ইউরোপীয় পার্লামেন্টের একটি রেজ্যুলেশন (প্রস্তাব) পাসের পর দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশকে অবশ্যই তাদের আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার, বিশেষ করে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো মেনে চলতে হবে। সুশীল সমাজের সংগঠনগুলো যেন বিদেশি অনুদান গ্রহণ করতে পারে, তা-ও কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।’
বাংলাদেশের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবাধ বাজার সুবিধা ‘এভরিথিং বাট আর্মসের’ (ইবিএ) পরিসর আরও বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক চুক্তি ও সনদগুলোর গুরুতর লঙ্ঘনের কথা উল্লেখ করেন ইইউ পার্লামেন্ট সদস্যরা (এমইপি’রা)। বিশেষত মানবাধিকার সংস্থা অধিকার- এর বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার দেওয়া আদালতের রায়কে ‘দুঃখজনকভাবে’ একটি পশ্চাদগামী পদক্ষেপ বলে নিন্দা জানান। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের জন্য ইবিএ সুবিধা অব্যাহত রাখা উচিত কি-না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ।ইবিএ স্কিমের আওতায়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে অস্ত্র ছাড়া সব ধরনের পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত বাজার প্রবেশাধিকার পায় বাংলাদেশ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মানবাধিকার ইস্যুকে যে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নেওয়া উচিত – বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার এর মাধ্যমে সে বার্তাই দিয়েছে। নাহলে ইইউ এর জিএসপি প্লাস সুবিধা পাওয়া অনিশিচিত হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন তারা।
প্রস্তাব গ্রহণের বিষয়ে গবেষণা সংস্থা- সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান মন্তব্য করেন, ‘ইইউ এর মাধ্যমে একটি বার্তা দিয়েছে, এবং বাংলাদেশকে তা খুবই গুরুত্বের সাথে নিতে হবে।’
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম. হুমায়ুন কবির মনে করেন, এই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিক কোনো পদক্ষেপ হয়তো আসবে না, কিন্তু তারপরও ইইউভুক্ত দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশের নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হতে পারে।
স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উত্তরণ (এলডিসি গ্রাজুয়েশন) পরবর্তী সময়ে জিএসপি প্লাস সুবিধা পেতে বাংলাদেশ যখন ইইউ এর সাথে আলোচনা করছে – তার মধ্যেই এ ঘটনা ঘটলো বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ২০০৩ সাল থেকেই ইবিএ স্কিমের আওতায় ইইউ- এর সাথে বাণিজ্য সুবিধা পেয়েছে বাংলাদেশ। ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নে দেশের রপ্তানি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
‘রেজ্যুলেশনে (প্রস্তাবে) ইবিএ’র উল্লেখ থাকা বাংলাদেশের জন্য নতুন ঝুঁকি তৈরি করেছে’ – যোগ করেন তিনি।
ইইউ পার্লামেন্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতি অনুযায়ী, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ৭টি আলাদা গ্রুপ এই প্রস্তাব উত্থাপন করে। আজ বৃহস্পতিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) অনুষ্ঠিত ভোটাভুটিতে হাত তুলে প্রস্তাবটি পাসে সমর্থন দেন ইইউ পার্লামেন্ট সদস্যরা (এমইপি’রা)।
সম্ভাব্য প্রভাব
জিএসপি ও ইবিএ’র মতো বিভিন্ন বাণিজ্যিক সমঝোতার আওতায়, উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বাণিজ্য অগ্রাধিকার দেয় ইইউ। সুবিধাভোগী দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি হলে– ইইউ এসব সুবিধা অব্যাহত রাখার বিষয়ে পুনঃমূল্যায়ন করতে পারে।
এছাড়া, কোনো দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি হলে– দেশটিতে ব্যবসা পরিচালনা বা বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয় না বিদেশি কোম্পানিগুলো। কোনো দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে জনপরিসরে উদ্বেগ দেখা দিলে, অনেক সময় কোম্পানিগুলোর প্রতি ওই দেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার আহ্বান জোরালো হয়।
রপ্তানিকারকদের আশঙ্কা
ইউরোপীয় পার্লামেন্ট প্রস্তাবটি গ্রহণ করায় তাদের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার কথা জানিয়েছেন রপ্তানিকারক ও বাণিজ্য বিশ্লেষকরা। তারা বলেছেন, প্রস্তাবটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের আনুষ্ঠানিক অবস্থানে রূপ নেওয়ায়, তা ইইউভুক্ত দেশগুলোর সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে তাদের সরকার ও নির্বাহী কর্তৃপক্ষগুলোর ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করবে। আগামীতে যেকোনো দ্বিপাক্ষিক সংলাপ বা দর কষাকষিতে এর জোরালো প্রভাব পড়বে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
বিশেষত, ইইউ ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পৃক্ততা বাড়ানোর যে প্রক্রিয়া চলছে, তাতে এর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। দ্বিপাক্ষিক এই প্রক্রিয়ার আওতায় আছে, জিএসপি সুবিধা পাওয়ার আলোচনা এবং নানাবিধ ব্যবসায়িক চুক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
নাম না প্রকাশের শর্তে বেশ কয়েকজন পোশাক রপ্তানিকারক তাদের উদ্বেগ তুলে ধরেন। তারা জানান, শুধুমাত্র প্রস্তাব গ্রহণের ঘটনাতে ইউরোপীয় বায়াররা এদেশে ব্যবসার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত হতে পারেন। ফলে এই ঘটনা বিভিন্ন খাতের রপ্তানিকারকদের জন্য প্রতিকূলতা তৈরি করবে। পোশাক শিল্পে এর বড় প্রভাব পড়বে, কারণ বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির সবচেয়ে বড় গন্তব্যই হলো- ইইউ।
২০২৬ সাল নাগাদ বাংলাদেশের এলডিসি গ্রাজুয়েশনের কথা রয়েছে। তার আগে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা যখন তিন বছরের গ্রেস পিরিয়ড পেতে চাইছিলেন, তারমধ্যেই এ ঘটনা ঘটলো। ইইউ-তে অগ্রাধিকারমূলক বাজার প্রবেশাধিকার ধরে রাখতে এই মেয়াদ বাড়ানোটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এদিকে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আহ্বান জানিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যেসব বক্তব্য দেওয়া হয়েছে, তার সাথে ইইউ পার্লামেন্টের গৃহীত প্রস্তাবটির ভাষায় অনেকটাই মিল থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেন রপ্তানিকারকরা। তাদের ধারণা, এই প্রস্তাবের ফলাফল রপ্তানির জন্য বেশ প্রতিকূলতা সৃষ্টি করবে।
তবে ভিন্ন মতপোষণ করেন বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন- বিজিএমইএ’র সভাপতি ফারুক হাসান। তিনি বলেন, ব্যবসায়িক সম্পর্কের ওপর এই প্রস্তাব কোনো চাপ সৃষ্টি করবে না। বাংলাদেশের কারখানা পর্যায়ের নিরাপত্তা, এ শিল্পের নবায়নযোগ্য উৎসের বিদ্যুৎ/ জ্বালানির দিকে রুপান্তর এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রণীত শ্রম আইন নিয়ে বায়াররা সন্তুষ্ট। এসব পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশ থেকে পণ্য সংগ্রহের বিষয়ে তাদের মধ্যে আস্থা তৈরি হয়েছে।
সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে– সরকার দরকারি সকল পদক্ষেপ নেবে বলেও দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
একই মনোভাব ব্যক্ত করে, বাংলাদেশের নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন- বিকেএমইএ’র ভাইস প্রেসিডেন্ট ফজলে শামীম এহসান বলেন, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা শহিদুল ইসলামের হত্যা মামলায় সুবিচার নিশ্চিত করতে সরকার ইতোমধ্যেই উদ্যোগ নিয়েছে। যেকোনো হত্যাকাণ্ডের সুবিচার নিশ্চিত করতে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার কথা উল্লেখ করে এহসান বলেন, এমন পরিস্থিতিতে জিএসপি সুবিধার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে– এমন কোনো ঘটনাই দেশের শিল্পগুলোর কাঙ্ক্ষিত নয়। এ অবস্থায়, সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সামর্থ্যের ওপরই আস্থা রাখছি।
প্রস্তাবে যা রয়েছে
‘বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি’ বিষয়ক ইইউ পার্লামেন্টের প্রস্তাবে – বাংলাদেশে মানবাধিকারের হালচিত্র, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন, অধিকারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের কারাদণ্ড, সাইবার নিরাপত্তা আইন, পোশাক শ্রমিকনেতা শহিদুল ইসলামের হত্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ের উল্লেখ আছে।
অধিকার নেতাদের কারাদণ্ড প্রসঙ্গ
ইইউ রেজ্যুলেশনে মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান এবং সংগঠনটির পরিচালক এএসএম নাসিরউদ্দিন এলানের বিরুদ্ধে কারাদণ্ডের রায়ের নিন্দা জানানো হয়েছে।
ইইউ পার্লামেন্টের ওয়েবসাইটে রেজ্যুলেশনের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ প্রকাশ করা হয়। এতে ইউরোপীয় ব্লকটি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি ‘অবিলম্বে ও নিঃশর্তভাবে এই রায় বাতিল করতে, অধিকারের নিবন্ধন পুনরায় কার্যকর করতে এবং সুশীল সমাজের সংগঠনগুলো যেন অনুমোদিত বিদেশি তহবিল গ্রহণের সুযোগ পায় তা নিশ্চিত করতে’- বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
অবনতিশীল মানবাধিকার পরিস্থিতি
ইইউ পার্লামেন্টের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘এনজিও, মানবাধিকার সংগঠন ও কর্মী, এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য একটি নিরাপদ ও অনুকূল পরিবেশ প্রতিষ্ঠা, এবং বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারসমূহ- বিশেষত ইন্টারন্যাশনাল কভেনেন্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস- এর আওতায় যেসব প্রতিশ্রুতি রয়েছে– সেসব মেনে চলতে (ইইউ) বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তাগিদ দিচ্ছে।’
এছাড়াও, ‘বলপূর্বক অন্তর্ধান বা গুমের অভিযোগগুলো তদন্তে জাতিসংঘের সাথে একটি বিশেষ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায়’ বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের আদালতের শুনানিতে অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়ার ওপর তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও অনুসারে আইন প্রণয়নের আহ্বান
প্রস্তাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে সরকারের প্রতি আবারো আহ্বান জানানো হয়েছে, এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্য রেখে সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়নে উৎসাহিত করা হয়েছে।
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন
বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার এবং বাংলাদেশে বিক্ষোভকারীদের ওপর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের বিষয়ে প্রস্তাবে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
এতে ‘২০২৪ সালে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করতে’ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, নির্বাচনে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের বাধা-মুক্ত অংশগ্রহণ একান্ত জরুরি বলেও উল্লেখ করা হয়।
পোশাক শ্রমিক নেতা হত্যা
২০২৩ সালের জুনে শ্রমিকনেতা শহিদুল ইসলামের নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে নিন্দা করা হয়েছে ইইউ পার্লামেন্টের প্রস্তাবে। পাশাপাশি দোষীদের বিচারের সম্মুখীন করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
এছাড়া, ইবিএ পরিসর আরও বাড়াতে বাংলাদেশের দেওয়া প্রতিশ্রুতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মূল মানদণ্ডগুলো অনুসরণ এবং একটি শ্রম রোডম্যাপ প্রণয়নে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
প্রস্তাবটি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তুলে ধরতে ইউরোপীয় কাউন্সিল ও ইউরোপীয় কমিশনে পাঠানোর অনুরোধ জানিয়েছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা।