রাষ্ট্রীয় একটা অপরাধ, যেটা হলো নির্যাতন, সেটার ব্যাপারে কোনরকম পদক্ষেপ নিতে আমরা দেখিনি- তাসনিম খলিল 


তাসনিম খলিল, সুইডিশ-বাংলাদেশি সাংবাদিক; এডিটর-ইন-চিফ, নেত্র নিউজ
তাসনিম খলিল, সুইডিশ-বাংলাদেশি সাংবাদিক; এডিটর-ইন-চিফ, নেত্র নিউজ

বুধবার নেত্র নিউজের এডিটর-ইন-চিফ ভয়েস অফ আমেরিকাকে আরও বলেন, “আমরা আসলে আশা করছিলাম, যেটা বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমাদের কাছে দাবী করেছিল, এবং সবসময় তারা এমন দাবী করে থাকেন যে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো তারা তদন্ত করেন। কিন্তু, এক্ষেত্রে আমরা যেটা দেখলাম, সেটা হচ্ছে যে, নাফিস মোঃ আলমকে নির্যাতন করা হয়েছে যে জায়গায়, সেই জায়গার বিষয়ে, অথবা তাকে নির্যাতনকারী হিসেবে যার প্রতি অভিযোগ আনা হয়েছে, সেই মিলিটারি অফিসারের ব্যাপারে, কোনো ধরনের তদন্ত, কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে, নাফিস মো: আলমকে পুরনো কিছু মামলার সূত্রে আটক করা হয়, এবং এরপরে নতুন একটা মামলা প্রায় তড়িঘড়ি করে…আগে তার মামলায় কোন ওয়ারেন্ট সম্ভবত ছিল না, এখানে একটা কনফিউশন আছে…তাকে ওই মামলায় আটক করে, কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। তো এটা আসলে আমি বলব যে, এখানে আমরা দুই ধরনের অপরাধের কথা বলছি। একটা হল যে, নাফিস মো: আলমের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আছে যে তিনি, তার বয়স যদিও তেইশ, বলা হচ্ছে যে, তিনি বিশাল অপরাধী, তিনি মদ বিক্রি করতেন, এই ধরনের কিছু অভিযোগ তার বিরুদ্ধে আছে, যেটা আমাদের স্টোরিতেও আমরা উল্লেখ করেছি। অপর দিকে, রাষ্ট্রীয় একটা অপরাধ, যেটা হল নির্যাতন, সেটার ব্যাপারে আমরা কোন ধরণের পদক্ষেপ নিতে দেখিনি।”

বাংলাদেশ পুলিশ রবিবার, ২৩ বছর বয়সী নাফিস মোঃ আলমকে গ্রেফতার করে। টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক প্রামাণ্যচিত্রে আলম অভিযোগ করেছিলেন যে, অবৈধভাবে মাদকদ্রব্য রাখার দায়ে র‍্যাব তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে তার উপর অত্যাচার চালায়। ঐ তথ্যচিত্র যৌথভাবে প্রযোজনা করেছে জার্মানভিত্তিক ডয়চে ভেলে ও সুইডেনভিত্তিক নেত্র নিউজ।

এই তথ্যচিত্রে নাফিস আলমের বক্তব্য সম্পর্কে তাসনিম খলিল বলেন, “নাফিস মো: আলম ডয়চে ভেলের সাথে নেত্র নিউজের যৌথ ইনভেস্টিগেশনে একজন টর্চার সারভাইবার হিসেবে কথা বলেছেন, এবং বাংলাদেশের অত্যন্ত কুখ্যাত একটা টর্চার চেম্বার, যেটার কথা আগেও বিভিন্ন জায়গায় এসেছে, র‌্যাব-১ হেডকোয়ার্টারে তাকে কিভাবে টর্চার করা হয়েছিল, তার বীভৎস বর্ণনা…এর অনেক কিছুই আমরা আসলে প্রকাশও করতে পারিনি, এত বীভৎস, সেটার একটা বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, এবং তাকে নির্যাতনকারী হিসেবে একজন মিলিটারি অফিসারকেও শনাক্ত করতে তিনি আমাদেরকে সাহায্য করেছেন।… আমরা আসলে আশা করব, যে বাংলাদেশ সরকার যেটা তারা নাগরিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে আসলে কী ধরণের পদক্ষেপ নেন, এটা এই কেইসটা মনিটর করার মাধ্যমে আমরা অচিরেই বুঝতে পারবো।”

নাফিস মোঃ আলমের গ্রেফতার ও তথ্যচিত্র

আলমের গ্রেফতারের সঙ্গে তথ্যচিত্রের কোনও সম্পর্ক নেই বলে জানিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশ। তারা বলছে, ২০২১ সালের এক পর্ণচিত্র সংক্রান্ত মামলায় যুক্ত থাকার অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পাশাপাশি তারা এমনও বলেছে যে, প্রয়োজনীয় নথিপত্র ছাড়াই মাদকদ্রব্য মজুত রেখে তিনি আইন ভঙ্গ করেছেন।

পুলিশের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ”রবিবার আমরা যখন তাকে গ্রেফতার করি, তখন আমরা দেখতে পাই, নিজের বাড়িতে তিনি অবৈধভাবে মাদকদ্রব্য মজুত করে রেখেছেন এবং আমরা তার বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা দায়ের করতে যাচ্ছি।”

অবৈধভাবে মাদক রাখার দায়ে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার গ্রেফতারির মুখে পড়লেন আলম।

২০২১ সালে, অবৈধভাবে বিদেশি মদ মজুত করে রাখা ও বিক্রির দায়ে তাকে গ্রেফতার করেছিল র‍্যাব।বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, মাদকদ্রব্য মজুত ও বিক্রির জন্য লাইসেন্স বা ছাড়পত্র থাকতে হবে।

চলতি বছরের ৩ এপ্রিল, ‘ইনসাইড দ্য ডেথ স্কোয়াড’ শীর্ষক প্রামাণ্যচিত্রটি সম্প্রচার করে ডয়চে ভেলে। এই প্রামাণ্যচিত্রে র‍্যাবের সদস্যদের দ্বারা বিচার-বহির্ভূত হত্যা ও অত্যাচারের অভিযোগ তোলা হয়।

এই প্রামাণ্যচিত্রে আলম ও অন্যান্যদের বক্তব্য ছিল। র‍্যাবের প্রাক্তন কর্মীদের অভিজ্ঞতাও সেখানে তুলে আনা হয়েছে।

ওই তথ্যচিত্রে আলমের পরিচয় গোপন রাখা হয়নি। তিনি অভিযোগ করেন, ২০২১ সালে প্রাথমিকভাবে মাদকের চার্জে তাকে গ্রেফতার করার পর তার উপর অত্যাচার করা হয়েছিল। প্রামাণ্যচিত্রে তিনি জানিয়েছিলেন, তাকে প্রচণ্ড মারধর করা হয়েছিল এবং বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়েছিল। একটা ‘টর্চার-সেলের’ বিবরণও দেন তিনি এই প্রামাণ্যচিত্রে।

র‍্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ

হাজার হাজার বিচার-বহির্ভূত হত্যা ও বলপূর্বক নিরুদ্দেশ করে দেওয়া নিয়ে র‍্যাবের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছে মানবাধিকার সংগঠনগুলি। ২০১০ সাল থেকে, এই সংগঠনগুলি কয়েক ডজন রিপোর্ট পেশ করে অভিযোগ তুলেছে যে, র‍্যাব ও বাংলাদেশের অন্যান্য নিরাপত্তা এজেন্সিগুলি গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে যুক্ত। বিশেষত রাজনৈতিক আন্দোলনকর্মী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরোধীদের উপর আঘাত হানা হয়েছে।

২০২১ সালের শেষের দিকে, এই বাহিনী ও এর ছয় প্রাক্তন ও তৎকালীন কর্মরত কর্মকর্তার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। এই নিষেধাজ্ঞা এখনও বহাল আছে। যদিও বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ র‍্যাবের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

সম্প্রতি ভয়েস অফ আমেরিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন র‍্যাবের প্রসঙ্গে বলেছেন, “শুরুর দিকে বাড়াবাড়ি করলেও গত কয়েক বছরে জনগণের কাছে র‍্যাবের বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হয়েছে এবং জনগণ তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল।… তবে, কোন ‘ব্যত্যয়’ হলে তাদের শাস্তি হয়, জবাবদিহিতার ক্ষেত্র সেখানে তৈরি আছে।”