কর্মকর্তারা বলছেন, কবির বিন আনোয়ারের মতো এত কম সময়ের জন্য এর আগে কেউ মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দায়িত্ব পালন করেননি। এর আগে ২০০২ সালে ১ মাস ৪ দিন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবের দায়িত্ব পালন করেছিলেন কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী। ২০০৬ সালে তিন মাস তিন দিনের জন্য দায়িত্বে ছিলেন আবু সোলায়মান চৌধুরী। সব মিলিয়ে দেশের ইতিহাসে প্রশাসনের শীর্ষ পদে এটিই ছিল সবচেয়ে কম সময়ের জন্য দায়িত্ব পালন।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তথ্য বলছে, মাত্র ১৯ দিন দায়িত্বে ছিলেন কবির বিন আনোয়ার। গত ১৫ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার অবসরে যান সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। শুক্র ও শনিবার সরকারি ছুটির দিন থাকায় কবির বিন আনোয়ার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন ১৮ ডিসেম্বর। তবে এর আগে ১৬ ডিসেম্বরের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। সেই হিসাবে তাঁর দায়িত্ব পালনের মেয়াদ ছিল মাত্র ১৯ দিন।
কবির বিন আনোয়ারের সরকারি চাকরিতে ৫৯ বছর পূর্ণ হয়েছে আজ ৩ জানুয়ারি। তাঁর জন্ম ১৯৬৪ সালে সিরাজগঞ্জ জেলায়। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। ১৯৮৮ সালে সহকারী কমিশনার হিসেবে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন তিনি। ২০১৮ সালে জ্যেষ্ঠ সচিব হিসেবে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান কবির বিন আনোয়ার। সেখান থেকে তাঁকে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দায়িত্ব দেয় সরকার।
প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন, অতীতের ধারাবাহিকতায় বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সচিবের মেয়াদ বাড়ানো হবে। কারণ, এর আগের মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম ও শফিউল আলমের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল।
সরকারের শীর্ষস্থানীয় অন্তত পাঁচ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে কবির বিন আনোয়ারকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হবে—এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু তার মেয়াদ না বাড়িয়ে সরকার মন্ত্রিপরিষদ সচিব করেছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মাহবুব হোসেনকে।
প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় পদে থাকা একাধিক কর্মকর্তা আজ প্রথম আলোকে বলেন, কবির বিন আনোয়ার নিজেও এমনটা হবে তা ভাবতে পারেননি বলে তাঁদের মনে হয়েছে। আজ সকালে রাজারবাগে ছয় দিনব্যাপী পুলিশ সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তিনি। সে সময় তাঁর আশপাশে থাকা এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, তখনো কবির বিন আনোয়ার উৎফুল্ল ছিলেন। এ সময় সঙ্গে তাঁর স্ত্রীও ছিলেন। প্রজ্ঞাপন জারি হলে অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগেই তিনি অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেন। তবে বিকেলে স্বাধীনতা পুরস্কারের বাছাই কমিটির সভায় যোগ দেন। প্রশাসনের একটি পক্ষ বলছে, তাঁকে অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে দেখা যেতে পারে।
নানা আলোচনা
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে মেয়াদ না বাড়িয়ে কবির বিন আনোয়ারকে কেন সরানো হলো, তা নিয়ে হিসাব–নিকাশ করছেন কর্মকর্তারা। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১ জানুয়ারি বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের নতুন কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি ঘোষণা করা হয়। নতুন কমিটির সভাপতি হন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোস্তফা কামাল। অফিসার্স ক্লাবে ওই দিন কমিটি ঘোষণার সময় অ্যাসোসিয়েশনের নতুন সভাপতি নির্বাচন নিয়ে প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা দুটি পক্ষে ভাগ হয়ে যান। একটি পক্ষ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খাজা মিয়াকে চেয়েছিল। আরেক পক্ষ নৌপরিবহনসচিব মোস্তফা কামালকে চাইছিল। এ নিয়ে প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে কথা–কাটাকাটি ও বাগ্বিতণ্ডা হয়। ওই ঘটনায় কবির বিন আনোয়ারের অবস্থান একটি পক্ষের অনুকূলে গিয়েছিল বলে সেখানে উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তা জানান। এটা তাঁর চুক্তিভিত্তিক মেয়াদ না বাড়ার একটি কারণ বলে ধারণা করছেন অনেকে।
কেউ কেউ বলছেন, গত বছর আগস্টে বরিশালের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বাসায় হামলার ঘটনায় সেখানকার সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহকে দায়ী করে তাঁকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেয় বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। মেয়রের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলেও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের এ সংগঠনের পক্ষ থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। তখন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন কবির বিন আনোয়ার।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই কর্মসূচির প্রকল্প পরিচালক থাকাকালে আরেকটি পক্ষের সঙ্গে কবির বিন আনোয়ারের বিরোধের কথাও আলোচনায় ছিল। যাঁরা এখন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন, মেয়াদ না বাড়াতে তাঁদেরও ভূমিকা থাকতে পারে বলে কেউ কেউ মনে করছেন।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্বে থাকাকালে কাউকে কাউকে ঠিকাদারি কাজ না দেওয়ার অভিযোগ ছিল কবির বিন আনোয়ারের বিরুদ্ধে। এ ক্ষেত্রে তাঁরাও ভূমিকা রাখতে পারেন বলে কেউ কেউ মনে করছেন।
কর্মকর্তাদের অনেকের প্রশ্ন, যদি অবসরেই পাঠানো হবে, তাহলে কেন কম সময়ের জন্য কবির বিন আনোয়ারকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব করা হলো। তবে কেউ কেউ বলছেন, মাহবুব হোসেনকে আগেই মন্ত্রিপরিষদ সচিব নিয়োগ দেওয়া হতো। সেখানে কবির বিন আনোয়ারকে পুরস্কার হিসেবে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
কবির বিন আনোয়ার অবশ্য আগামীতে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের বিষয়ে এখনো আশাবাদী। শেষ দিন মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কার্যালয়ের ঢোকার পথে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আজ আমার সরকারি চাকরির মেয়াদ শেষ হয়েছে, এটি রুটিনমাফিক বিষয়। চুক্তিভিত্তিক হওয়া সুযোগের বিষয়। এখন যেটা হয়েছে, এটাই স্বাভাবিক ছিল। প্রধানমন্ত্রী যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেটা বুঝেশুনে নিয়েছেন। সেই সিদ্ধান্তের প্রতি আমার সম্মান আছে। তবে পরে হয়তো অন্য কোনো ভালো জায়গায়ও আমাকে দেখতে পারেন।’