক্ষ্য অর্জনের কথা ট্রাম্প বলেছিলেন, বাস্তবে হয়েছে তার ঠিক উল্টো। এসব হামলার ফলে পারমাণবিক পদার্থ সমৃদ্ধকরণ এবং এখন বলা যেতেই পারে, ইরানের পরমাণু অস্ত্র উৎপাদনের পথ আরো সুগম হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, বেশ কয়েকটি দেশ এখন ইরানকে সরাসরি তাদের নিজস্ব পরমাণু ওয়ারহেড সরবরাহ করতে প্রস্তুত রয়েছে।মেদভেদেভ দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর ইরানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব আরো শক্তিশালী হয়েছে। যারা আগে সরকারের প্রতি নিরপেক্ষ বা বিরূপ মনোভাব পোষণ করত, তারাও এখন দেশের আধ্যাত্মিক নেতৃত্বের চার পাশে ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here