ইউক্রেন-যুদ্ধ ও বাংলাদেশ : একটি পর্যালোচনা

  • মুহাম্মাদ গোলাম রব্বানী ইসলামাবাদী
  •  ২৭ মার্চ ২০২২, ২০:২০, আপডেট: ২৭ মার্চ ২০২২, ২০:৫৮

পূর্ব ইউরোপের দেশ ইউক্রেন এখন যুদ্ধাক্রান্ত। গত ২৪ ফেব্রয়ারি প্রেসিডেন্ট পুতিনের ঘোষণার মধ্য দিয়ে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী তিন দিক থেকে ইউক্রেনে আক্রমণ শুরু করে। এখন পর্যন্ত রাশিয়া তার প্রত্যাশার চেয়ে কম মাত্রায় হলেও আগ্রাসী ভূমিকায় ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের বেশ কাছাকাছি অবস্থায় রয়েছে (লেখার সময় পর্যন্ত)। পক্ষান্তরে, ইউক্রেনের যোদ্ধারা বলা যায়, প্রত্যাশার চেয়ে বেশি প্রতিরোধ দেখিয়ে এখনো রাজধানী নিজেদের দখলে রাখতে পেরেছে। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বিশ্ব বিভক্ত হয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে। জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের বিশেষ অধিবেশনে কোনো সর্বসম্মত প্রস্তাব পাস করা যায়নি ইউক্রেনের পক্ষে বা রাশিয়ার বিরুদ্ধে। পশ্চিমা বিশ্ব, যারা যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে চলে তারা এবং পশ্চিমাবিরোধী বলে পরিচিত রাশিয়া ও চীনের প্রভাব বলয়ে থাকা ইরান, উত্তর কোরিয়া, সিরিয়ার মতো দেশগুলো, ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পরস্পরের বিরুদ্ধে নেমেছে। মাঝখানে বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ার পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের মতো দেশগুলো তাদের নিরপেক্ষতা রক্ষায় কোনো পক্ষে ভোটদান থেকে বিরত থেকে কঠিন এক অবস্থান গ্রহণ করেছে। এমন দেশের সংখ্যা পঁয়ত্রিশ বলে খবরে জানা গেছে।

আজকে আমার আলোচনার বিষয় কিন্তু বাংলাদেশ। বাংলাদেশের এ অবস্থান নিয়ে এরই মধ্যে দেশের বাইরে ও ভেতরে আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। কারণ বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সাথে ভারতের একটি বিশেষ সম্পর্ক থাকলেও দেশ হিসেবে বাংলাদেশ মার্কিন ব্লকের দেশ হিসাবে পরিচিত। ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রের জন্মকালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশেষ অবদানের কথা স্বীকৃত। প্রতিবেশী ভারতের চেষ্টায় সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সে দিন ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে পশ্চিমাদের বাড়া ভাতে পানি ঢেলে না দিত, তা হলে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ক্ষণতারিখ কোথায় গিয়ে ঠেকত তা বলা মুশকিল। এটি অস্বীকারের উপায় নেই। মনে রাখতে হবে, আজকের রাশিয়াই সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল না। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার প্রাক্কালে যে ১৫টি প্রদেশ স্বাধীন হয়, তাদের মধ্যে ইউক্রেনও ছিল। সুতরাং স্বীকার করতে হবে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়ে আজকের রাশিয়ার মতো অন্য প্রদেশগুলোরও অবদান ছিল। বিশেষত স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভও ছিলেন কিন্তু ইউক্রেনের সন্তান। সে কারণে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদানের কৃতিত্ব কেবল আজকের রাশিয়াকে যেমন একতরফা দেয়া অযৌক্তিক তেমনি সোভিয়েত প্রদেশগুলোকে স্মরণের বাইরে রাখাও অনায্য।

ইউক্রেনে আগ্রাসন বিষয়ে বাংলাদেশের নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে ভোট দানে বিরত থাকায় কথা উঠেছে বিস্তর। কারো কাছে বিষয়টি রাজনৈতিক, কারো কাছে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কারণে কৌশলগত। তবে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে উপলব্ধি বলছে, বিষয়টিকে একেবারে রাজনীতিতে যেমন ঠেলে দেয়া অনুচিত, তেমনি নিছক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক বলে ধরে নেয়াও অবাস্তব। পক্ষ-বিপক্ষের আলোচনা থেকে আমাদের সরকারের অবস্থান নিয়ে যা উঠে এসেছে, তাতে নিচের প্রসঙ্গগুলো উল্লেখ করা যায় :

১. যুদ্ধের একটি পক্ষ রাশিয়ার সাথে ভারতের রয়েছে বহুদিনের কূটনৈতিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। তাছাড়া রাশিয়া ভারতের সবচেয়ে বড় সামরিক যোগানদার। ভারতও উভয়কূল রক্ষায় সাধারণ পরিষদের ভোটে অংশ নেয়নি। আর ভারতের সাথে বাংলাদেশের শাসক দল আওয়ামী লীগের রয়েছে বিশেষ সম্পর্ক।

২. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। বিশেষত জাতিসঙ্ঘে বারবার ভেটো প্রদান করে স্বাধীনতা ব্যাহত করার মার্কিন প্রচেষ্টাকে রাশিয়া শক্তভাবে প্রতিহত করে।

৩. ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচন, যাতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে বিপুল ভোটে জয়ী বলে ঘোষণা করা হয়। নির্বাচনটিকে বিরোধী মহল ভোটারবিহীন নির্বাচন বলে অভিহিত করেন। ঐ নির্বাচনকে যুক্তরাষ্ট্র জাল বলে অভিহিত করে নিরপেক্ষ নির্বাচন হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে। অথচ নির্বাচনের অব্যবহিত পরে ভারত শেখ হাসিনাকে বিজয়ের জন্য অভিনন্দন জানায়। সে সময় রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিনও শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানান, এমনকি চীনও।

৪. ২০১৮-এর নির্বাচন যা বিরোধীদের কাছে রাতের নির্বাচন বলে সমালোচিত, সেটিকেও যুক্তরাষ্ট্র ‘অনিয়ম আর ত্রুটিপূর্ণ’ বলে অভিহিত করে। ঠিক আগের বারের মতো রাশিয়া বিজয়ের জন্য শেখ হাসিনাকে দ্রুত অভিনন্দিত করে।

৫. বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সংঘটিত অপরাধের বিচারকে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিকোণে judicial rigour বা মাত্রাতিরিক্ত বিচারিক কঠোরতা বলে অভিহিত করে। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর আরো বলে : তারা মৃত্যুদণ্ডের আদেশকে সমর্থন করে না, কারণ গঠিত বিচারিক ট্রাইব্যুনাল আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করতে পারেনি। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।

৬. সাম্প্রতিক সময়ে অর্থাৎ ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র‌্যাব এবং তাদের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে কর্মকাণ্ডের নিন্দাও জানায়।

৭. বাংলাদেশ ও রাশিয়া ব্যবসা-বাণিজ্যের দিক থেকে শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি উপভোগ করে আসছে। আশা করা হচ্ছে, সম্প্রতি সমাপ্ত বাংলাদেশ-রাশিয়া আন্তঃসরকারি কমিশন বাণিজ্য, অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের আরো সম্প্রসারণের বাধা দূর করবে। মস্কোর বাংলাদেশ দূতাবাসের দেয়া তথ্যানুসারে, গত কয়েক বছরে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য অনেক বেড়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ রাশিয়ায় ৫৪৮.২৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রফতানি করেছে। আগের অর্থবছরে এটি ছিল ৪৮৫.২৩ মিলিয়ন ডলার। অন্য দিকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে ৬৫৩.০৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করেছে, যা আগের অর্থবছরে ৬২৯.৮০ মিলিয়ন ডলার ছিল। বাংলাদেশ রাশিয়ায় প্রধানত পোশাক, পাট, হিমায়িত খাবার, চা, চামড়া, হোম টেক্সটাইল ও সিরামিক পণ্য রফতানি করে। কিন্তু রাশিয়ার বাজারে সামুদ্রিক খাবার, আলু ও ওষুধের পণ্য রফতানির বিশাল সুযোগ রয়েছে। রাশিয়া থেকে দেশটির আমদানির মধ্যে রয়েছে সিরিয়াল, খনিজ, রাসায়নিক পণ্য, প্লাস্টিক পণ্য, ধাতু, যন্ত্রপাতি ও যান্ত্রিক সরঞ্জাম। রাশিয়া মূলধনী যন্ত্রপাতি, তাজা ও শুকনো ফল এবং কাঁচা চিনি রফতানি করতে পারে।

৮. ট্রাম্প-পরবর্তী সময়ে জো বাইডেনের পররাষ্ট্র নীতির সাথে সম্ভবত বর্তমান সরকারের সময়টা ভালো যাচ্ছে না। বাইডেন প্রশাসন শুরু থেকে তার পররাষ্ট্রনীতিতে মানবাধিকার বিষয়কে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়ার দাবি করে আসছে। সাথে সাথে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চিত্র নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোও তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য দিয়েছে।

ইউক্রেন প্রশ্নে জাতিসঙ্ঘের ভোটাভুটিতে বাংলাদেশ যে ভোটদানে বিরত থাকার পথ অবলম্বন করেছে, তাতে উপরের বিষয়গুলো প্রভাব বিস্তার করেছে বলে অনুমিত হচ্ছে। এখানে নিঃসন্দেহে রাজনীতি যেমন আছে, আর্থ-বাণিজ্যিক কৌশলগত ব্যাপারও আছে। নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে দেখলে বলতে হবে, বহির্বিশ্বের সাথে বাণিজ্যের বিষয়টিও এখানে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এর প্রথম কারণ, জাতীয় অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার প্রশ্ন। এখানে পোশাক শিল্পের কথা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। মনে রাখতে হবে, আবেগতাড়িত বা অতিমাত্রায় রাজনীতিনির্ভর নীতি গ্রহণ করে হয়তো সাময়িক বাহবা কুড়ানো যাবে কিন্তু জাতীয় উন্নয়নের ক্ষতি রোধ করা যাবে না। এখানে আমাদের বড় স্বার্থ দেশ ও মানুষের। তবে ভোটে বিরত থাকার মধ্য দিয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান হয়তো বাহ্যত নেয়া গেছে কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল মোমেনের সাম্প্রতিক বক্তব্য : আনীত প্রস্তাবে যুদ্ধ বন্ধ করার কথা বলা হয়নি, একটি পক্ষকে দোষারোপ করা হয়েছে, তাতে আন্তর্জাতিকভাবে ভিন্ন ইঙ্গিত বহন করছে বলে অনেকে মনে করছেন। দেশীয় রাজনীতিতেও সরকারের অবস্থানের বিষয়টি ধোঁয়াশা অবস্থায় রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তো এরই মধ্যে স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার যারা নিন্দা জানাবে না, তাদের মস্কোর সাথে যুক্ত দেশ হিসেবে বিবেচনা করবে ওয়াশিংটন। (প্রথম আলো, ১০ মার্চ ২০২২) পাশাপাশি রাশিয়া যা করেছে সেটি কোনোভাবে মেনে নেয়া যায় না। তা মেনে নিলে প্রতিটি বৃহৎ প্রতিবেশীর এ অধিকার বৈধতা পাবে যে, নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে ক্ষুদ্র্র প্রতিবেশীকে নিরস্ত্রীকরণ করতে দখল করে নিতে পারবে বা আগ্রাসন চালাতে পারবে। সেখানে আক্রান্ত দেশটির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিষয়টি একবারেই গৌণ হয়ে যায়।

প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত যদি তার নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে বাংলাদেশে আগ্রাসন চালায়, সেটি কি বাংলাদেশ বা সভ্য কোনো রাষ্ট্র সমর্থন করবে? এখানে আরেকটি বিষয় অনস্বীকার্য। তা হলো, বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে যুক্তরাষ্ট্রের অনুদান ও প্রশিক্ষণ। চাইলেই বাংলাদেশ হুট করে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের বলয়ের বাইরে যেতে পারে না। ইউরোপ ও আমেরিকায় বাংলাদেশের বিশাল পোশাক-বাজার ও অন্যান্য খাত রয়েছে। সেসব হাতছাড়া হয়ে গেলে আমরা বিপদে পড়ব। আমাদের গার্মেন্ট শিল্পের সাথে শতসহস্র মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র পরিবারের রুজি-রোজগারের অবলম্বন জড়িত। তেমনি রাশিয়ার সাথেও রয়েছে আমাদের বাজার। বলাবাহুল্য, যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসনের সাথে আমাদের সরকারের সম্পর্ক তেমন উষ্ণ নয়। র‌্যাবের আদলে আমাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার খড়গ যদি আরো বিস্তৃত হয়, তবে কি ভালো ফল বয়ে আনবে? সব দিক বিবেচনা করে এগোতে হবে। এমন ইস্যুতে জাতীয় সংলাপের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের তো মনে হচ্ছে, ইউক্রেন ইস্যুতে বাংলাদেশ উভয় সঙ্কটে নয়, চতুর্মুখী সঙ্কটে। সরকারের বর্তমান অবস্থান নিয়ে যারা সমালোচনা করছেন তাদের পক্ষেও যুক্তি আছে। তবে তারা যদি বিকল্প পথ বাতলে দিতে পারেন, তাতে জাতি উপকৃত হবে।